মানুষ এবং বাঁশ সমাচার–এইচ.এম. সিরাজ
স্কুলের পাঠ্য বইয়ে পড়তাম পূর্ব পাঠের পুনরালোচনা। বর্তমানে ওই চ্যাপ্টারটা হুবহু আছে কীনা সেটি আমার জানা নাই। তবে এই কথাটুকুন বলার নিশ্চয়ই কারণ আছে বৈ কি। ইতিপূর্বে লিখেছিলাম ‘মানুষ এবং বাঁশ’। আজ একই বিষয়ে পুনর্বার লিখছি বলেই শিরোনামে ‘সমাচার’ শব্দটি সংযোজন করাসহ স্কুলপাঠ্যের কথাটিও জুড়লাম। বয়স আমার যাই হোক। আজ দেড়যুগ অবধিই আমি পড়ছি ‘প্রথম আলো’। আর ‘প্রথম আলো’ পড়ার সুবাধেই হয়তোবা ‘সৈয়দ আবুল মকসুদ’ পড়ছি। সমসাময়িক কয়েকজন প্রিয় লেখকের মাঝে তিনি একজন। সৈয়দ আবুল মকসুদ’র ‘সহজিয়া কড়চা’ এবং ‘বাঘা তেঁতুল’ নামীয় দু’টি কলামই আমার সুখপাঠ্য। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘মানুষ এবং বাঁশ’ শিরোনামে আমার একটি লেখার মাত্র দু’দিনের মাথাতেই প্রথম আলোতে ওনার ‘বাঘা তেঁতুল’ কলামে ‘বাঁশ, বাঁশি ও বাংলাদেশ’ শিরোনামে লেখাটি পাঠ করে অতিশয় আমোদিত হবার পাশাপাশি তৎবিষয়ে কিঞ্চিৎ লিখতেও মনে সাধ জাগলো।
—
সম্পর্ক কদ্যপিও চুকে যায় না। বাঁশের গোড়ায় করুলের জন্ম। করুল থেকেই বাঁশের যাত্রারম্ভ। সেই থেকে যাত্রাপথে নানান সময় ধারণ কর নানান নাম। যদিওবা এসব নাম মানুষেরই রাখা। ডেগা, কচি, কড়া, কাচা আপোক্ত, পোক্ত, পাকনা এমনি বহুবিধ নামে আমরা বাঁশকে ডাকতে পারি। এইসব পরিবর্তিত কালক্রমে ঘটে থাকে নানান ধরণের পরিবর্তন-পরিবর্ধনের পালা। তবে হাজার পরিবর্তনেও বাঁশের ঝাড়ের বৈশিষ্ট্য কিন্তু হারায় না। একটু হলেও মিল থাকেই। বাঁশের জীবন চিত্রের সাথে কি আমাদের জীবনের মিল নেই? হ্যা, অবশ্যই আছে। আবার বাঁশকে নিয়ে রয়েছে নানা ঢঙের উপকথা। ‘কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস’। এমনি আরো কত্তো ধরণের উপকথা, প্রবাদ প্রচলিত আমাদের বাঙালি সমাজে। কেবল ঝাড় থেকে কেটে ফেললেই বাঁশকে কিন্তু কোনোভাবেই পৃথক করা যায় না। কদাচ দু’দফা এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে কয়েক দফা রূপ বদলেও নয়। আর এটাই হলো বাঁশের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য।
—
সেই অনাদিকাল থেকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ‘বাঁশ’ এর বহুমাত্রিক ব্যবহার বিরাজমান। বাঁশ বিহীন সমাজ পৃথিবীতে কদ্যপিও ছিলো না, এমনকি আজকালকার স্যাটেলাইট যুগেও নেই। কতিপয় ক্ষেত্রে হয়তো আগের চাইতে আরো অনেক গুণ বেড়েছেও। ‘পৃথিবীর কোন্ দেশে বাঁশ নেই?’ এমন প্রশ্ন যদি কেউ আমায় করেন, তাহলে আমাকে সবিনয়ে বলতে হবে- ‘এই তথ্যটি সত্যিকারার্থেই আমার আজানা’। তবে হ্যাঁ, এটুকুন অন্তত জানি যে, এই বাঁশ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে অষ্টমতম স্থানে। মানুষের জীবনে বাঁশের প্রয়োজনীয়তা যে কতোখানি সেটি লিখে তো নয়-ই, এমনকি বলেও শেষ করবার নয়। মানব জীবন। যার জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি কাজে লাগে বাঁশ। বিশেষত বাঙালির সমাজে বাঁশ জড়িয়ে আছে জীবনে এমনকি মরণেও।
—
গন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর নবজাতকের নাড়ি কাটা হতো বাঁশের ছিলকা দ্বারা। এমনটি এই জনপদের হাজারো বছরের রেওয়াজ-দরকার-সংস্কৃতি। আজকাল যদিও তেমনটি খুব একটা দেখা যায় না। তথাপিও নাই এটি বলা যাবে না। এ তো গেলো মানব শিশু ভূমিষ্ঠ কালের কথা। মুসলিম সম্প্রদায়ের ছেলে সন্তান একটু বড় হলে সুন্নতে খাতনা করাতে হয়। এ কাজটাতেও দরকার হয় বাঁশের। হাজামরা বাঁশের ছিলকা দিয়েই ব্যাটা ছেলের লিঙ্গের অনাবশ্যকাংশ কাটেন। এই কর্তন কাজটিকে সহজতর করতেও বাঁশের কঞ্চি দ্বারা নির্মিত আরেকটি শন পর্যায়ের যন্ত্র ব্যবহার করে থাকেন। অবশ্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের সহজলভ্যতার কারণে বর্তমানে উপরোক্ত দু’টো কর্মেরই ঘটেছে অনেকটাই রকমফের।
—
আমাদের বাঙালি সমাজের বসতঘরের সর্বত্রই লাগে বাঁশ। গৃহস্থালি কাজ বাঁশের তৈজসপত্র বিহীন কল্পনা করাটাও একরকম বৃথা-ই। নিম্নাঞ্চল কিংবা সমতল এলাকা ছাপিয়ে পাহাড়ি জনপদের দিকে একটু দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে তো আরোই বেসুমার। আবার শিল্পকর্মেও বহুবিধভাবে ব্যবহার হয়ে থাকে বাঁশ। শহুরে অভিজাত পরিবারেও বাঁশের শিল্পকর্ম অনেকটা বেশি পরিমাণেই সমাদৃত। অবশ্য আজকাল তো উন্নয়ন কাজে লোহার রডের বদলেও নাকি কেউ কেউ ‘বাঁশ’ ব্যবহার করেন! বাংলাদেশ নদীমাতৃক এক জনপদ। সভ্যতার উন্নয়নের পরিণামে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে আবহাওয়ার ব্যাপক তারতম্য ঘটলেও বাংলাদেশে আজও ষড়ঋতুর প্রভাব বিদ্যমান। বৃষ্টি-বাদল-বন্যা’র সাথে আমাদের নিত্যকার লড়াই। হঠাৎ ভারি বর্ষণে মাঠ-ঘাট-খাল-বিল তলিয়ে যাওয়া নৈমত্তিক মাত্র। বানের পানি থেকে রক্ষা পাওয়া, পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়া ঠেকাতে তরিৎ গতিতে বাঁধ দেয়ার অন্যতম উপকরণও এই বাঁশ।
—
মানুষ মরণশীল। মৃত্যুই এই জীবনের একমাত্র ঠিকানা। নশ্বর জীবনের পরই শুরু কবর জীবন। অর্থাৎ মরণের পর শেষ আশ্রয়টাও হয় এই বাঁশের ঘরেই। যদিও মাটির ঘর, কিন্তু এই মাটির ঘরের ছানি দেয়া হয় বাঁশ দিয়েই। শবদেহ কবরস্থ করা পরও লাশটিকে জানোয়ার থেকে রক্ষা করতে হয়। এজন্য কবরটার চারপাশে দিতে হয় বেড়া। আর এই কাজটিতেও দরকার লাগে বাঁশ। অর্থাৎ বাঁশের আশ্রয়ে এই ধরাধামে আগমণ, আবার বাঁশের আশ্রয়েই প্রস্থান। একই ঝাড়ের বাঁশ। লাগে কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন কাজে। নশ্বর দুনিয়ায় আবির্ভাব থেকে শুরু করে চিরবিদাই কালেও এটা চাই-ই চাই। জন্মের পর শিশুর নাড়ি কাঁটা, ঘরের পালা-বেড়া-চাল নির্মাণ, গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত নানান রকমের তৈজসপত্র,বাঁধ নির্মাণের খুঁটি,খালে সাঁকো, টয়লেটের খুঁটি-পালা-বেড়া, নির্মাণ কাজের মাচা-খুঁটি, মারনাস্ত্র, কবরের ছানিসহ হাজারো প্রকারের কাজেই লাগে এই বাঁশ।
—
এক কথায় বলতে গেলে, মানব জীবনটাই যেন বাঁশময়। কিন্তু আমরা মর্যাদা দেবার বেলায়! হ্যা, এক্ষেত্রে যেনো কোনোকিছুতেই কোনোরকম তফাৎ নাই। কবরের বাঁশ টয়লেটের বাঁশ একই মর্যাদার! কিন্তু আসলে কি তাই? আমরা কি পার্থক্যটা আদৌ বুঝি? নাকি কখনো বুঝতে চাই? মোটেই না! মনে করি একই ঝাড়ের (একই বাবার সন্তান) বাঁশ! আমরা ভুলভাবে চলা/বোঝার ক্ষেত্রে বেশ পারঙ্গম। এজন্যই হয়তো এতোখানি উপকারী বস্তুটিও আমাদের ক্ষতি করতে একটুও ভুল করে না! ঐ যে আগেই বলেছিলাম প্রবাদে একটা কথা আছে, ‘কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস’। অর্থাৎ বাঁশ অতিশয় উপকারি হয়েও এটি যথা সময়ে-যথা নিয়মেই আমাদেরকে একদম ঠিকঠাকই পাইয়ে দিয়ে থাকেই। তাইতো আমরা সদা-সর্বদায়ই বাঁশ খাই! আবার বাঁশ পাই! হ্যা, মাঝেমধ্যে কিন্তু বাঁশ দেইও!
#
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট ।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু। গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।
—