আমার সাংবাদিকতা শেখার প্রথম পাঠশালা

।। খায়রুল আহসান মানিক ।।
সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়ার জন্য ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এম এ প্রিলিমিনারি শ্রেণীতে ভর্তি হলেও আমার সাংবাদিকতা শেখার প্রথম পাঠশালা সাপ্তাহিক আমোদ। মায়ের বংশের বেশ ক’জন স্বনামধন্য ব্যক্তি সাংবাদিকতা জগতে জড়িত থাকায় কলেজে পড়াশোনা করাার সময় আমি সাংবাদিকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট হই। এরই রেশ ধরে ১৯৭৬ সালের কোন এক সময়ে যোগাযোগ করি সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকায়। কুমিল্লা শহরের পুরাতন চৌধুরীপাড়ার ওই পত্রিকা অফিসে দেখা করি সম্পাদক জনাব মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী সাহেবের সাথে। তাঁর পত্রিকায় চৌদ্দগ্রাম প্রতিনিধি হবার ইচ্ছে জানাই তাঁকে। তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর স্ত্রী বেগম সামসুননাহার রাব্বীর সাথে। সেদিন তিনি আমাকে অনুমতি দেন পত্রিকায় খবর পাঠানোর জন্য। সাথে কিছু পরামর্শ দেন খবর তৈরি ও পাঠানোর ব্যাপারে। তিন মাস ঠিকঠাক ভাবে খবর পাঠালে আমাকে পরিচয় পত্র দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন। আমোদ পত্রিকার একখানা কপি আমার বাড়ির ঠিকানায় ডাকযোগে পাঠাবেন বলেও জানান। তিন মাস পেরুলে আমোদ-এর প্যাডে হাতে লেখা একখানা পরিচয় পত্র আমাকে দেয়া হয়। তাতে সাটানো হয় আমার একখানা পাসপোর্ট সাইজের ছবি। পরিচয় পত্রখানা হাতে পেয়ে মনে হলো স্বর্গ পেয়েছি। এটা ছিল আমার জীবনের প্রথম সাংবাদিকতার স্বীকৃতি। এতে ছিল অপার আনন্দ। এর অনেক বছর পর আরেকটি পরিচয় পত্র পেয়েছিলাম। সেখানা ছিল টাইপ রাইটারে লেখা এবং সাধারণ লেমিনেটিং করা। যার মেয়াদ ছিল ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। আমার কাছে সেই পরিচয়পত্র খানা এখনো আছে। এরপরে বিভিন্ন মিডিয়ায় কাজ করার সুবাদে আধুনিকতম অনেক পরিচয় পত্র পেলেও সেই পরিচয়পত্র খানা এখনো আমার কাছে অমূল্য। সাপ্তাহিক আমোদ আমাকে চৌদ্দগ্রামে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত করেছে। পূর্ণাঙ্গ প্রতিনিধি হিসাবে আমাকে নিয়োগ দেওয়ার পর সম্পাদক মহোদয় আমার নামে ৫ কপি আমোদ বরাদ্দ দেন। এর ৪ কপি গ্রাহককে দিয়ে চাঁদা নিয়ে খবর পাঠাবার ডাক খরচের ব্যয় করতে বলেন। বাকি কপি আমার পড়ার জন্য দেয়া হয়। তার এই বিবেচনা আমার বেশ ভালো লেগেছিল। এর অনেক বছর পরেও ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকে কাজ করার সময় এক কপি পত্রিকা সৌজন্য সংখ্যা হিসাবে পাইনি। পত্রিকার সার্কুলেশন থেকে বলা হয়েছিল পত্রিকা কিনে পড়তে। পত্রিকা অফিসের সাংবাদিক থেকে কর্মচারী সবার জন্য নাকি এই নির্দেশনা ছিল। ৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে জাপান থেকে দেশে আসার পর কুমিল্লা শহরে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় চৌদ্দগ্রাম প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হই। এ সময়ে ঢাকার অন্যতম জাতীয় দৈনিক আজকের কাগজের কুমিল্লা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন শুরু করি। এরপর দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বর্তমান, অন লাইন নিউজ পোর্টাল পূর্ব- পশ্চিম, দৈনিক বাংলাদেশের খবর, দি ডেইলি বাংলাদেশ নিউজ পত্রিকায় কাজ করেছি। বর্তমানে বার্তা সংস্থা ইউ এন বি, স্যাটেলাইট টেলিভিশন এটিএন বাংলা ও এটিএন নিউজ এর সাথে সম্পৃক্ত আছি।
১৯৮৫সালে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক দ্য এশিয়ান মাস কমিউনিকেশন এ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার (এমিক) এশিয়ার সফল কমিউনিটি সংবাদপত্রের ওপর জরিপ করে। জরিপে পাঁচটি পত্রিকাকে এশিয়ার সফল আঞ্চলিক পত্রিকা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এমিক। এ পাঁচটি পত্রিকার মধ্যে দুটি বাংলাদেশের। একটি কুমিল্লার সাপ্তাহিক আমোদ। অপরটি সিলেটের সাপ্তাহিক যুগভেরী। ইউনেস্কোর হয়ে এমিক এ জরিপ করেছিলো ।গবেষণা নিয়ে মুদ্রিত বইয়ের কপি আমোদ সম্পাদককে উপহার দেওয়া হয়েছিল। আমি তাঁর অফিসে গেলে তিনি আমাকে বইয়ের কপিটি পড়তে দেন। পড়তে গিয়ে দেখি বইটিতে সাপ্তাহিক আমাদ-এর পূর্ব প্রকাশিত একটি কপির ছবি দেয়া আছে। যার প্রথম পৃষ্ঠায় আমার পাঠানো চৌদ্দগ্রামের কৃষির একটি খবর ছাপা আছে। এছাড়াও ভেতরের পাতায় আমার একটি কবিতা রয়েছে। কবিতার নাম “ও বন্ধু আমার।’ সেদিন আমোদ পরিবারের সদস্য ও সম্মানিত পাঠকের মত আমিও উল্লাসিত হয়েছিলাম। বয়সে ছোট হলেও আমোদ সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী আমাকে আপনি করে ডাকতেন। একদিন তিনি আমাকে বললেন, আপনি তো কবিতা লেখেন- আমোদ-এ লেখা দেবেন। ১৯৯২ সালের কোন এক বৃহস্পতিবার সকালে আদালত পাড়ায় দেখা হল তাঁর সাথে। তিনি পত্রিকা বিলিকারী ছেলেটিকে নিয়ে আমার ভাগিনা আলমগীর হোসেন রিপনের বাসায় সৌজন্য সংখ্যা দিতে এসেছেন। রিপন ছাত্র অবস্থায় আমোদে লেখালেখি করত। বর্তমানে সে অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একদিন বললেন- আপনাদের চৌদ্দগ্রামে অনেক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী চট্টগ্রামে ব্যবসা করেন। আপনি যদি কয়েকজনের নাম ঠিকানা দেন তাহলে আমি বিজ্ঞাপনের জন্য চেষ্টা করব। সাদাসিধা এই মানুষটির যে কোন মানুষকেই আপন করে নিতে পারতেন। আমোদ-এর অন্যতম প্রাণ বেগম শামসুর নাহার রাব্বীও ছিলেন অসামান্যা। আমোদ অফিসে গেলে তিনি মমতা ভরে আপ্যায়ন করতেন। তার উত্তরসুরী বর্তমান সম্পাদক বাকীন রাব্বী ভাই এখনো দেশে এলে আপ্যায়নে কোন ত্রুটি রাখেন না। একবার বেগম রাব্বী আমেরিকা থেকে দেশে আসলে তাকে দেখতে আমোদ কার্যালয়ে যাই। তিনি বললেন, মানিক তোমার তো ডায়াবেটিস আছে। তোমার জন্য ডায়াবেটিস পরীক্ষার মেশিন এনেছি। তিনি ডায়াবেটিস মাপার একখানা ডিভাইস ও বেশ কিছু স্ট্রিপ দিলেন। এ যেন সন্তানকে যতœ করে কোন কিছু উপহার দেয়া। ডিভাইসখানা এখনো আমার কাছে আছে। রাব্বী দম্পতি তাদের লেখা গ্রন্থ আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।
তার আন্তরিকতা আজও মনে পড়ে, পড়বে যতদিন বেঁচে থাকি। মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে গঠিত স্মৃতি সংসদে আমি সদস্য হই। প্রথমে সাধারণ সদস্য। তারপর নির্বাহী কমিটির সদস্য হই। পরবর্তীতে কোষাধ্যক্ষ, সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে সহসভাপতি পদে আছি। তার প্রতি সম্মান আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সাপ্তাহিক আমোদ ও আমি কাছাকাছি বয়সের। হাজারো পাঠকের ভালোবাসা নিয়ে আমোদ এখনো বেঁচে আছে গৌরবের সাথে, বেঁচে থাকবে ভবিষ্যতেও। আমি এক সময় বেঁচে থাকব না। আমোদ বেঁচে থাকবে তার গৌরব নিয়ে। মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন আমোদ প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী ও উপদেষ্টা সম্পাদক মরহুমা বেগম সামসুন নাহার রাব্বী ।
লেখকঃ এটিএন বাংলা, এটিএন নিউজ ও ইউএনবি’র কুমিল্লা প্রতিনিধি।

inside post
আরো পড়ুন