স্বপ্নে পাওয়া রেসিপিতে মুক্তাগাছার মণ্ডা!
আবদুল্লাহ আল মারুফ, ময়মনসিংহ থেকে ফিরে।।
গোপাল পাল। স্বপ্নে এক মিষ্টান্ন তৈরির রেসিপি সম্পর্কে জানতে পারেন। পরে তা বানিয়ে খাওয়ান স্থানীয় জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীকে। কালক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে। প্রচলিত এ গল্প ২০০ বছর আগের। এ ইতিহাস ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মণ্ডার। বর্তমানে এই মণ্ডার স্বাদ বিলিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্ন দেখা সেই গোপাল পালের পঞ্চম উত্তরসূরী রবীন্দ্রনাথ পাল। ২০০ বছর পরেও স্বাদে অম্লান এই মিষ্টান্ন এখনও মুক্তাগাছার নাম জড়িয়ে রেখেছে। মণ্ডার প্রথম, প্রাচীন ও আসল দোকানের নাম গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকান।
সরেজমিনে দেখা যায়, নতুন দালানের সামনের ফটকে ছোট আকারে লেখা “গোপাল পালের প্রসিদ্ধ” আর বড় অক্ষরে লেখা “মণ্ডার দোকান”। নতুন সাইনবোর্ডের হলেও পুরোনো স্বাদ নিতে বেলার সঙ্গে ভিড়ও থাকে ১২ মাস। দোকানের প্রবেশ ফটকের বাঁ পাশে আছে একটি কাচের বক্স। এতে সাজানো একটি কাঠের প্রতিকৃতি। তিনি স্বপ্নে মণ্ডার রেসিপি পাওয়া গোপাল পাল। তিনিই প্রথম এই মিষ্টান্নের আবিষ্কার করেন। এই প্রতিকৃতিটির বক্সের গায়ে লেখা আছে, কাঠের তৈরি এই প্রতিকৃতিটি বাংলা ১৩০৯ সালে নির্মিত। এই প্রতিকৃতিটির সামনেই অনেক ক্রেতা মণ্ডার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন। ভিড় করা ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেউ ঢাকা আবার কেউ দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের বাসিন্দা। কেউবা বিদেশি। কেউ এসেছেন অনুষ্ঠানের জন্য নিতে, কেউ নিজে খাচ্ছেন আবার পরিবারের জন্যেও নিচ্ছেন। এই মণ্ডা কালে কালে পরিচিতির রয়েছে নানান কারণ।
মিষ্টান্ন বেশিরভাগ মানুষেরই পছন্দ। মুক্তাগাছার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মণ্ডা নামের এই মিষ্টান্নের নাম। যার কল্পনা করলেই নাকে আসবে ঘ্রাণ। জিভে আসবে জল। বলা চলে মুক্তাগাছার মণ্ডার সুখ্যাতি শোনেননি, এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। তবে এই সুনামের সাথে আছে নকল মণ্ডাও। মুক্তাগাছা সদর থেকে গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকানে যেতে চোখে পড়বে পুরোনো দালান। এসব পুরোনো দালানের কয়েকটিতে মণ্ডা বিক্রি হয়। নামের সামান্য তারতম্য করেই এসব দোকান গড়ে উঠেছে। সব গুলোই মণ্ডার দোকান। কিন্তু এসব মণ্ডার দোকান ডিঙিয়ে সামনে গেলেই চোখে পড়বে আসল স্বাদের পসরা।
দোকানের মালিক রবীন্দ্রনাথ পাল বলেন, ১৮২৪ সালে দোকানটি প্রতিষ্ঠিত। মণ্ডা তৈরির পদ্ধতি যুগ যুগ ধরে গোপন। কোথাও মুক্তাগাছার মণ্ডা তৈরির পদ্ধতি আপনি পাবেন না। প্রকৃতপক্ষে আমরা দুধকে জাল দিয়ে ছানা করি। ছানা থেকে চিনির মিশ্রণে করা হয় মণ্ডা। যুগ যুগ ধরে এটাই চলে আসছে। তবে একটা ব্যাপার হলো আমরা এই দুধ থেকে ছানা ও পরে চিনির মিশ্রণের মধ্যে কিছু কাজ করি যা কেউ জানে না। যেমন একটা নির্দিষ্ট সময় ও নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ব্যবহার করি। আরও কিছু বিষয় থাকে যার কারণে এই মণ্ডা ইউনিক ও স্বাদে অম্লান। মণ্ডার স্বাদ মিষ্টি। তবে তা বেশি মিষ্টি নয় বা কমও নয়।
তিনি আরও বলেন, মণ্ডার সুনাম দেখে অনেকেই নকল করতে চেয়েছেন। কিন্তু আসল মণ্ডার দোকান স্থানীয়রা চেনেন। আগে অনেকে ভুল করলেও এখন তেমন ভুল করেন না।
রবীন্দ্রনাথ পাল বলেন, ময়মনসিংহ নয় সারা বাংলাদেশের কোথাও মুক্তাগাছার গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকানের বা আমাদের মণ্ডার কোন শাখা নেই। কোন এজেন্ট, শোরুম, বিক্রয়কেন্দ্র বা বিক্রয় প্রতিনিধিতো বহু দূরের কথা। আসল ম-ার শুধু আমাদের এই দোকানেই পাওয়া যাবে। আপনি খেয়ে বাড়িও নিয়ে যেতে পারবেন।
ঢাকা থেকে মণ্ডা নিতে আসা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, খেতে একটু ভিন্ন স্বাদ। এসেই একটা খেয়ে চারটা খেয়েছি। অফিসের বস ১৩ কেজি নেয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। আমি নিজের জন্যেও তিন কেজি নিয়েছি।
শেরপুর জেলার নালিতা বাড়ি থানা থেকে আসা জামাল হোসেন বলেন, এসে তিনটা খেয়েছি। খুবই ভালো লেগেছে। এর আগে শুনেছি কিন্তু আসা হয়নি। পরিবারের জন্যেও নিয়েছি।
রবীন্দ্রনাথ পাল জানিয়েছেন, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেনের মতো রাজনীতিকদের পাশাপাশি চলচ্চিত্র জগতের রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন, সোহেল রানা, বুলবুল আহমেদ, কবরী, শাবানা, ববিতাসহ দেশি বিদেশি পর্যটকরা এখানের মণ্ডা খেয়েছেন। দোকানে বসে খেয়ে সুনাম করেছেন। এখনও অনেকে আসেন। মণ্ডা নিয়ে যান। সরকারি বেসরকারি সংস্থা আমাদের সম্মানিত করেছে। এগুলো আমাদের অনুপ্রেরণা।