আমাদের নাগরিক দায়বদ্ধতা

।। মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী ।।

inside post

সমাজে বসবাস করতে গেলে নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হওয়া খুবই জরুরি। সেবা দাতা ও সেবা গ্রহীতা নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকেরই নিজস্ব দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। সেবা গ্রহণের বিপরীতে আমি যদি কাংখিত আচরণ না করি তাহলে সমাজে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়বে। আমরা যারা নিজেদের সচেতন নাগরিক হিসেবে মনে করি তাদের করণীয় কি সে তালিকা প্রদান করা আমার আজকের লেখার প্রতিপাদ্য নয়। আমার লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা যা আমরা কেন যেন গুরুত্ব নিয়ে ভাবছি না বা করছি না। কিন্তু প্রতিদিনই এ ঘটনাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছি এবং বিরক্ত কিংবা বিব্রত হচ্ছি।

শব্দ দূষণ কিংবা অযথা হর্ন বাজানোঃ
পথ চলতে গিয়ে পথচারীদের কিংবা অন্য বাহনের চালকদের সচেতন করার লক্ষ্যে হর্ন বাজানো কোন অন্যায় নয়। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে আমরা পথ চলতে গিয়ে এমন কিছু হর্ন বা শব্দ দূষণের মুখোমুখি হই যার আসলে কোন প্রয়োজন নেই এবং যা ইচ্ছে করলেই এড়ানো যায়। শব্দ দূষণ আমাদের দৈনন্দিন যাপিত জীবনে কি ধরণের স্বাস্থ্যগত/মানসিক ক্ষতি’র কারণ হচ্ছে। সে বিষয়ে আমরা একেবারেই সচেতন নই এবং এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে তেমন কোন কার্যক্রমও চালানো হচ্ছে না ।

ফুটপাথে দোকানের পসরা সাজানোঃ
ফুটপাথে চলতে গিয়ে খুব সাবলীলভাবে হেঁটে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় কেউ যেতে পারেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। কিছুদূর হাঁটলেই দেখা যায় কোন কোন দোকানের বিক্রয় সামগ্রী পথে বিছিয়ে রাখার কারণে ফুটপাথ ছেড়ে আপনাকে পথে নামতে হচ্ছে। এর থেকেও বিড়ম্বনা হলো যখন হাঁটতে গিয়ে অসাবধানতাবশতঃ কোন দোকানের পণ্যসামগ্রী (যা অবৈধভাবে ফুটপাথে রাখা হয়েছে) আপনার হাতে বা পা’য়ে লেগে পড়ে যায়। তখন দোকানির বিরক্তি বা কটুকথা শুনতে হয় কখনও কখনও তার চেয়েও খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। অথচ দোকানের মালামাল দোকানের সীমানার মধ্যে থাকলে খুব সহজে এ বিড়ম্বনা এড়ানো যেতে পারে। দোকানের যারা মালিক তারাও নিশ্চয়ই নিজেদের সচেতন নাগরিক দাবি করেন। তিনি নিজে থেকে এ কাজটা করে পথচারীদের স্বস্তির ব্যবস্থা করতে পারেন।

রাস্তা পারাপারে সহায়তা প্রদানঃ
যে কোন পথ-ই বানানো হয় পথচারীদের রাস্তা চলাচল বা পারাপারে সুবিধা প্রদানের জন্য। আমরা যারা এ শহরে পায়ে হেঁটে পথ চলতে উদ্যোগ নেই তাদেরকে প্রায়শই বিড়ম্বনার মুখোমোখি হতে হয়। এমনও দেখা যায় প্রায় ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও রাস্তার এক পাশ হতে অন্যপাশে যাওয়ার সুযোগ মিলে না। বাহনগুলো একটির সাথে অন্যটি এমনভাবে লেগে থাকে যে একজন বয়স্ক পথচারী বা স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীদের রাস্তার এক পাশ হতে অন্যপাশে যাওয়ার সুযোগ পেতে কষ্ট হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোকে জেব্রা ক্রসিং দাগান্বিত করে একটি নির্দ্দিষ্ট সময় পর পর (০৫ মিনিট/১০ মিনিট) ০১ মিনিট করে রাস্তা পারাপারের সুযোগ করে দেয়ার ব্যবস্থা করা গেলে পথচারীদের রাস্তা পারাপারে সুবিধা হতো। এটিও কিন্তু খুব কঠিন কোন কাজ নয় দরকার যথাযথ কর্তৃপক্ষের কার্যকর উদ্যোগ এবং নাগরিকদের সচেতনতা।

বিরক্তকর পোস্টার-ব্যানারের ছড়াছড়িঃ
ইদানিং শহরের আনাচে-কানাচে দেয়ালে, লাইটপোস্ট, মার্কেট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা অফিস সর্বত্রই বিভিন্ন ধরণের পোস্টার, ব্যানার ও স্টিকারের ছড়াছড়ি লক্ষ করা যায়। যেখানে একটি পোস্টার লাগালেই চলে সেখানে দেখা যায় একই বিষয়ের অনেকগুলো ব্যানার বা পোস্টার সাজানো হচ্ছে। এমনকি ব্যক্তিগত গাড়ি কোথাও পার্ক করলে তার গ্লাসে স্টিকার লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। পোস্টারগুলো একদিকে যেমন শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করে, অন্যদিকে পরবর্তীতে এগুলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপর চাপ তৈরি করছে। অন্যের বাড়ির দেয়াল কিংবা অফিসের দেয়াল পোস্টার/ব্যানার লাগানো নীতিগত ভাবেও ঠিক নয়। পোস্টারের আধিক্য শহরের সৌন্দর্যকে মলিন করে দেয়। পোস্টার/ব্যানার/স্টিকার লাগানোর জায়গা নির্দিষ্ট করে দিলে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে বলে মনে করি।

ময়লা ফেলার ক্ষেত্রে সচেতন হওয়াঃ
নাগরিকদের প্রতিদিনের যাপিত জীবনের অনুসংগ হিসেবে ময়লা বা অবর্জনার উৎপত্তি হয়। এ ময়লা ঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা না গেলে এটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই হুমকিস্বরুপ হয়ে দাঁড়ায়। সময়ের সাথে মানুষের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন যেমন এসেছে তেমনি ময়লার ধরণ ও পরিমাণও বেড়েছে। এসব ময়লার কোন কোনটি আবার কোনভাবেই প্রকৃতির সাথে মিশে যায় না। তাছাড়া মেডিকেল বর্জ্যরে পরিমাণও এখন অনেক বেড়েছে। এ ধরণের ময়লার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নাগরিকদের সচেতনতা খুবই জরুরি। এখন অনেক এলাকাতেই ভ্যানে করে ময়লা সংগ্রহের ব্যবস্থা আছে। এটিকে কিভাবে আরো পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্য ঝুকিমুক্ত ভাবে কাজে লাগানো যায় সেটি ভেবে দেখা যেতে পারে।

ডেন পরিস্কার রাখার উদ্যোগ গ্রহণঃ
আমাদের সবারই বাসার আশেপাশেই ড্রেন রয়েছে। এ ড্রেনগুলোর মাধ্যমে আমাদের বাসার ব্যবহৃত পানি, বৃষ্টির পানি ইত্যাদি নিস্কাশন হয়ে থাকে। এ ড্রেনগুলো পরিস্কার রাখা বাড়ির পরিবেশ এবং বাড়ির মানুষের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য খবই জরুরি বিষয়। কিন্তু ইদানীং বড় বড় এ্যাপার্টমেন্টগুলোর কোন কোন বাসিন্দাদের উপর থেকে ময়লা/পলিথিন/কাগজ/টিস্যু/টি ব্যাগ/একবার ব্যবহার্য জিনিসপত্রাদি নীচের দিকে ফেলার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। রাস্তার দু’পাশে গড়ে উঠা দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আশপাশ পরিস্কার করে ময়লা ড্রেনে ফেলা হচ্ছে। এতে করে ড্রেণের পানি চলাচলে বিঘ্ন ঘটে, মশার বংশ বিস্তার ঘটে। অথচ আমরা একটু সচেতন হলেই এ দুরাবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারি। বাড়ির গৃহকর্মীদেরও এ বিষয়ে সচেতন করা প্রয়োজন। বাড়ির আশেপাশের পরিবেশ ও ড্রেন পরিস্কার রাখার প্রাথমিক পদক্ষেপ নিজেদেরই নিতে হবে। বেশি প্রয়োজনীয় মনে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সহায়তা নিতে হবে।

 

পাদটিকাঃ
আমরা সবাই ভাল থাকতে চাই, সুস্থ থাকতে চাই। ভাল থাকার জন্য, সুস্থ্ থাকার জন্য সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। আমি শুধু আরাম করবো, অন্যরা আমার জন্য আরাম করার প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করে দেবে-এরকম ভাবার অবকাশ নেই। আমরা প্রত্যেকে যদি নিজেদের অবস্থান থেকে ছোট ছোট অথচ কার্যকর ভূমিকা রাখি তাহলে সার্বিকভাবে সবার ভাল লাগার পরিবেশটা নিশ্চিত হবে। উপরের কয়েকটি বিষয় উদাহরণ হিসেবে টেনে আনা হয়েছে। এগুলো ছাড়াও আরো অনেক বিষয় রয়েছে (যেমন-নির্দ্দিষ্ট স্থানে ধূমপান করা, যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ না করা, গাড়ি পার্কিং-এর ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া ইত্যাদি) যেগুলো খুব সহজে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এবং একটি বসবাসযোগ্য সুস্থ পরিবেশ গড়ে তুলতে পারি। দেরী না করে চেষ্টাটা শুরু করি আজ থেকেই। শুভকামনা নিরন্তর।

লেখকঃ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।

আরো পড়ুন