প্লাবন ভূমিতে মৎস্য চাষ করে স্বাবলম্বী রহমত আলী

মোতাহার হোসেন মাহবুব।।

inside post

কর্মই মানুষের প্রধান পরিচয়। ইতিবাচক কাজ তথা সমাজ সেবামূলক কাজ করে মানুষ যেমন নিজে প্রতিষ্ঠিত হয় তেমনি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে তাঁদের ভূমিকাও প্রশংসিত হন। রহমত সেই প্রশংসিতের একজন। কে এই রহমত? সামান্য পড়ুয়া কৃষকের ছেলে রহমত একজন সফল মৎস্য খামারী। দাউদকান্দির সিংগুলা গ্রামের মোহাম্মদ রহমত আলী। দৃঢ় মনোবল আর কঠোর পরিশ্রমে দারিদ্রতাকে পরাজিত করে আজ তিনি দাউদকান্দি তথা কুমিল্লাসহ দেশের বেকার হতাশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কাছে এক অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত। মাছ চাষের স্বীকৃতি হিসেবে জানা যায়, দাউদকান্দি উপজেলার ৭নং ইলিয়টগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের সিংগুলা গ্রামের মরহুম নায়েব আলী মিয়া ও জমিলা বেগমের তৃতীয় পুত্র রহমত। ২০০১ সালে ঈদের দিনে মৃত্যুবরণ করেন নায়েব আলী। তখন রহমতের বয়স ১৬ বৎসর। তখন বাবার কৃষিকাজের আয়ের উপর বড় ২ ভাইয়ের মধ্যে ২য় জনও লেখাপড়া করেন। বড় ভাই বাবাকে কৃষিকাজে সহায়তা করে। ঘরে ৪টি বোন ও ৪টি ভাইয়ের ভরণপোষণ ও লেখাপড়া করানো তখন নায়েব আলি মিয়ার পক্ষে সম্ভব পর নয়। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তখন এস এস সি পাস করে চিন্তার ভাজ পড়ে কপালে, কোনরকমে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়ে আর এগুতে পারে নি রহমত। বাবার অনুস্থিতিতে তার উপর পড়ে সংসারের দায়িত্ব। সিংগুলা অঞ্চলটি নীচু অঞ্চল হওয়াতে বাবার পেশা কৃষিকাজ করে সংসার চালানো অসম্ভব। তখন দাউদকান্দিতে সমাজভিত্তিক প্লাবন ভূমিতে মৎস্যচাষ শুরু হয়। তখন রহমত সততা প্লাবন ভূমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। অভাব তাকে চেপে ধরলেও জীবন সংগ্রামে হাল ছাড়েন নি রহমত। মায়ের কানের দুল বিক্রি করে মা তাকে ৮ হাজার টাকা দেন। এ টাকায় হালদা থেকে রেনু এনে রায়পুরের স্কুলের পাশে হিন্দু ভদ্রলোকের পরিত্যক্ত একটি পুকুরে চাষ শুরু করেন। পাশাপাশি প্রতিদিনই মাছের পোনা ও রেনু গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্লাবন ভূমিতে বিক্রি করতেন।
এভাবে একসময় রহমত আস্তে আস্তে প্রায় ১৫ হাজার টাকার মালিক হন। এই ১৫ হাজার টাকা দিয়ে ২০০০-২০০১ সাল থেকে রহমত দাউদকান্দি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ছোট-বড় দিঘি, পুকুর ইজারা নিয়ে প্রথমে নার্সারিতে পোনা উৎপাদন পোনা বিক্রির পরে মাছ চাষ শুরু করেন। এ সময়ে তার উপার্জন বেশ বাড়ে। পরে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রহমত ফিসারিজ প্লাবন ভূমিতে মাছ চাষ খামার। ওই খামারের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন স্থানে মাছ ও মাছের পোনা সরবরাহ শুরু করেন। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। এভাবে ঘুরে যায় তার ভাগ্যের চাকা। দূর হয় দারিদ্রতা। বর্তমানে তিনি ২১টি খামারে মাছ চাষ করেন। এর মধ্যে ৩টি প্লাবন ভূমি, ৩টি দিঘি, ২১টি পুকুর। স্ত্রী কুলসুম সরকার ও ২ মেয়ে ১ ছেলে নিয়ে এখন তার সুখের সংসার।
রহমত বলেন, কোন কাজই ছোট নয়। কঠোর পরিশ্রম আর যে কোন ক্ষুদ্র পথ ধরেই সততাপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেয়া যায়। শুধু দিন মজুর নয়, যে কোন কাজ করেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তনসহ দেশ ও সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখা যায়। তিনি আরো বলেন, আমি লেখাপড়া করতে পারি নাই অভাবের কারণে। এ ব্যাপারে নিজেকে এখন ছোট মনে হয়। পরিবারের কেউ যেন আমার মত নিম্নশিক্ষিত না থাকে এ জন্য সন্তানদেরকে স্কুলে, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।
উল্লেখ্য, স্বাবলম্বী মাছচাষি রহমত ২০১৪, ২০২৩ সালে উপজেলা ও জেলা থেকে জাতীয় মৎস্য পদক লাভ করেন। বর্তমানে রহমত রায়পুর কেসি সাহা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। একটি মসজিদেরও সভাপতি। সততা, জিকে, আরডিবি ও বন্ধন প্লাবন ভূমির শেয়ার মালিক এবং রহমত ফিসারিজ প্লাবন ভূমিতে মাছচাষ প্রকল্পের স্বত্ত্বাধিকারী। বর্তমানে রহমত ৯৫ বিঘা জমির মালিক। প্লাবন ভূমি, দিঘি, পুকুরসহ ২৭টি জলাশয়ে, ২১.০০ হেক্টর জমিতে, ১৮.০০ হেক্টর জলায়তনে ২০২৪ উৎপাদন বৎসরে ২৮৮.৮২ মে. টন মাছ উৎপাদন করেন। পূর্বে রহমতের টিনের ঘর ছিল, বর্তমানে ৫ তলা ফাউ-েশন বিল্ডিং। ৪ বোনকে ভালো পরিবারে বিবাহ দিয়েছেন, অন্য ৩ ভাইয়ের মধ্যে ১ জন শিক্ষক। ১ জনকে নিজ খরচে ইউরোপ পাঠিয়েছেন। ভাইবোনসহ ৪ জনকে নিজ খরচে বিদেশ পাঠিয়েছেন। অন্যান্য ভাইয়েরাও পাকা বাড়িতে আলাদাভাবে বসবাস করে। জনগণের স্বার্থে নিজ খরচে একটি পাকা রাস্তাও তৈরি করে দিয়েছেন।
জানা যায়, রহমতের বর্তমান নিজস্ব তহবিল ২ কোটি ৫৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণ ২০ লাখ টাকা। বলা যায়, রহমত এখন শুধু আর্থিকভাবে স্বাবলম্বীই নয় কোটিপতিও বটে। কঠোর পরিশ্রম ও ন্যায়নিষ্ঠতার মাধ্যমে তাঁর এ আর্থিক সফলতা অনুকরণীয়।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক।

 

আরো পড়ুন