গরুটার চোখে পানি ছিল

সাইফুল ইসলাম সুমন ।।
ঈদের আর মাত্র চার দিন বাকি। বিকেলে কোরবানির জন্য গরু কিনতে যাবেন দাদা, বাবা এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা। আমাদের পাশের বাজার দারাশাহী তুলপাই। সেখানে যাবার প্রস্তুতি চলছে। তখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি।
চুপিচুপি দাদার কাছে গিয়ে বললাম,
দাদা, আমি তোমাদের সাথে গরু দেখতে যাব।
দাদা হেসে বললেন,
– তুই বাজারে গেলে গরু সিং দিয়ে গুতা দিবে, পা দিয়ে লাথি দিবে, তখন কি করবি?
আমি সাহস করে বললাম,
– না দাদা, গরু আমাকে কিছু করবে না। আমি যাবই।
বাজারে যাওয়ার জন্য সবার প্রস্তুতি চলছে। আমি যেতে চাই শুনে বাবা রেগে গেলেন, চোখ লাল হয়ে উঠল। ভয় পেয়ে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা বললেন,
– সুমন বাজারে গেলে আমরা গরু দেখব, না তাকে সামলাবো?
তখন দাদা বললেন,
– সুমন আমার সঙ্গে থাকবে, আর আজকে ওর পছন্দেই গরু কিনব।
আমি তো খুশিতে আত্মহারা! মাত্র দুই মিনিটে রেডি হয়ে গেলাম। আমাদের বাড়ি থেকে গরুর হাট প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। আমরা হেঁটে হেঁটেই রওনা দিলাম।
বাজারে গিয়ে দেখি স্কুল মাঠ ভর্তি হাজার হাজার গরু! বড় বড় শিংওয়ালা গরুগুলো দেখতে বেশ লাগছে। গরু বাঁধার জন্য বাঁশ দিয়ে সুন্দর করে সিরিয়াল করা, যাতে লোকজন নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে। তাই দাদার বলা সেই শিং দিয়ে গুতা খাওয়ার ভয়টা আর থাকল না।
দাদা বললেন,
– সুমন, তোর কোন গরুটা ভালো লাগে বল।
চারদিকে গরুর চিৎকার আর মানুষের হট্টগোল। কিছুক্ষণ ঘুরে আমার চোখে পড়ল একটা লালচে বাদামি রঙের গরু। চোখ, গলা, পা। সবই সুন্দর ও মজবুত। পুরো বাজার ঘুরেও ওটার মতো আর কিছু চোখে পড়ল না। সবাই মিলে ওটাকেই পছন্দ করলাম।
গরু কেনা হয়ে গেল। আমি খুবই খুশি! দাদা আমার খুশি দেখে আইসক্রিম, ঝালমুড়িসহ আরও অনেক কিছু কিনে খাওয়ালেন। বাবাকেও দেখলাম মুখে হাসি।
গরু নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরলাম। দাদি, মা, ভাই-বোন। সবাই গরু দেখে খুশি। আমি তো কাস্তে আর ঝুড়ি নিয়ে ঘাস কাটতে ছুটে গেলাম আনন্দে। পরবর্তী চার দিন গরুর দেখভালে আমি নিজেকে ব্যস্ত রাখলাম। গরুর খাওয়া, বসা, হাঁটা। সব কিছুতেই আমার আগ্রহ।
ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, গরুর চোখে পানি। যেন মুখটা ভিজে গেছে। দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– দাদা, গরু কান্না করছে কেন?
দাদা বললেন,
– আজকে তো কোরবানি দেওয়া হবে। গরু স্বপ্নে ছুরি দেখেছে, তাই কান্না করছে।
ছুরি দেখার বিষয়টা কতটা সত্যি জানি না, তবে আমার মনটা ভার হয়ে গেল।
ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে বাবা গরুকে গোসল করিয়ে দিয়েছেন। নামাজ শেষে ফিরে এসে দেখি গরুটা আরও সুন্দর লাগছে, কিন্তু সামনে ঘাস থাকা সত্ত্বেও খাচ্ছে না। আমি গরুর পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর বড় ভাই গরুকে রাস্তার পাশে নিয়ে গেল। আমিও পিছু পিছু গেলাম। সেখানে সবাই মিলে গরুর পা বেঁধে ধরল। হুজুর এসে “আল্লাহু আকবার বলে গরুকে জবাই করলেন।
গরুর কোরবানি ও রক্ত দেখে আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম। কী পরিমাণ কষ্ট অনুভব করেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সবাই যখন গরুর মাংস কাটছিল, আমি মন খারাপ করে ঘরে বসে রইলাম।
আজ বড় হয়ে বুঝি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রিয় বস্তুকে কোরবানি দেওয়াটাই ঈদের আসল তাৎপর্য।

লেখক:সভাপতি, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ সাংবাদিক সমিতি।