জাতিসংঘের কার্যকারিতা ও ট্রাম্পের সমালোচনা

 

মনোয়ার হোসেন রতন।।

শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে ১৯৪৫ সালে গঠিত জাতিসংঘ (United Nations) সময়ের পরিক্রমায় বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক সময়ের সংঘাত ও সংকটের মুখে এর কার্যকারিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, “জাতিসংঘ শান্তি প্রতিষ্ঠায় সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর।” তার এমন বক্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেমন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, তেমনি জাতিসংঘের ভূমিকা, সীমাবদ্ধতা ও ভবিষ্যৎ গতিপথ নিয়েও নতুন করে ভাবার অবকাশ তৈরি করেছে।

ট্রাম্পের বক্তব্য: সরাসরি আক্রমণ না রাজনৈতিক কৌশল?

২০২৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের বিতর্ক পর্বে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, “জাতিসংঘের অসাধারণ সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু এটি সেই সম্ভাবনার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি।” তিনি আরও দাবি করেন যে, তার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র সাতটি যুদ্ধ থামিয়েছে, অথচ এসব ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কোনো সহযোগিতা করেনি। ট্রাম্প এমনও বলেন, “জাতিসংঘ থেকে আমি শুধু একটি ভাঙা এসকেলেটর আর একটি ভাঙা টেলিপ্রম্পটার পেয়েছি।”

ট্রাম্পের বক্তব্যে ব্যঙ্গের ছাপ স্পষ্ট হলেও বিষয়টি নিছক হাস্যরসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর মাধ্যমে তিনি একটি শক্ত বার্তা দিতে চেয়েছেন— আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতিসংঘ তার উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতায় ব্যর্থ হয়েছে।

জাতিসংঘের ভূমিকা ও বাস্তবতা

জাতিসংঘের মূল লক্ষ্য শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন সহায়তা এবং বৈশ্বিক ঐক্য রক্ষা। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, কিছু ক্ষেত্রে জাতিসংঘ সফল হলেও অনেক সময়ই এটি ছিল ক্ষমতার রাজনীতির বলি

১. শান্তিরক্ষা মিশনে সীমিত সাফল্য

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধ বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কঙ্গো, সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, দক্ষিণ সুদানসহ বহু দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা সংঘাত নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে রুয়ান্ডা গণহত্যা, সিরিয়া যুদ্ধ কিংবা গাজা সংকটের মতো ইস্যুতে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা, যেখানে পাঁচ স্থায়ী সদস্য (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স) নিজেদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত আটকে দিতে পারে।

২. মানবাধিকার ও উন্নয়ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি

ইউনিসেফ, ইউএনডিপি, ডব্লিউএফপি, ইউএনএইচসিআর-এর মতো সংস্থাগুলো বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য হ্রাস, শিশু সুরক্ষা, অভিবাসী সহায়তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতেও জাতিসংঘের অবদান অনস্বীকার্য। তবু, অর্থায়নের ঘাটতি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সমন্বয়ের অভাব অনেক সময় কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

৩. জলবায়ু সংকটে নেতৃত্ব

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) বাস্তবায়নে জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে বড় শিল্পোন্নত দেশগুলোর অনীহা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ব্যর্থতা এখানেও জাতিসংঘকে বিপদে ফেলেছে।

ট্রাম্পের অভিযোগ: কতটা যৌক্তিক?

ট্রাম্পের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তার বক্তব্যের পেছনে আছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও প্রচারণা মনোভাব। যদিও তিনি নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, তবুও তার প্রশাসনেই মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়েছে, ন্যাটো ও প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন, এমনকি জাতিসংঘে অর্থায়ন বন্ধের হুমকি দিয়েছেন।

তার দাবিকৃত “সাতটি যুদ্ধ বন্ধ” করার তথ্য যথেষ্ট অস্পষ্ট। বাস্তবে, ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক মধ্যস্থতা ছিল স্বল্পমেয়াদী ও সীমিত প্রভাবসম্পন্ন। অনেক ক্ষেত্রেই তার কূটনৈতিক অবস্থান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে কেন্দ্রীভূত, বৈশ্বিক শান্তির আদর্শের বিপরীত।

বিশ্লেষকদের মতে, জাতিসংঘের “অকার্যকারিতা” বলার আগে বিবেচনায় নিতে হবে— জাতিসংঘ একটি প্ল্যাটফর্ম, সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ঐকমত্যে। তাই ব্যর্থতার দায় শুধু সংস্থার নয়, বরং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবই মূল প্রতিবন্ধক।

জাতিসংঘ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা

ট্রাম্পের বক্তব্যের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে— জাতিসংঘের বর্তমান কাঠামো সময়োপযোগী নয়। এটি সত্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতায় গঠিত এই সংগঠন ২১শ শতকের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পুরোপুরি প্রস্তুত নয়।

প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো হতে পারে:

  • নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ পুনর্বিন্যাস
  • ভেটো ক্ষমতার সংস্কার
  • স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি
  • উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর উচিত হবে এই সংস্কার দাবিকে সামনে আনা এবং কার্যকর জাতিসংঘ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও করণীয়

জাতিসংঘের মাধ্যমে বাংলাদেশ বহুবার আন্তর্জাতিক সহায়তা পেয়েছে— যেমন রোহিঙ্গা ইস্যু, উন্নয়ন সহায়তা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তহবিল সংগ্রহ, শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ ইত্যাদি। কাজেই, আমাদের জন্য জাতিসংঘ একটি জরুরি আন্তর্জাতিক কণ্ঠস্বর

তবে, কেবল সহায়তার ওপর নির্ভর না করে, বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘে আরও সক্রিয় কূটনীতি চালানো, সংস্থার কাঠামোগত সংস্কারে ভূমিকা রাখা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ন্যায়ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার পক্ষে সোচ্চার হওয়া।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা জাতিসংঘের সীমাবদ্ধতাগুলোকে সামনে এনেছে বটে, তবে একপেশে সমালোচনা করে জাতিসংঘের গুরুত্ব খাটো করা যায় না। এটি একটি বৈশ্বিক মঞ্চ, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার পথ খোঁজে। সংস্থাটির ব্যর্থতা যতটা না কাঠামোগত, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে।

বিশ্ব আজ এমন এক সংকটকালে রয়েছে— যেখানে যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন, বৈষম্য— এসব সমস্যা একক রাষ্ট্রের পক্ষে সমাধান করা অসম্ভব। তাই প্রয়োজন একটি কার্যকর, স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল এবং আধুনিক জাতিসংঘ। একে ধ্বংসের বদলে উন্নয়নের পথে নিতে পারলেই বিশ্ব পাবে প্রকৃত শান্তি ও ন্যায়ের ঠিকানা।

তথ্যসূত্র:

  1. Reuters – Trump blasts UN but backs it 100%
  2. The Guardian – Trump at UN General Assembly
  3. জাতিসংঘের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট: https://www.un.org
inside post
আরো পড়ুন