করোনায় আফ্রিকা মহাদেশের মৃত্যুহার এত কম কেন ?

আমোদ ডেস্ক।।
inside post
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফ্রিকায় কোভিড-১৯ মৃত্যুহার সম্পূর্ণ বাস্তবিক নয়। প্রায় ১.৩ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীর এই মহাদেশে টেস্টিং এর হার সবচেয়ে কম, এরফলে অনেক মৃত্যুই হিসেবে থাকছে না।

ভঙ্গুর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত টেস্টিং সুবিধা, জনাকীর্ণ বাসস্থান সহ নানা কারণে আফ্রিকা মহাদেশে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব শুরু হবার পর এর প্রভাব নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন বিশেষজ্ঞরা। করোনাভাইরাসের কারণে ইতোমধ্যেই বিপর্যস্ত অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে এশিয়া ও ইউরোপের ধনী দেশগুলোও।

প্লাজমা দিতে করোনা জয়ী কুমিল্লার ৫৬ জন পুলিশ সদস্য ঢাকায়
গত এপ্রিলে জাতিসংঘের একটি সংস্থা জানায়, যথাযথ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলেও এবছর ভাইরাসের কারণে ৩ লক্ষ আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে। মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে মহাদেশটিতে ১ লক্ষ ৯০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে।
এদিকে বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ এর ফলে মৃত্যু সংখ্যা ১ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেলেও আফ্রিকা মহাদেশের মৃত্যুহার এখনো অন্য মহাদেশের তুলনায় কম। মহাদেশটির ২.৪ শতাংশ। আক্রান্ত ১.৪ মিলিয়নে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৫ হাজার মানুষ। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ মহাদেশে মৃত্যুহার ২.৯ এবং ৪.৫ শতাংশ। ইতালি ও ব্রিটেনে মৃত্যুহার ১১.৬ ও ৯ শতাংশ। অন্যদিকে আফ্রিকা মহাদেশের ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় মৃত্যুহার যথাক্রমে ১.৬, ১.৯ এবং ২.৪ শতাংশ। আফ্রিকার অনেক দেশের হাসপাতালেই কোভিড আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমে আসছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফ্রিকায় কোভিড-১৯ মৃত্যুহার সম্পূর্ণ বাস্তবিক নয়। প্রায় ১.৩ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীর এই মহাদেশে টেস্টিং এর হার সবচেয়ে কম, এরফলে অনেক মৃত্যুই হিসেবে থাকছে না।
সাউথ আফ্রিকান মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের জুলাইয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, মে-জুলাই পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় স্বাভাবিক কারণে ১৭ হাজার অতিরিক্ত মৃত্যু হয়েছে, যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৫৯ শতাংশ বেশি। এর ফলে ধারণা করা হচ্ছে সরকারি হিসাবের চেয়ে মৃত্যুহার আরও বেশি, এই সংখ্যা ১৬ হাজারের অধিক বলা জানিয়েছেন গবেষকরা।
তথাপি, আফ্রিকা মহাদেশের মৃত্যুহার এখনো পূর্বের অনুমানের মতো শোচনীয় হয়নি। বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এর কারণ হিসেবে বেশ কিছু কারণ জানিয়েছেন।
মহাদেশটির অধিক তরুণ জনগোষ্ঠী এবং পূর্ববর্তী মহামারি থেকে প্রাপ্ত সচেতনতা এরমধ্যে অন্যতম। বিমানবন্দর ও অন্যান্য স্থানে নিজেদের নাগরিক ও বিদেশি পর্যটকদের সংস্পর্শে সংক্রমণ রোধের জন্য সময়ও বেশি পেয়েছে আফ্রিকান দেশগুলো। অনেক আফ্রিকান দেশে শিশুদের নিয়মিত যক্ষ্মার টিকা দেয়া কম মৃত্যুহারের সাথে সম্পর্কিত হবার সম্ভাবনার কথাও খতিয়ে দেখছেন অনেক বিজ্ঞানী।
এছাড়াও কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী অন্য করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর তুলনামূলক বেশি প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকান সংক্রামণ রোগ বিশেষজ্ঞ আবদুল করিম রয়টার্সকে জানান, ‘ এব্যাপারে অনেক আনুষঙ্গিক প্রমাণ আছে, তবে কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই।’
অন্যান্য মহাদেশগুলোর তুলনায় আফ্রিকায় কিছুটা দেরিতেই প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। ফলে হাসপাতাল ও মেডিক্যাল সরঞ্জাম প্রস্তুতকরণে সময় বেশি পায় আফ্রিকা। চিকিৎসা ব্যবস্থার নতুন পদ্ধতির ব্যবহারেও প্রস্তুত থাকায় সময় পায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আফ্রিকার আঞ্চলিক পরিচালক মাতশিদিসো মোয়েতি জানান, আফ্রিকা আফ্রিকার অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সীমাবদ্ধ হওয়ায় এবং দেশের মধ্যে যাতায়াত তুলনামূলক কঠিন হওয়াও এর অন্যতম কারণ।
২০১৩-১৬ সালে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ইবোলার মতো প্রাণঘাতি ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে, এবছরের শুরুতে বিশ্বজুড়ে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হবার পর দেশগুলোর কর্মকর্তারা সচেতনতামূলক ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেন। অনেক আফ্রিকান দেশ দ্রুত বিমানবন্দরে টেস্টিং চালু করাসহ অধিক আক্রান্ত দেশগুলোর সাথে বিমান চলাচল স্থগিত করে দেয়। সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক পরিধানের আদেশও জারি করে দ্রুতগতিতে।
কেনিয়ায় সংক্রমণ শুরু হবার প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়, বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের জন্য বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন জারি করা হয় এবং বৃহৎ জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়।
আফ্রিকার সর্বাধিক জনবহুল দেশ নাইজেরিয়ায় আন্তঃরাজ্য যাতায়াত নিষিদ্ধ কিরে কারফিউ জারি করা হয়। চোরাচালানের কারণে ২০১৯ সালের আগস্ট থেকেই দেশটির অনেক সীমান্ত বন্ধ থাকার ব্যাপারটিও সংক্রমণ রোধে সহায়ক হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪০০ হবার পরই বিশ্বের অন্যতম কঠিন মাত্রার লকডাউন জারি করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ এর গুরুতর উপসর্গের সাথে বয়সের সম্পর্ক আছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাহারা- নিম্ন আফ্রিকা অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ৬২ শতাংশই ২৫ বছরের কম বয়সী এবং মাত্র ৩ শতাংশের বয়স ৬৫ বা তার বেশি।
অন্যদিকে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার ২৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীর বয়স ২৫ বা তার কম এবং ১৮ শতাংশের বয়স ৬৫ বা তার অধিক।
আফ্রিকা মহাদেশে ব্যাপকভাবে যক্ষ্মার প্রতিষেধক বিসিজি ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রমের কারণে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রেও তা কিছুটা সুরক্ষা দিচ্ছে বলে মনে করছেন দক্ষিণ আফ্রিকা সহ অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীরা।
অন্যান্য ভাইরাসঘটিত ফুসফুসের রোগ থেকে সুরক্ষার ক্ষেত্রেও বিসিজি ভ্যাকসিন কার্যকর ভূমিকা রাখে। প্রোসিফিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স জার্নালের জুলাইয়ে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, ব্যাপকভাবে যক্ষ্মার টিকা প্রদান করা হয়েছে এমন দেশগুলোতে কোভিড-১৯ মৃত্যুহার তুলনামূলক কম।
করোনা প্রতিরোধে যা খাবেন

টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জ এর আঞ্চলিক পরিচালক টিম ব্রোমফিল্ড বলেছেন, “করোনা সংক্রমণে বয়স হচ্ছে সবচেয়ে ঝুকির বিষয়। আফ্রিকার তরুণ বয়সী জনগোষ্ঠী করোনা প্রতিরোধ করছে।”

তবে অধ্যাপক কারিম অবশ্য করোনা প্রতিরোধে মানুষের বয়সকে অত গুরুত্ব দিতে চাচ্ছেন না।

তিনি মনে করেন, “মহামারীর যাত্রাপথে পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তৈরি জয়। বিশ্লেষকরা এই মহাদেশের করোনা সাফল্যের পেছনে এখানকার জনসংখ্যার স্বাস্থ্য সক্ষমতাকে গুরুত্ব দিতে চাচ্ছেন না।”

মহামাহরী ছড়িয়ে পড়ার আগে কঠোরভাবে লকডাউন কার্যকর করার ফলে করোনা থাবা বসাতে পারেনি। জনগণকে মাস্ক পরা এবং অক্সিজেন সরবরাহ বিষয়ে মানুষকে পরিষ্কার ধারণা দেয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আরো ধারণা করা হচ্ছে, উষ্ণ আবহাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তবে অধ্যাপক কারিম সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, “এটা ভেবে খুশি হওয়ার কারণ নেই যে আফ্রিকার তার খারাপ সময় পার করে এসেছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, হয়তো যেকোন সময় ব্যাপকহারে মহামারী ছড়িয়ে পড়তে পারে।”

 

আরো পড়ুন