খালেদা জিয়া কি মাহাথির হতে পারেন?

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
রাজনীতি এমন এক খেলা, যেখানে “চূড়ান্ত পরাজয়” বলে কিছু নেই। যারা এক সময় ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন, সময়ের পরিক্রমায় তাদেরকে দেখা যায় রাজনৈতিক প্রান্তে। আবার ঠিক সেখান থেকেই কেউ কেউ ফিরে আসেন নতুন রূপে, নতুন লক্ষ্যে।
মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ এমনই এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। রাজনীতির ইতিহাসে তিনি নিজের দলবিরোধী অবস্থান নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এসে নজির সৃষ্টি করেন।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে: খালেদা জিয়া কি মাহাথিরের পথ অনুসরণ করে নিজের দল বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব অতিক্রম করে আবারও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কেন্দ্রে ফিরে আসতে পারেন?
মাহাথির মোহাম্মদ: ইতিহাস গড়ার উদাহরণ
২০১৮ সালে মাহাথির মোহাম্মদ যখন ৯২ বছর বয়সে মালয়েশিয়ার ক্ষমতায় ফিরে আসেন, তখন বিশ্ব রাজনীতি অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।
তিনি ছিলেন ইউনাইটেড মালয়জ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (UMNO)-এর দীর্ঘমেয়াদী নেতা। কিন্তু ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর, নিজেরই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ভেতরে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তিনি UMNO-র বিরোধী হন।
পরবর্তীতে তিনি Pakatan Harapan (আশার জোট) নামে একটি বিরোধী জোটের নেতৃত্ব দেন, যেখানে তার পুরনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আনোয়ার ইব্রাহিমের দলও যুক্ত ছিল। এই ঐতিহাসিক জোট ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয় এবং মাহাথির আবার প্রধানমন্ত্রী হন।
রেফারেন্স:
BBC News. (2018). Malaysia election: Mahathir Mohamad sworn in as PM
The Diplomat. Mahathir’s Political Resurrection: Malaysia’s Earthquake Election
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা: এক টালমাটাল প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে ২০২৪-এর পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমাগত অনিশ্চয়তার দিকে এগোচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবি ও সম্ভাব্য ‘নিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা’ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত।
বিশেষ করে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কেন্দ্র করে একটি ‘ট্রানজিশনাল অথরিটি’ গঠনের গুঞ্জন বিএনপির অভ্যন্তরেই মতপার্থক্যের জন্ম দিয়েছে।
বিএনপির বহু জ্যেষ্ঠ নেতা এই প্রস্তাবের পক্ষে মত দিলেও, দেখা যাচ্ছে, দলের ঐতিহ্যবাহী নীতিমালা ও নেতৃত্বের ধারাকে তারা অবজ্ঞা করছেন।
এই পরিস্থিতিতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যদি দলীয় অবস্থান থেকে ভিন্ন পথ বেছে নেন—যেমন মাহাথির করেছিলেন—তাহলে তা হবে একটি ইতিহাস গঠনের সম্ভাব্য সূচনা।
খালেদা জিয়ার বর্তমান প্রেক্ষাপট
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস তুমুল বৈচিত্র্যময়। ১৯৯১ থেকে শুরু করে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া, একাধিকবার কারাবরণ, রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হওয়া এবং শেষত আইনি ও স্বাস্থ্যগত জটিলতায় কার্যত গৃহবন্দি অবস্থায় থাকলেও—তার ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক ক্যারিশমা আজও অস্বীকার করার মতো নয়।
কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে—তিনি কি আদৌ এমন একটি রাজনৈতিক পটভূমি তৈরির সক্ষমতা রাখেন যেখানে নিজের দল বা জোটের চেনা গণ্ডির বাইরে গিয়ে এক নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলা সম্ভব?
মাহাথির বনাম খালেদা: তুলনামূলক বিশ্লেষণ
বিষয় মাহাথির মোহাম্মদ খালেদা জিয়া রাজনৈতিক পুনরাগমনবিরোধী জোট গঠন করে নিজ দলের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় ফেরেন সম্ভাব্যভাবে নিজ দলের বিরোধিতা করে বিকল্প জোট গঠনের উপযোগিতা স্বাস্থ্য ও বয়স ৯২ বছরেও সক্রিয় ও রাজনৈতিকভাবে চটপটে ৭৯ বছর বয়স, অসুস্থ ও সীমিত চলাফেরা জনপ্রিয়তা নিজের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের জন্য জনমনে গ্রহণযোগ্যতা দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, তবে বর্তমানে দলীয় সংকটের কারণে জনসংযোগ দুর্বল দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব নিজেই দল ছেড়ে বিরোধী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন দলের ভেতরেই দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, ইউনূস ইস্যুতে মতপার্থক্য স্পষ্ট
ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক চিত্র: সম্ভাব্য রূপরেখা
যদি বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিরোধ আরও গভীর হয়, এবং ট্রানজিশনাল সরকারে ইউনূস বা অন্য কারো নেতৃত্ব চূড়ান্ত হয়, সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়া দুটি পথ নিতে পারেন:
১. দলীয় ঐক্য বজায় রেখে আপসের রাস্তায় হাঁটা
২. নিজস্ব বিশ্বাস ও রাজনৈতিক নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিকল্প নেতৃত্বে অবস্থান গ্রহণ
দ্বিতীয় পথটি অবলম্বন করলেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সুযোগ তৈরি হবে।
মালয়েশিয়ার মাহাথিরের ইতিহাস এক প্রেরণার নাম, যিনি নিজ দলের সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করে আবার নেতৃত্বের আসনে বসেন।
বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার জন্য এমন সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে তার স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক অবস্থা এবং দলে ভেতরকার বিভক্তি—সব কিছু একত্রে বিচার করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
রাজনীতিতে এক মুহূর্তের সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারে ইতিহাসের ধারা। হয়তো বাংলাদেশের আগামী রাজনীতি অপেক্ষা করছে এমনই এক সিদ্ধান্তের জন্য।
তথ্যসূত্র ও রেফারেন্স:
The Diplomat. (2018). Mahathir’s Political Resurrection
The Economist. (2018). Malaysia’s astonishing election upset
The Daily Star, Prothom Alo (2024-2025): ড. ইউনূস ও ট্রানজিশনাল সরকার বিতর্ক
Al Jazeera Opinion (2024). Yunus in Bangladeshi politics: Neutrality or power play?
inside post
আরো পড়ুন