চার দশক আনন্দের ফেরিওয়ালা

মহিউদ্দিন মোল্লা।।
বাসা নগরীর পূর্ব মাথা নুরপুর। রিকশা বা অটো রিকশায় কম চড়েন। হাতে ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে হাঁটতে থাকেন। কখনও চলে যান বাগিচা গাঁও, কখনও অশোকতলা কিংবা পুরাতন চৌধুরীপাড়া। পথে পরিচিতজনদের মাঝে বই বিতরণ করেন। কেউ সম্মানি দেন,কেউ দেন না। এটা তার চার দশকের রুটিন। অনেকে কুমিল্লা নগরীতে তাকে বইয়ের ফেরিওয়ালা বলে জানেন। তিনি আমৃত্য এভাবেই চলতে চান। তিনি মোতাহার হোসেন মাহবুব। ১৯৫৮সালে তার জন্ম। তবে বয়স এখনও তাকে ছুঁতে পারেনি। নিজে বই লিখে ও সম্পাদনা করে মানুষের হাতে পৌঁছে দেন। ১৯৮১সাল থেকে সাহিত্য সংস্কৃতির ম্যাগাজিন ‘আপন’ প্রকাশনা করছেন। সমকালীন সময়ে এটি কুমিল্লা থেকে নিয়মিত দীর্ঘ সময় ধরে প্রকাশিত ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনটির দেশের ৩৮ জেলায় প্রচার রয়েছে। এতে লিখছেন কলকাতার লেখকরাও। তিনি লিখেছেন ১৩টি বই। তার বইয়ের অধিকাংশ স্বাধীনতা আন্দোলন,ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা। তার ম্যাগাজিনে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সাথে নবীনদেরও লেখা প্রকাশ করা হচ্ছে। তিনি তার ম্যাগাজিন ও নিজের লেখায় ইতিহাস ঐতিহ্যকে তুলে ধরে নতুন প্রজন্মকে সমৃদ্ধ অতীত সম্পর্কে ধারণা দেন। তিনি বিনয় সাহিত্য সংসদ নামের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। মোতাহার হোসেন মাহবুব পেশায় স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার। তিনি বই ও ম্যাগাজিন প্রকাশনার কাজ করতে গিয়ে নিজের পৈত্রিক জমি বিক্রি করেছেন। পরিবারের বিরাগভাজন হয়েছেন। ঢাকায় লেখা সংগ্রহ করতে গিয়ে টাকা ফুরিয়ে যায়। রেল স্টেশনে ঘুমিয়েছেন। একদিন চায়ের দোকানে ওয়েটারের কাজ করেছেন।

মোতাহার হোসেন মাহবুব বলেন,স্কুল জীবনে লেখার পোকা মাথায় ঢুকে। লিখে,প্রকাশ করে এবং বিতরণে আমি আনন্দ পাই। বলতে পারেন আমি আনন্দ ফেরি করি ফিরি। এখন মানুষ বই পড়তে চায় না, মোবাইল ফোন আর টিভিতে ডুবে থাকে। বই হাতে পৌঁছে দিলে, প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে অনেকে বই পড়েন। এসব কাজ করতে গিয়ে পরিবারে সময় দিতে পারিনি। বাইরে বই বিতরণের পর বাসায়ও সময় কাটে বই পড়া,লেখা আর প্রুফ দেখে। এসব করতে গিয়ে পৈত্রিক জায়গা জমি হাতছাড়া হয়েছে। ১৯৯৪সালে ম্যাগাজিন প্রকাশ করত গিয়ে অর্থ সংকট লাগে। তিন গন্ডা জমি ২০হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। সেই জমি এখন ২০লাখেরও বেশি দাম। বসত ভিটা ছাড়া কিছু নেই। লেখা সংগ্রহ করতে গিয়ে কত স্মৃতি। ১৯৮২সালের দিকে একজনের সাক্ষাতকার গ্রহণ করতে গিয়েছি। তখন মোবাইল ফোন ছিলো না। তিনি পরের দিন আসতে বললেন। এতো ফেরি পাড়ি দিয়ে বাসে ঢাকায় গিয়েছি। আবার আসতে ভাড়া লাগবে। তাই রাতে রেল স্টেশনে ঘুমিয়েছি। একবার গুলিস্থানের বিপরীতে এক হোটেলে উঠেছি। সাথে চাচাতো ভাই মনজুর। হোটেলে ব্যাগ রেখে বাইরে গেছি। এসে দেখি চোর ঢুকে ব্যাগের সব নিয়ে গেছে। সাহিত্যিক শহীদ আখন্দ ছিলেন বড় আমলা। তার সাহায্য নিয়ে হোটেল থেকে জরিমানা আদায় করে বাড়ি ফিরি। আরেকবার কাঙ্খিত লোকের জন্য অপেক্ষা করতে করতে থাকা ও খাওয়ায় টাকা শেষ। তখন কুমিল্লার বাস ভাড়া ছয় টাকা। সাথে আছে দুই টাকা। কমলাপুর রেল স্টেশনের বিপরীতে চা দোকানে দিনভর কাজ করে পাঁচ টাকা পেয়েছি। সেই টাকায় বাড়ি ফিরেছি। তবে তার বিনিময়ে মানুষের যে ভালোবাসা,সম্মান ও স্নেহ পেয়েছি,তা বর্ণনা করার মতো নয়।
তার স্ত্রী নাজমা বেগম বলেন, ১৯৮১সালে বিয়ে পর থেকে দেখছি বাইরে বই বিতরণ আর বাসায় বই পড়া ও লেখায় ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে পারিবারিক কাজের জন্য চাপ দিলে অভিমান করে বলেন,আমার কাজের মূল্য তুমি বুঝলে না। প্রথম দিকে বিরক্ত লাগলেও এখন সয়ে গেছে। ভাবি খারাপ কিছু তো করছে না।
কুমিল্লা ভিক্টারিয়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রবীণ শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরী বলেন, মোতাহার হোসেন মাহবুবকে দীর্ঘদিন থেকে চিনি। সাহিত্য সংস্কৃতির ম্যাগাজিন ‘আপন’ প্রকাশনা করছে চার দশক ধরে। সমকালীন সময়ে এটি কুমিল্লা থেকে নিয়মিত দীর্ঘ সময় ধরে প্রকাশিত হচ্ছে।
তার ম্যাগাজিনে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সাথে নবীনদেরও লেখা প্রকাশ করা হচ্ছে। তার ম্যাগাজিন ও নিজের লেখায় ইতিহাস ঐতিহ্যকে তুলে ধরে নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে। এই সৃজনশীল কাজ গুলো বাড়লে সমাজে অস্থিরতা কমবে। আমি তার সফলতা কামনা করছি।