ঝড়ের দিনে আনন্দ কুড়ানো

inside post

।। মো.মহিউদ্দিন আকাশ ।।

সংবাদ সম্মেলন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সংবাদই শুধু নয়,সাংবাদিকতা হতে হবে সকল বিষয়ে। সকল সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি সম্ভাবনাও তুলে ধরতে হবে। মহিউদ্দিন মোল্লা ভাইয়ের এমন নির্দেশনা। তাই রাইজিং জার্নালিস্ট ফোরাম কুমিল্লার সদস্যরা ইতিহাস,ঐতিহ্য,কৃষি, মৎস্য চাষসহ নানান স্থান পরিদর্শন ও সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করে।

রাইজিং জার্নালিস্ট ফোরাম কুমিল্লার নতুন সদস্য সাইফুল ইসলাম সুমন। তার আবদার তার নিজের উপজেলা কচুয়ার ঐতিহ্যবাহী স্থান আমাদের দেখাবে।

সুমনের আবদার মেটাতে কচুয়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী স্থান সমুহ পরিদর্শনের তারিখ নির্ধারণ হল ২৭ মে সোমবার।

২৬ তারিখ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১০ নম্বর  বিপদ সংকেত ঘোষণা। ঘূর্ণিঝড় রিমেল বাংলাদেশে আসছে।অথচ পরদিন সকাল ৭ টায় কুমিল্লা নগরীর ৭০ বছর বয়সী পত্রিকা ‘আমোদ’ অফিস থেকে কচুয়ার উদ্দেশ্য রওয়ানা হওয়ার কথা।

রাতের ঝড়ো হাওয়া আর সকালের রিমঝিম বৃষ্টির কারণে ঘুম ভাঙ্গল সকাল ৮ টায়। ভয়ে ভয়ে মহিউদ্দিন মোল্লা ভাইকে কল দিলাম।
ভাইয়া বললেন – বৃষ্টি পেয়ে ঘুম ভাঙ্গে না? রেডি হয়ে আসো আমোদে।

ফ্রেশ হয়ে রিমঝিম বৃষ্টিতেই আমোদে আসলাম। এক এক করে মোল্লা ভাই,মহসিন কবির ভাই,তৈয়বুর রহমান সোহেল ভাই ও অমিত মজুমদার আসলেন।
গাড়ি ছেড়েছে কচুয়ার উদ্দেশ্য। বাইরে বৃষ্টি, মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া। তবে গাড়ির ভিতর থেকে এমন পরিবেশ উপভোগ্য।
ইলিয়টগন্জ পেরিয়ে আদমপুর পুটিয়া গিয়ে থামল গাড়ি। রাস্তার পাশের গাছ যেন বাতাসের তালে তালে নেচে গেয়ে রিমেলের অবস্থান জানান দিচ্ছে। আমাদের সাথে সঙ্গী হলেন প্রকৃতি বন্ধু অধ্যাপক মতিন সৈকত। যিনি প্রধানমন্ত্রী পদকসহ নানান সম্মাননায় ভূষিত।
আবারো চলতে শুরু করল গাড়ি। প্রাকৃতিক শীতল আবহাওয়ায় এমন প্রশান্তির জার্নি আমাদের খুব কমই হয়েছে।
চলতে চলতে আমরা কুমিল্লার সীমানা পেরিয়ে চাঁদপুরে প্রবেশ করলাম। রাস্তার দু’পাশে পানি থৈ থৈ করছে।
এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ‘রথ’ এর কাছে গিয়ে থামল গাড়ি। আমরা দেখলাম, জানলাম রথ সম্পর্কে। সাচার রথ ও জগন্নাথ ধাম প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথিত আছে যে, প্রায় দেড়শত বছর পুর্বে
সাচার বাবু বাড়ির জমিদার গঙ্গা গোবিন্দ সেন ভারতে হিন্দু তীর্থস্থান পুরীতে জগন্নাথ দর্শনে গেলে, জগন্নাথ গঙ্গা গোবিন্দকে দর্শন দেননি। বরং পুরীর দরজা-জানালা গুলো আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। দর্শন লাভে ব্যর্থ হয়ে পরম ধার্মিক গঙ্গা গোবিন্দ সেন দর্শন লাভের আশায় পুরীর বাইরে আমরণ অনশন শুরু করে দেন। অনশনের কয়েকদিন অতিবাহিত হলে গঙ্গা গোবিন্দ সেন স্বপ্নাদিষ্ট হন যে, এ স্থানে জগন্নাথ গঙ্গা গোবিন্দ সেনকে দর্শন না দিয়ে তার সাচারের বাড়ির সম্মুখের দিঘিতে ভাসমান নিম কাঠ আকৃতিতে দর্শন দিবেন। স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে গঙ্গা গোবিন্দ সেন নিজ বাড়ি ফিরে আসেন এবং ক’দিন পর উক্ত দিঘিতে স্নান করার সময় আকস্মিক ভাবে ভাসমান নিম কাঠ আকৃতিতে জগন্নাথ দর্শন লাভ করেন। সেই থেকেই এই কাঠের তৈরি বিশালাকৃতির রথ হয়ে উঠে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজনীয়।

তবে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রথটিকে ভেঙে জ্বালিয়ে দেয়।
স্বাধীনতার পর সেটিকে সংস্কার করা হয়। এখনো প্রতি বছরের বৈশাখ শেষে রথ যাত্রা করে। সেদিন কয়েক হাজার দর্শনার্থী ভিড় করে সাচার বাজারে।

মেঘদাইর থেকে মোটরসাইকেলে বৃষ্টিতে ভিজে আসেন সাইফুল ইসলাম সুমন, সাথে তার নিকট আত্নীয়।

পরে এলেন কচুয়ার নামী সাংবাদিক জিসান আহমেদ নান্নু। তার মিষ্টি,পেড়া আর সিঙ্গারার আপ্যায়ন অসাধারণ।

তারপর আমরা যাই পাথৈর রায় বাহাদুর শরৎচন্দ্র সেন চৌধুরীর জমিদার বাড়ি। প্রথমে বৃষ্টি কিছুটা সুযোগ দিলেও পরে শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি।

আমরা জমিদারের এ ভূতুড়ে বাড়িতে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনি  এ জমিদার বাড়ির ইতিহাস।

জমিদার শরৎ চন্দ্র সেন চৌধুরী ছিলেন এই বাড়ির নির্মাতা। দোল মন্দির, শিব মন্দির, দুর্গা মন্দিরসহ বিশাল এক দিঘি আছে জমিদার বাড়ির সামনে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় জমিজমা ও বিশাল সম্পত্তি রেখে ভারতে চলে যান জমিদার শরৎ চন্দ্র সেন চৌধুরী ও তার পরিবার। ওই সময়ের বাসিন্দাদের এমন কেউ ছিলো না যে তখনকার জমিদার রায় বাহাদুর শরৎ চন্দ্র চৗধুরীকে চিনতেন না।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জমিদার বাড়ি এখন পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। এখানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল দিঘি, মাঠ এবং কারুকার্য জমিদার বাড়ি। এই ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িটি অবহেলিত থাকলেও শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর আনাগোনা থাকে সব সময়। অথচ সংস্কারের মাধ্যমে এটা হতে পারে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র।
প্রায় ২শ বছর পূর্বে শরৎ চন্দ্র সেন চৌধুরীর হাত ধরে ইট, পাথর আর সুড়কির গাঁথুনিতে নির্মাণ করা হয় জমিদার বাড়িটি। বাড়ির মূল প্রবেশপথের পশ্চিম পাশেই রয়েছে একটি পুকুর। পুকুরটিতে রয়েছে সুন্দর একটি ঘাট। জমিদার বাড়িটি পুরানো হওয়ার কারণে বাড়ির চারদিকের পলেস্তরা খসে পড়ছে।

এরপর কচুয়া উপজেলা পরিষদ পরিদর্শন শেষে আমরা ভূঁইয়ারা (নয়াকান্দি) মনসার বাঁশ ঝাড় দেখতে যাই।  সেখানে পৌঁছতেই তুমুল বৃষ্টি।  মাথায় ছাতা নিয়ে এগুতে গিয়ে ছাতা উল্টে গিয়ে আমাদের ভিজিয়ে দিল। সেখানে রয়েছে বাঁশ ঝাড়। ছোট মন্দির।  বাঁশের কঞ্চিতে ছোট ছোট কাপড় ও কাগজ বাঁধা।

কথিত আছে, বেহুলা লক্ষীনধরকে নিয়ে ভেলায় করে উজান যাওয়ার সময় এ জায়গাতেই একটা বাঁশের কঞ্চি খসে পড়ে। আর সেখান থেকেই এ বাঁশ ঝাড়।  কেউ এখানের বাঁশ বা পাতা অথবা কঞ্চি নিলে সেটা সাপ হয়ে যায়।  এমন কথাও প্রচলিত রয়েছে।

সাইফুল সুমনের বাড়ি মনসার ঝাড়ের কাছাকাছি।  তার বাড়িতে গিয়ে শাক, সবজি, সু স্বাদু ভর্তাসহ প্রায় ১২/১৩ পদের লোভনীয় খাবারে ভূরিভোজ করে জমে বৃষ্টিময় আড্ডা।  সুমনের বাবার সহজ সরল হাসিমাখা আপ্যায়ন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার ভাই,ভগ্নিপতি ও পরিবারের সদস্যদের আপ্যায়ন দেখে মনে হল আমরা তাদের পরম আত্মীয়।
সুমনের পড়াশোনার হাতে খড়ি মেঘদাইর ফাজিল মাদ্রাসা। পুরনো এ মাদ্রাসা থেকে  পড়াশোনা করে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন অনেকেই।

মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার দিক থেকে পুরনো হলেও দেখতে চমৎকার।  মনোরম পরিবেশ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে।
মাদ্রাসার পাশেই কবরস্থানে শায়িত সাইফুল ইসলাম সুমনের মা ও ভাই। আমরা কবর জিয়ারত করে আনন্দ স্মৃতি হৃদয়ে নিয়ে ফিরলাম কুমিল্লার দিকে।

লেখক:সাধারণ সম্পাদক,রাইজিং জার্নালিস্ট ফোরাম কুমিল্লা।
আরো পড়ুন