ড. আখতার হামিদ খানের জন্মদিনে ভিক্টোরিয়া কলেজের শ্রদ্ধা

 

আজ ১৫ জুলাই বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা ,  কুমিল্লা পদ্ধতির জনক, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ৬ষ্ঠ অধ্যক্ষ ড. আখতার হামিদ খানের  জন্মবার্ষিকী । ১৯৫০ সালের ৩ জুলাই থেকে ১৯৫৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার জন্মদিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে ভিক্টোরিয়া কলেজ পরিবার।  আত্মার শান্তি কামনা করেছেন কলেজ বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. রুহুল আমিন ভূঁইয়া, উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মো. আবু জাফার খান, শিক্ষক পরিষদ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহজাহানসহ ভিক্টোরিয়া কলেজ পরিবার ।গণমাধ্যমকে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে ভিক্টোরিয়া কলেজ অধ্যক্ষ জানান।

যাদের আদর্শ ও সৃষ্টিশীল কর্ম অন্যকে অনুপ্রাণিত করে, নতুন করে বাঁচতে শেখায়, আলোকিত জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করে এবং সফল মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে তাদেরই একজন ড. আখতার হামিদ খান। দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তাঁর আবিষ্কার ‘কুমিল্লা পদ্ধতি’ একদিকে যেমন-দরিদ্র মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের সফল ভূমিকা রেখেছে, তেমনি তাকেও করেছে সুপ্রতিষ্ঠিত। দরিদ্র মোচনের দিশারী, আলোকিত জীবনের আলোকবর্তিকা, সফল কর্মীর হাত সৃষ্টিকারী, মানুষ গড়ার কারিগর এবং সুউচ্চ আর্কষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী সবার প্রিয় ব্যক্তিত্ব ড. আখতার হামিদ খানকে পল্লী উন্নয়নের রূপকার বলা মোটেই অত্যুক্তি হবে না।

 

ড. আখতার হামিদ খান ১৯১৪ সালের ১৫ জুলাই ভারতের উত্তর প্রদেশের বেরিলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৪ সাল থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের আগ্রার মিরাট ও বেরিলিতে কাটান। ড. আখতার হামিদ খান আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের উপর এম.এ পাস করেন। বিএ পাস করেন দর্শন ও ইতিহাস নিয়ে। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পান্ডিত্য অর্জন করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি তদানীন্তন ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে সম্মানিত সার্ভিস আইসিএস পাস করেন। আইসিএস পাস করার পর ১৯৩৬ সালে একদিন আইসিএস প্রবেশনার হিসাবে বিলাতে চলে যান। ১৯৩৯ সালে তার বিয়ে হয় তারই দীক্ষাগুরু আল্লামা মাশরেকীর মেয়ের সঙ্গে। ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি কুমিল্লায় ম্যাজিস্ট্রেট, তৎকালীন পশ্চিম বাংলার তমলুক ও পূর্ব বাংলার পটুয়াখালিতে তৎকালের সাব ডিভিশনাল অফিসার, নেত্রকোনায় রেভেনিউ ডেপুটি কালেক্টর, কলকাতা রেশনিং এর ডাইরেক্টর ইত্যাদি বিভিন্ন উচ্চ পদে চাকরি করেন। ১৯৪৩ সালে নেত্রকোনায় থাকাকালে দুর্ভিক্ষপীড়িত ক্ষুধার্ত মানুষের মাঝে তিনি ত্রাণ বিতরণ করলেন। এই সময় সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের ‘ড্যাভেইল পলিসি’ এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে তৎকালীন সময়ে আইসিএস এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজ জেলায় চলে যান। পরে তিনি শিল্প কারখানায় চাকরি নিলেন। একপর্যায়ে তাও ছেড়ে দিলেন এবং কিছুদিন তিনি তালাচাবি মেকারের কাজ করেছিলেন।

 

পরবর্তীতে ড. আখতার হামিদ খান দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া নামক এক মাদরাসায় চাকরি নেন। এখানে তিনি দর্শন ও হিন্দুশাস্ত্রের উপর জ্ঞান দিতেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্তির পর ১৪ আগস্ট তৎকালীন সরকার তাকে পাকিস্তানে পাঠালেন, দিল্লীর জামিয়া মিলিয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ লাভ করলেন ষাটের দশকে। আগের মতই কুমিল্লার জীবন ও মানুষকে তিনি সাদরে গ্রহণ করলেন। তৎকালীন সরকার ১৯৫৩ সালে আমেরিকার ‘ফোর্ড ফাউন্ডেশন’ এর সহযোগিতায় ভিলেজ এগ্রিকালচারাল এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ভি-এইড) নামে একটি কর্মসূচি কুমিল্লার কোতয়ালী থানায় চালু করেন। এই কর্মসূচি পরিচালনার জন্য ড. আখতার হামিদ খানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। কয়েক বৎসর তিনি দায়িত্ব পালন করলেন। ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ঢাকায় আসেন হার্ভাড এডভাইসরি গ্রুপ, ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অফিসারগণের সাথে প্রোগ্রাম করার জন্য। সভা বসলো তৎকালীন গবর্নর হাউসে। সভায় ড. আখতার হামিদ খান অফিসারদেরকে গ্রাম উন্নয়নের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দানের প্রস্তাব করলেন এতে প্রধানমন্ত্রী উৎসাহিত হলেন। সিদ্ধান্ত হলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লায় একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হবে। নাম হবে ‘পাকিস্তান একাডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’ (পার্ড)। একাডেমিটি প্রতিষ্ঠিত হবে পল্লী উন্নয়নের জন্য গবেষণা ও ভিলেজ-এইড প্রোগ্রাম, অন্যান্য জাতি গঠনমূলক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির প্রশাসনিক ও প্রভিন্সিয়াল সিভিল সার্ভিসের অফিসারগণকে পল্লী উন্নয়নের উপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য। প্রথমে কাজ শুরু হলো কুমিল্লা শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অভয়াশ্রমে। পরে ড. আখতার হামিদ খানের সক্রিয় প্রচেষ্টার ফলে স্থান মিলে ময়নামতি পাহাড়ের পাদদেশে ইতিহাস খ্যাত কোটবাড়ীতে। আমেরিকার ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও তৎকালীন পাকিস্তান গভর্নমেন্ট এর আর্থিক সহযোগিতায় ১৯৫৯ সালে ড. আখতার হামিদ খান অভয়াশ্রম ছেড়ে একাডেমিটি কোটবাড়ীতে প্রতিষ্ঠা করলেন। যার নাম দেয়া হল ‘‘বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি’’ (বার্ড)। ১৯৬৩ সালে পল্লী উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় ড. আখতার হামিদ খান ম্যাগসেসে পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তৎকালীন পাকিস্তানের সেনা বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার এসে ড. আখতার হামিদ খানকে সপরিবারে তুলে নিয়ে যায়। পাকিস্তানে গিয়ে তিনি দু’বৎসর ফয়সলাবাদ ও করাচি ইউনিভার্সিটিতে কাজ করেন। পরে শিক্ষকতার জন্য আমেরিকার মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে চলে যান। ফিরে আসার পর বিসিসিআই ফাউন্ডেশনের অধীনে ওরাংগির বস্তি এলাকায় একটি পাইলট প্রজেক্টে কাজ নেন। ১৯৭৭ সালে ড. আখতার হামিদ খান কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) এর ১৮তম প্রতিষ্ঠা বা©র্ষকীর নিমন্ত্রণে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট তাকে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করার নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। তিনি এখানে মাত্র সাত মাস কাজ করার পর চলে যান। ড.খান বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে তার গবেষণালব্ধ জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নিম্নলিখিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন যেগুলো এদেশের পল্লী উন্নয়নে এখনও মাইলফলক হয়ে আছে। যেমন : ১. পল্লী পূর্ত কর্মসূচি (RWP) ২. দ্বি-স্তর বিশিষ্ট সমবায় সমিতি (TTCA) ৩. থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র (TTDC) ৪. থানা সেচ কর্মসূচি (TIP) ৫. ইমাম প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ইত্যাদি। ড. খানের উপরিউক্ত কর্মসূচিগুলোর ব্যাপক সফলতার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার এগুলো সারাদেশে বিভিন্ন নামে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়, যেগুলো দ্বারা বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। যেমনঃ পল্লী পূর্ত কর্মসূচি এখন বাস্তবায়িত হচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর নামে, দ্বি-স্তর বিশিষ্ট সমবায় সমিতি বাস্তাবায়িত হচ্ছে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বার্ড) এর মাধ্যমে, থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র পরিণত হয়েছে উপজেলা পদ্ধতিতে, থানা সেচ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের মাধ্যমে এবং ইমাম প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৯৯৯ সালে ৯ অক্টোবর ড. আখতার হামিদ খান যুক্তরাষ্ট্রের হন্ডিয়ানা রাজ্যের এক হাসপাতালে কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেন। পল্লী উন্নয়নের রূপকার ড. আখতার হামিদ খান যে সকল অবদানগুলো রেখে গেছেন তা আজ সর্বসাধারণের নিকট চির অম্লান হয়ে রয়েছে।