তনু হত্যাকাণ্ড ও আমাদের সাংবাদিকতা

 

inside post

।। মাসুক আলতাফ চৌধুরী ।।
সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ড সময়ের আলোচিত খুনের ঘটনা। কারণ সংরক্ষিত কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট- সেনানিবাস এলাকার ভেতর খুন সংঘটিত হয়েছে। যার একজন আসামিও এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয় নি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সবারই জানা কি ঘটেছে, কিন্তু কেউই বলতে পারছে না। স্পর্শকাতর হত্যাযজ্ঞ। রাষ্ট্র প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়, হয়তো এমন বলে তদন্ত আর এগুচ্ছে না। এ লেখার আলোচনার বিষয় হত্যা, তদন্ত- এসব বিচারিক বিষয় নিয়ে নয়।
একজন গণমাধ্যম কর্মীর সাংবাদিকতা নিয়ে। তাও মফস্বল- জেলা শহরে কর্মরত একজন সাংবাদিকের দায়িত্ব বিষয়ে।
তনু হত্যার শিকার হয়েছেন। অন্য অহরহ ঘটে যাওয়া খুনের ঘটনার মতোই কম গুরুত্বে স্বাভাবিক রিপোর্ট- সংবাদ হয়েছে সংবাদপত্রগুলোয়। আমি তখন সমকালের কুমিল্লার স্টাফ রিপোর্টার। সমকালও ভেতরের পাতায় দেশের খবরে সিঙ্গেল কলাম ছেপেছে অন্য কাগজের মতোই। আমি তখন ভারতের সিলংয়ে ছিলাম। ছুটি নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বড় ঘটনা ঘটলে সাংবাদিকের দায়িত্ব এসব মানে না। বিশেষ করে মফস্বলের বেলায়। এরমধ্যে আমার শাশুড়ির মৃত্যু হয়েছে। আমি কিছুটা পেরেশানিতে। মনও ভালো ছিল না।
তনু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অনার্সে পড়ুয়া। থিয়েটার- নাট্যকর্মীও। সহপাঠীরা খোদ কান্দিরপাড়ে এসে তাই বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে। এ খবরটাও কেউ ছেপেছে, কারও কাগজে ছাপা হয়নি। সমকালে প্রথমে যায় নি। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আন্দোলন বড় হয়েছে। মানুষ বিক্ষুদ্ধ হয়েছে। এবার প্রায় সব কাগজই খবর দিচ্ছে। মানুষের যৌক্তিক দাবিই সংবাদপত্র- কাগজের দাবি। এটাই গণমুখীতা। গণমাধ্যমের ভিত্তি বলা চলে। বিশ্বস্ততা, মানুষের ভালবাসা- পাঠক প্রিয়তা- ম্যান্ডেট,শক্তি। তখনও টিভিগুলো সংবাদ করা শুরু করে নি।
এরিমধ্য ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় যাওয়ার ডাক পড়লো। আমরা স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীরা গেলাম। আমাদের ব্রিফ করা হলো। ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হলো। পাওয়ার হাউজ সংলগ্ন এলাকা। নাজিরাবাজারের শেষ সীমানা। এরপরই পাবলিক এলাকা। লাশ- মরদেহ যেখানে পড়েছিল সেখানটা একেবারে সীমানা ঘেঁষা। এই অংশটুকুতে দেয়াল নেই, খোলা। তার ওপর ঝোপ-জঙ্গল। আমাদের বলা হলো হত্যার পর বাইরে থেকে লাশ ফেলে যাওয়া হয়েছে এমনটাই হয়তো। তারাও তনুর জন্যে যথেষ্ট আফসোস করলেন। এমন মৃত্যুতে নিজেদের ব্যাথাতুর মনের ভাবও জানালেন। তাদের সিভিল- বেসামরিক কর্মচারীর মেয়ে হলেও তারা সমান গুরুত্ব দিচ্ছেন এমনটাও বললেন।
এদিকে আন্দোলনও তুঙ্গে। প্রতিদিনই কান্দিরপাড়ে বিক্ষোভ চলছে। সংবাদ যাচ্ছে-ছাপা হচ্ছে প্রতিদিনই। হত্যার নানা খুটিনাটি নিয়ে সংবাদ ছাপা হচ্ছে। হট আইটেম। প্রতিদিনই কিছু না কিছু পাঠাতে হচ্ছে। হত্যা রহস্য বের করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টতো পাবলিক এলাকা নয়। আবার আইনত এলাকা। যেখানে জনগণের প্রবেশাধিকার অহরহ নেই সেখানে জানা থাকলেও প্রত্যক্ষ বর্ণনাকারী নেই। বিধিনিষেধ থাকায় তনুর পরিবারের সাথেও সহজে কথা বলা যাচ্ছিল না। মোবাইল ফোন ছাড়া যোগাযোগের আর কোন মাধ্যমও ছিল না। তার দুই ভাই কথা বলতেন। তাও আরও পরে।
এমন অবস্থায় তদন্তকারী পুলিশ ছাড়া আমাদের আর কোন প্রকাশ্য সোর্স ছিল না। উদ্বৃত করলেও পুলিশই ভরসা। তারাও নানামুখী চাপে খোলামেলা কথা বলা থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছেন।
ইতিমধ্যে কুমিল্লার সে সময়ের সৎ পুলিশ সুপারের সাহসী উচ্চারণে বেরিয়ে এসেছে – পারিপার্শ্বিক অবস্থাও বলছে ধর্ষণের পর হত্যাকা- ঘটেছে। এরিমধ্যে এনিয়ে সংবাদও হয়েছে। এটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। এসব খুনে যা হয় শুরু হলো ভিক্টিমের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা। সহপাঠি ও স্থানীয় যুবকদের সাথে তার একাধিক প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকও ব্যক্তিগত আলাপে জানালেন তারাও পরীক্ষায় এমন সত্যই পেয়েছেন। পরে অবশ্য ফলাও করে তা প্রচারও করতে চেয়েছেন। তার আগেই সমকালে সংবাদ পাঠালাম- তনু কি মৃত্যুর আগে ধর্ষিতা হয়েছেন!
সাথে সাথেই সম্পাদক সারোয়ার ভাইয়ের ফোন পেলাম। মহা ঝাড়ি খেলাম। বললাম ভেতরেতো আরও তথ্য আছে। তিনি কিছুই শুনলেন না। অভিজ্ঞতা কেন কাজ করে নি এটাই তাঁর প্রশ্ন-ধমক ছিল। সেদিন সমকালে কোন নিউজই ছাপা হলো না। অন্য সব কাগজে সংবাদ আছে। ঘটনার সাত- আট দিন চলছে। আমি বেশ বেকাদায়। পরদিন ঢাকা থেকে সাংবাদিক পাঠানো হলো। পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হোটেলের রুমে জানতে চাইলেন কি আছে দিন, নিউজ লাগবে, আজই যাবে।
ওই যে একদিনের বাসী (গত হওয়া) তনু কি ধর্ষিতা হয়েছেন! সেই ড্রাফট দিলাম। সূচনার পরের প্যারাতেই ছিল মরদেহের সুরুতহাল প্রতিবেদনের বেশ কিছু তথ্য। তখনও কোন কাগজই এমন খবর দেয় নি। ঢাকা থেকে আসা সাংবাদিক ভাই আলাপ করলেন অফিসে। সেদিনের নিউজের শুধুমাত্র সূচনা পরিবর্তন করে পাঠিয়ে দিলেন। কারণ তখন রাত হয়ে গেছে। পরদিন সেকেন্ড লিড হলো- তনুর মাথা থেঁতলানো ছিল।
আমি যে মুনি(শ্রম) দিলাম তার কিছুই পেলাম না। রিপোর্টের শেষে সহায়তাকারী হিসেবে আমার নাম উল্লেখ ছিল মাত্র। অতটুকু দিতেও অফিস রাজি ছিল না। ঢাকার সাংবাদিক ভাই বুঝাতে সক্ষম হলেন যে বাদ যাওয়া রিপোর্ট থেকেই সংবাদ পাঠানো হয়েছে। নাড়াচাড়াও সামান্য করতে হয়েছে। বাকী অনেক তথ্য আছে। যা দিয়ে আগামী দুইদিন আরও এক্সক্লুসিভ চলবে। কারণ পুলিশের সুরুতহাল প্রতিবেদন আর কোন সাংবাদিকের হাতে নেই। এটাতো আমার কর্মেই হয়েছে। তখন নমনীয়তা মিলে। কারণ একটাই আমি কর্ম অভিজ্ঞতা দেখাতে পারি নি। ছুটি, নিকটজনের মৃত্যু এসব দায়িত্বের কাছে তুচ্ছ।
কি সে কর্ম অভিজ্ঞতা। মেয়েটি হত্যার শিকার হয়েছে। হত্যা রহস্যে ঘেরা। সহজে সত্য উঠে আসছে না। রাজপথে আন্দোলন চলছে। নিখাদ সামাজিক আন্দোলন। যা গণআন্দোলনে পরিণত হচ্ছে। দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়েছে। সেখানে ধর্ষণের পর খুন এটা প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। কেন বিপরীতে দাঁড়ালাম। ময়নাতদন্ত ডাক্তার বলুক। সত্য যাই হউক, এই অপরাধ থাকলেওতো এর জন্যে খুন করা যায় না। এখানে অপরাধী শনাক্ত বড় কথা। অন্য সব বাদ।

গণমানুষের বিপরীতে গণমাধ্যম যেতে পারে না। মানুষের ধারণা যাই তাই গণমাধ্যমের সেন্টিমেন্ট, পৃথক হওয়া যায় না। আমি হেডলাইন (পাঠানো সংবাদ সহজে বুঝতে) সঠিক করি নি। প্রথম সূচনা বাদ দিয়ে দ্বিতীয় সূচনা দিয়ে এক্সক্লুসিভ হলেও আমি অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারিনি। এটাই সঠিক। আমি বুঝেছি। এমন হয় অহরহ মফস্বলে। ডেক্সের(অফিসের) সাথে আলাপ আলোচনায় তাদের চাওয়া অনুযায়ী সাপ্লাই দেয়া যায়। কারণ বেশি তথ্য আমাদের ঝুলিতে রেখেই লেখতে বসতে হয়। আমরা ঢাকা থেকে দূরে থাকি। ডেক্স আন্তরিক না হলে যা হয় আরকি। গাইড দেয়ার পরিবর্তে উল্টো অপরাধ উপস্থাপিত হয়। হই হই শুরু হয়। অনেক দিন এক প্রতিষ্ঠানে থাকলে এমনটা ঘটে, মাঝে-মধ্যে- এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
সবকিছুর পরও পিছিয়ে থেকেও পরদিন সমকালেই হিরো। কিন্তু আমার ঝোলায় কোন অনুপ্রেরণা (বাহবা) যুক্ত হয় নি । তবে ঢাকা থেকে আসা সাংবাদিক ভাই আমার কষ্ট বুঝেছেন। ঢাকাকে বুঝাতে পেরেছেন। তার অপরিসীম চেষ্টা ছিল।

ওই ড্রাফটের রেখে দেয়া তথ্য থেকে দ্বিতীয় এক্সক্লুসিভ হলো। ডান কানেও জখম ছিল। প্রথম ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার প্রতিবেদনে পরে যাকে পোকার কামড় বলেছেন। সুরুতহালে জখম (কাটা) বলা হয়েছে। সেখানেও আমি রিপোর্ট প্রস্তুতে সহায়তা করেছি এতটুকুই উল্লেখ হলো। এরপর ওই সাংবাদিক ঢাকায়- অফিসে ফিরে গেলেন। সমকাল দারুণ হিট তখন। ওই সুরুতহাল প্রতিবেদন নিয়ে এবার আমার নামে- ক্রেডিট লাইনে আরও বেশ কটি সংবাদ পর পর ছাপা হলো। আমি আগের ফর্মে সাংবাদিকতায় মনোযোগ দিলাম। অস্বস্তি কেটে গেল।

যদিও প্রতিযোগিতায় অন্যসব কাগজও ঢাকার সাংবাদিক পাঠানো শুরু করতে বাধ্য হয়েছে ইতিমধ্যে। বর্তমানে তদন্ত যে জায়গায় থমকে আছে – ডিএনএ প্রতিবেদনে ব্যবহার্য কাপড়ে তিন পুরুষের আলামত মিলেছে। সমকাল তখনই (ওই সময়ই) রিপোর্টে বলেছে মরদেহ পুলিশে হস্তান্তরের পর ব্যবহার্য নিচের অন্তর্বাস আরও একটি- অতিরিক্ত আলামত হিসেবে দিয়েছে সেনা কর্তৃপক্ষ। পরণে একটি ছিল।
অবশ্য তার দু’দিন পরেই সংবাদপত্র ও টিভির ক্রাইম বিট প্রধানদের ঢাকা থেকে কুমিল্লায় ঘটনাস্থলে নিয়ে আসেন সেনা কর্তৃপক্ষ। আমরাও আবার ডাক পাই। প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ জানানো যায় নি। এবার বলা হলো ভিন্ন কথা, তদন্তের অগ্রগতি। এভাবে প্রায় একমাস টানা খবর- সংবাদ ছিল। কারণ দেশ তখন বিচারের দাবিতে উত্তাল। এরপর জনতা স্তিমিত হলো। সংবাদও থেমে গেল। এখন মৃত্যুবার্ষিকী এলে ফলাও সংবাদ হয়। রেশ কাটে নি। গণমাধ্যম দায়িত্বে অবিচল। কারণ মানুষ জেগে আছে। জানার আগ্রহ আছে, জানতে চায়।

তনু খুন হয়েছে ৭ বছর পেরিয়ে গেল। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় স্পর্শকাতর সংরক্ষিত কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায়। রাত ১১ টার দিকে লাশ বাসার কাছের সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের কাছের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে মিলিটারি পুলিশ। তনুর বাবা ইয়ার হোসেন কুমিল্লা সেনানিবাস বোর্ডের অফিস সহায়ক। তারা সপরিবারে সেনানিবাসের কোয়ার্টারে থাকেন।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

আরো পড়ুন