তিননদী পরিষদের উন্মেষকাল
|| প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট ||
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়বার প্রকল্পের একটা নেতিবাচক দিক হলো, যে কেঊ ফেসবুক এ্যাকাঊন্টে বা ই-মেইল আইডিতে কোন চিঠি পাঠিয়ে অযাচিতভাবে অনুরোধ করলে তা অস্বীকার করা যাবেনা । তা আপনি ব্যস্ততার কারণে দেখে থাকেন বা না দেখে থাকেন । প্রেরকের অবশ্যই বলবার অধিকার বা দাবি এসে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে, যে কোন লেখা পাঠাবার অনুরোধ বা অনুষ্ঠানের দাওয়াত সম্বন্ধে-“আমিতো পাঠিয়েছি আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বা ই-মেইল আইডিতে । দেখেননি বা পাননি ?”
কথাগুলো বললাম আমার অত্যন্ত প্রিয় তুখোড় সাংবাদিক নিয়মিত প্রকাশনার ৬৮ বছর পেরুনো ঐতিহ্যবাহী সাপ্তাহিক আমোদ-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জনাব মহিউদ্দিন মোল্লার একটা অনুরোধ ১২ ফেব্রুয়ারি রোববার রাতে ফেসবুকে পাওয়ার পর । আবদারটা হলো অমর একুশের ওপর ছোটখাট একটা লেখা যেন দিই মঙ্গলবারের মধ্যে (১৪ ফেব্রুয়ারি)। (তিনি বেশ ভালো করেই জানেন আমার লেখা সচরাচর বড় হওয়ার বদনাম রয়েছে ।)
কুমিল্লার গৌরব আমোদ-এর সামান্য অনুরোধও আমার পক্ষে উপেক্ষা করবার উপায় নেই। আমোদ পরিবারের সঙ্গে এক গভীর দীর্ঘ মনস্তাত্বিক সম্বন্ধ রয়েছে বলেই। অনুজপ্রতিম মোল্লা লেখাটার বিষয়বস্তু বলে দেয়নি। তাই প্রথমে ঠিক করলাম কুমিল্লার সমাজজীবনে সবচাইতে সফল, দর্শকনন্দিত এবং আলোচিত মহান একুশে উদযাপন হয়েছিলো ১৯৭০ এবং ১৯৭১ সালে । তার ওপর লিখবো । পরক্ষণেই মনে হলো দূরঅতীত এবং নিকটঅতীতের ঘটনাবলিকে পরিত্যাগ করে সাম্প্রতিক সময়ের বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দিলেই ভালো হবে ।
তাই তিননদী পরিষদ আয়োজিত অমর ভাষা আন্দোলনের ওপর একুশদিনব্যাপী যে অনুষ্ঠানাদি বিগত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে চলে আসছে–তা নিয়েই লিখি। বোধকরি তিননদী পরিষদের জন্মবৃত্তান্ত বা উন্মেষকাল সম্পর্কে অধিকাংশ কুমিল্লাবাসী, বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্ম, জানেননা । যদিও সম্ভবত: দেশের কোথাও তিননদী পরিষদের আগে পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অমর একুশ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান আয়োজন বা উদযাপনের কোন দৃষ্টান্ত নেই ।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসছি । স্পষ্ট মনে নেই ফুটবল কি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের কোন প্রতিযোগিতামূলক একটি খেলা কুমিল্লা স্টেডিয়ামে দেখবার পর এবং কভার করবার পর ১৯৮৪ সালে আমরা ক’জন তখনকার অপেক্ষাকৃত তরুণ স্টেডিয়ামের উত্তর দিকের নব-নির্মিত দোতলার একটি ঘরে বসি । ওই অনির্ধারিত বৈঠকে বরেণ্য সাংবাদিক আবুল হাসনাত বাবুল একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়বার তখনকার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন । সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবিত সংগঠনটির নামও উল্লেখ করেন। তিননদী পরিষদ বলে। সভায় আমায় (প্রদীপ কুমার সিংহ রায় মুকুট) সভাপতি এবং বাবুলকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করে প্রাথমিকভাবে ছয়-সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয় । অন্য সদস্যরা হলেন ক্রীড়া সংগঠক বদরুল হুদা জেনু, সাংবাদিক বাকীন রাব্বী, শিল্পী (ড.) সৈয়দ আবদুল ওয়াজেদ এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক শিল্পী নওশাদ কবীর। সেসময় আমি দ্য ডেইলি নিউ নেশান পত্রিকার কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি এবং কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম ।
পরবর্তীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নামীদামী প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা যেমন পারভীন হাসনাত, কাউন্সিলার জমীরউদ্দিন আহমেদ জম্পী এবং অন্যান্যরা এই সংগঠনের কর্মকা- এগিয়ে নিতে সহায়তা ও সহযোগিতা করেছেন । তারপর সভায় বিস্তারিত আলোচনার পর নতুন এই সংগঠনটির প্রথম কর্মকান্ড হিসেবে একুশদিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠান আয়োজন করবার কথা বলেন প্রস্তাবকারী জনাব বাবুল ।
সভায় উপস্থিত সবাই আমরা হতবাক হয়ে পড়ি। কিন্তু সাহসী বাবুলের উদ্যম, আত্মবিশ্বাস, একাগ্রতা, ক্ষেত্রবিশেষে একগুঁয়েমী ও গোঁ সর্বোপরি দৃঢ় কমিটমেন্টের ফলশ্রুতিতে সে বছরই আমরা পৌরপার্কের জামতলায় প্রথম একুশদিনব্যাপী কর্মসূচি প্রবর্তন করতে সক্ষম হই । প্রবল আর্থিক দৈন্যতা সত্বেও পোস্টার, ব্যানার আঁকা এবং চিঠিপত্র, প্রচারপত্র প্রস্তুতকরণ এবং অনুষ্ঠান উপস্থাপনের দায়িত্ব বর্তায় প্রাথমিকভাবে অকালপ্রয়াত অনুজপ্রতিম নওশাদের ওপর । আমি বিনে পয়সায় ছাপার যাবতীয় কাজ করে দিতাম পৈত্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিংহ প্রেস থেকে । এমনকি সংগঠনটির ওয়াউড শীটের অর্থাৎ পত্রিকার আকারের “তিননদী” সংকলনও নিখরচায় ছেপে দিতে হয়েছে প্রাথমিকভাবে । যদিও সেসময় সিংহ প্রেসের ব্যবসায় মন্দাভাব বিরাজিত ছিলো ।
তখনকার জনপ্রিয় জেলা প্রশাসক সৈয়দ আমিনুর রহমান এবং জেলার প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য-নাট্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অকৃপণ সহায়তা, সহযোগিতা-সহমর্মিতা আমরা পেয়েছি। মূলত: বাবুল, জেনু ও বাকীনের নেতৃত্বে একটি অলিখিত টিম সাংগঠনিক কর্মকা- এগিয়ে নিতে সফল হয় প্রচন্ড অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। যদিও সহকর্মী-বন্ধু সাংবাদিকরা ছাড়াও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকেই ২১দিনব্যাপী অনুষ্ঠান ধরে রাখার ব্যাপারে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন এবং সন্দিহান হয়েছিলেন তখন ।
সংগঠনটির অভিনব নামাকরণ সম্পর্কে আমাদের অনেকেই সময় সময় জিজ্ঞেস করেছেন। তখন বলতাম, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই প্রধান প্রধান নগর দুটো বা তিনটে নদী বিধৌত অববাহিকায় গড়ে উঠেছে। ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা জেলাও তিনটি প্রধান নদী-গোমতী, মেঘনা ও তিতাস-পরিবেষ্টিত সভ্যতার নিদর্শন ।
প্রথম প্রথম আমরাও হতাশ হয়ে পড়ি পার্কের জামতলার মতো নিরব নিরিবিলি জায়গায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে মানুষজনের সামান্য উপস্থিতি দেখে। কিন্তু যতই দিন গড়াতে লাগলো দর্র্শক-শ্রোতার উপস্থিতির হার বাড়তে শুরু করলো । জামতলার প্রশস্ত সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে হাজার হাজার জনগণ অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন দিনের পর দিন । এমনকি জনগণের উপস্থিতি বর্তমানে বিলীন ব্যাঙ সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে প্রত্যক্ষ করেছি। তারা অবস্থান নিতেন মূলত বড় বড় পর্বত-প্রমাণ রেইন ট্রি এবং শিরিষ গাছগুলোর ছায়ায়। কেননা বিকেল চারটার মধ্যেই আমরা অনুষ্ঠান আরম্ভ করতে পেরেছিলাম।
তখনকার পৌর পার্কের পরিবেশ ছিলো শান্ত, সমাহিত, নিরিবিলি, নিরব ও পরিবেশ-বান্ধব । এখনকার মতো কোলাহলপূর্ণ ব্যবসায়িক বিনোদন আনন্দমূলক যন্ত্রণাদায়ক কলরবে উপচে পড়া চিত্ত বিনোদন ও স্বাস্থ্য সচেতনতা-বঞ্চিত পার্কে রূপান্তরিত হয়নি । পৌর পার্কটি শহরের ফুসফুস বা লাঙ হিসেবেই আমজনতার কাছে বিবেচিত হতো । পার্কের মধ্যে ব্যাঙ সাগরসহ কয়েকটা কংক্রিটের চেয়ার ও বরেণ্য শিল্পী মোহাম্মদ আলী ভাই প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা আর্ট ইন্সটিটিউট ছাড়া কোন স্থাপনাই ছিলোনা । যার ফলে অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে আলোচনা সভায় বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা সচ্ছন্দে ও সাবলীলতায় তাদের বক্তব্য প্রদানে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতেননা ।
সভার সভাপতির ভাষণ দর্শক-শ্রোতারা প্রায়সময়ই শোনেননা এবং উঠে চলে যান বলে আমরা একটা নতুন প্রথা প্রবর্তন করেছিলাম ।
সংগঠনের সভাপতির ভাষণ দিয়ে দিনের অনুষ্ঠান শুরু হতো। প্রথম দিকে অত্যন্ত প্রিয় ছোটভাই নওশাদই প্রায় প্রতিদিন অনুষ্ঠান উপস্থাপন করতেন। ও প্রায়সময়ই বলতো, আপনিতো দেখি বক্তা হয়ে উঠছেন, মাইক ছাড়তেই চাননা । আগেতো একদমই বক্তৃতা দিতে পারতেননা। কচু গাছ কাটতে কাটতে ডাকাত বনে গিয়েছি আরকি, বলতাম ওর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে। এমনি শত শত সুমধুর ঘটনা মনের আয়নায় ভেসে উঠছে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে । তবে, বড়ই ক্ষেদ, আক্ষেপ, মনোযন্ত্রণা এবং কষ্ট হয় অনুজ নওশাদের অকাল মৃত্যুতে। একটি ঘটানো সড়ক দুর্ঘটনায়। চান্দিনার কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে । কয় বছর পর ।
তখন কার্যব্যপদেশে আমি ঢাকায়, বাকীন রাব্বী মার্কিন মুলুকের অঙ্গ রাজ্য নিঊ জার্সিতে ও সৈয়দ আবদুল ওয়াজেদ চট্টগ্রামে। তাইতো আমাদের এই তিনজনের সঙ্গে তিননদী পরিষদের একুশের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এবং সম্পৃক্ততা দিনে দিনে কমে আসে। তবে, অনুজ জেনু ফি বছর তিননদী পরিষদের একুশের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দিয়েছে এবং কবিতা পাঠ করেছে। মনে পড়ে ছোটভাই বাকীন রাব্বীর একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী তিননদী পরিষদ আয়োজন করেছিল পৌর পার্কের জামতলায়। খুব সম্ভব ১৯৮৭ সনে ।
তবে, আবারো বলে রাখি এবং ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই সহকর্মী-বন্ধু আবুল হাসনাত বাবুলকে। এত দীর্ঘ বছর ধরে বলতে গেলে সিঙ্গেল-হ্যান্ডেডলি বা এককভাবে অমর একুশের অনুষ্ঠান নিরবিচ্ছিন্নভাবে আয়োজন করবার জন্যে । নিজের দেহে বয়ে বেড়ানো দূরারোগ্য ব্যাধিসহ সমস্ত প্রতিকুলতার মুখোমুখি হয়েও। আমাদের মতো বিশাল বা প্রচন্ড জনঘনত্বের একটি আপাত পিছিয়ে-পড়া মফস্বলের জনপদ কুমিল্লায় ।
আমাদের সব জাতীয় আন্দোলনের বাতিঘর বা সূতিকাগার হলো বায়ান্নের মহান ভাষা আন্দোলন। ৬২, ৬৪, ৬৬, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ এবং একাত্তরের সফল সার্থক স্বাধীনতা সংগ্রামের পথপ্রদর্শকও হচ্ছে মহান ভাষা আন্দোলন । পাশের দেশ ভারতের আসাম ছাড়া পৃথিবীর আর কোন দেশে মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্ম-উৎসর্গ করবার নজীর নেই। আসামে সম্ভবত: তিনজন জীবন দিয়েছিলেন মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে ।
তাই, মহান একুশের পুণ্যলগ্নের পূর্বাহ্নে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিকসহ শত শত প্রাণোৎসর্গকারী ভাষাবীর শহীদদের জানাই অতল শ্রদ্ধা । তোমাদের কালকের জীবনদানের ফলেই আমরা স্বাধীন সার্বভৌম আজকের বাংলাদেশে গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে কালাতিপাত করছি । তোমাদের জানাই “লাল সালাম” !!!
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
মোবাইল : ০১৭৩১-৫১২৭২২/০১৫৫২-৩২০৯৫৭ ।