নগরীর সড়কে প্লেন চলে!

অটোরিকশার বেপরোয়া গতি
প্রতিদিন দুর্ঘটনা
সৃষ্টি হচ্ছে যানজট
সুমন পাটোয়ারী।।
কুমিল্লা নগরীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ইজি বাইক ও মিশুক হয়ে উঠেছে এক আতঙ্কের নাম। যেন অটোরিকশা নয় চলছে প্লেন। কোন থামাথামির নাম নেই। সড়কের পাশের মানুষকে ধাক্কা দিয়ে ছুটছে। অটোরিকশা, ইজি বাইক ও মিশুক চালকদের বেপরোয়া চালানোর ফলে প্রতিনিয়ত ঘটে দুর্ঘটনা। হাত পা ভেঙে হচ্ছেন পঙ্গু। ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বেশির ভাগ অটোরিকশা, ইজি বাইক ও মিশুক চালকের বয়সে কম এবং ট্রাফিক নিয়ম সম্পর্কে প্রায়ই জানেনা। অধিক যাত্রী নেওয়া, ট্রাফিক আইন অমান্য করে উল্টো পথে চলাচল এবং যত্রতত্র থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানোর কারণে যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
অনুমোদনের চেয়ে বহুগুণ বেশি অটোরিকশা, ইজি বাইক ও মিশুক চলাচল করায় শহরের প্রধান সড়কগুলোতে মারাত্মক যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে ব্যস্ত সময়গুলোতে কান্দিরপাড়,নিউমার্কেট,মনোহরপুর, রেইসকোর্স, ধর্মসাগরপাড়, রাজগঞ্জ, চকবাজার, সালাউদ্দিন মোড়, টমছমব্রিজ, রাণীরবাজার, বাদশা মিয়ার বাজার, পুলিশ লাইনস, ফৌজদারি মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় যান চলাচল প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই দেখা যায়, অটোরিকশা ও মিশুকের ধাক্কায় পথচারী বা অন্য যানবাহনের আরোহীরা আহত হচ্ছেন। যার ফলে প্রতিদিনই কয়েকজন দুর্ঘটনাগ্রস্ত ব্যক্তি চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
নগরীর যানবাহন ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি, নতুবা অটো রিকশা দুর্ঘটনা আরো প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে এমনটাই আশঙ্কা নাগরিকদের। বিশেষ করে এর গতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পদক্ষেপ নিতে হবে।
এদিকে সম্প্রতি নগরীর রামমালা এলাকায় অটো রিকশার ধাক্কায় মোটর সাইকেল থেকে পড়ে ট্রাকের চাকায় পৃষ্ঠ হয়ে এক কলেজ ছাত্র নিহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী ইউনুস হোসেন রুবেল বলেন, মোটরসাইলকেল যোগে দুই ভাই যাচ্ছিলেন রামমালা এলাকায়। একটি অটো রিকশা এসে মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়ার ফলে পিছনে থাকা ছোট ভাই মোটরসাইকেল থেকে রাস্তায় পড়ে গেলে চলন্ত ট্রাকের চাকায় পৃষ্ঠ হয়ে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়।
সাবের হোসেন নামের এক পথচারী বলেন, রাস্তায় বের হলেই একটা আতঙ্কে থাকি। অটোরিকশা গুলো এত গতিতে চলে কখন জানি এসে ধাক্কা দিয়ে দেয়। কারণ যদিও চালকরা খুব গতিতে অটো চালায় কিন্তু গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে যে ব্রেকের প্রয়োজন তা অটোতে নেই। যার ফলে তারা পথচারী কিংবা অন্য কোন যানবাহনে এসে ধাক্কা দিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়।
মোটর সাইকেল আরোহী তানভীর হাসান বলেন, অটো রিকশা চালকরা এক তো অভার স্পিডে চালায়, আবার তারা সামনে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে গাড়ি চালায়। যার কারণে সামনে কি আছে সেটা না দেখেই এসে ধাক্কা লাগিয়ে দেয়। এখন পর্যন্ত আমার মোটরসাইকেলে তিনবার অটো রিকশা ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফেলে দেয়। তাদেরকে সিগনাল দিলেও তারা বুঝেনা। যার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
অটো রিকশায় দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার আরিফ হোসেন। তিনি জানান, তিনি অটো নিয়ে যাচ্ছিলেন। সামনে থেকে আরেকটি অটো এসে তার অটোতে ধাক্কা দেয়। তখন রিকশাটি উল্টে তিনি নিচে পড়ে যান। তার ডান পা ভেঙ্গে যায়। আজ ১১ দিনের মত হাসপাতালে পড়ে আছেন।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. এসএম সাইফুল হাসিব ভূঁইয়া বলেন, বর্তমানে আমাদের কাছে মোটরসাইলকেল ও অটো রিকশা দুর্ঘটনার রোগী বেশি আসে। কারো পা, কারো হাত ভেঙ্গে যায়। এমন অনেক রোগী আছে যাদের সার্জারি করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। আর এ ধরনের রোগীদের সেরে উঠতে অনেক দিন সময় লেগে যায়।
কুমিল্লা কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ মো. হুমায়ূন কবীর মাসউদ বলেন, সড়কের ক্যান্সার নামে পরিচিত ব্যাটারি চালিত রিকশার দৌরাত্ম্য যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। অপরিকল্পিত অনুমোদন, চালকদের একটি বড় অংশ প্রশিক্ষণ বিহীন, নেশাগ্রস্ত ও শিশুরাও ড্রাইভিং করার কারণে গতি হচ্ছে বেপরোয়া আর দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। অতি দ্রুত এই সমস্যা উত্তোরণে সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে ভারী হবে পঙ্গুত্ব ও মৃত্যুর মিছিল।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের উপ-সচিব (প্রশাসক) মাছুম মিল্লাত মজুমদার বলেন, কুমিল্লা নগরীতে পরিমাণের চেয়ে অটো রিকশা বেশি চলাচল করে। যিনি প্রবাস ফেরত তিনি অটো চালান, যিনি বেকার তিনিও অটো চালান। কোন প্রকারের প্রশিক্ষণ ছাড়াই যে যেভাবে পারছে সেভাবেই অটো চালাচ্ছে। যার ফলে নগরীতে যানজট ও দুর্ঘটনা ঘটছে। নগরীতে চলাচলরত অটো রিকশা চালকদের নিবন্ধন, প্রশিক্ষণ এবং লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা হোক এবং বেপরোয়া চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এদিকে কোন রোডে অটো রিকশা চলবে কোন রোডে চলবে না সেটা নির্ধারণ করা গেলে নগরীর যানজট নিরসন করা সম্ভব হবে আমি মনে করি।
কুমিল্লার ট্রাফিক ইন্সপেক্টর সরোয়ার মোহাম্মদ পারভেজ বলেন, কুমিল্লা নগরীতে অটো রিকশা নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশও কাজ করছে। বিশেষ করে নগরীর যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি, কিন্তু চালকদের সচেতনতা ও আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আবু সায়েম ভূইঁয়া বলেন, সিটি কর্পোরেশন থেকে কোন অটো রিকসাকে লাইসেন্স প্রদান করা হয় নি। চালকসহ ৩ সিট বিশিষ্ট ৫ হাজার অটো রিকশা লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এদিকে অটো রিকশা নিয়ন্ত্রণে নগরীর ৭ টি রোডের মাথায় ট্রাফিক বক্স স্থাপনেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

inside post
আরো পড়ুন