বিজয়ের দিনে যত প্রত্যাশা

।। প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট ।।

inside post

“দেশজুড়ে এই মুহূর্তে প্রয়োজন আইন শৃংখলার পুন:স্থাপন।”
এটা শুধুমাত্র আমার ব্যক্তিগত দাবি নয়। বোধহয় দেশের ১৮ কোটি জনগণ বা নাগরিকেরই দাবি। বর্তমান বছরের আগস্ট ০৫-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। অনেক কালক্ষেপণ হয়েছে। আর করা যাবেনা। দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থেই যথাযথ দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া অত্যাবশ্যকীয়।
সঙ্গে সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশচুম্বী দাম এখনই আর বিলম্ব না করে কমাতে হবে। যে কোন মূল্যে।

বহুল আলোচিত বাজার সিন্ডিকেট এখনই ভেঙ্গে দিতে হবে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গঠিত এই সিন্ডিকেট জনজীবনে যে দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তা অবিলম্বে ভেঙ্গে দিতে হবে। জনজীবনে একটু স্বস্তি ও স্বাভাবিক অবস্থ্ার প্রতিস্থাপন করবার স্বার্থেই তা করা একান্ত দরকার।

তাছাড়া, কিছু টিভি চ্যানেল এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালে পরিবহন সেক্টরসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় আবারো চাঁদাবাজির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। নইলে প্রতিদিনকার ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম আরো একধাপ বাড়বে। বাড়বে জনজীবনে অস্বস্তি ও অসন্তোষ।

মহান বিজয় দিবসের ৫৩তম বার্ষিকীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এ প্রস্তাবনাগুলো বোধকরি আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত নয়। সারা দেশের জনগণও তাই ভাবছেন বলে আমার দৃঢ় বিশ^াস। ২০০৫ সালের ১/১১ পরবর্তী ফখরুদ্দিন-ইয়াজুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সামরিক বাহিনী সমর্থিত প্রশাসন বলা হতো। তারা অন্তত:পক্ষে এক বছরের বেশি সময় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় আইন শৃংখলা পরিস্থিতির প্রভূত উন্নয়ন, বাজার ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ এবং বড় বড় নগর ও জেলা সদরে যানবাহন বা ট্রাফিক ব্যবস্থায় একটা শৃংখলা আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাছাড়া, সরকারি, আধা-সরকারি এবং বিভিন্ন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংস্থায় স্বাভাবিক ও আশানুরূপ কাজকর্মের পরিবেশ ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে প্রয়োজনীয় পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে দেখা যায় সে সময়ে। জনমনে স্বস্তি ফিরে আসে এবং নিয়ম-রীতি-নীতি-শৃংখলা ফিরে আসে অনেক সেক্টরে বা খাতে।

সেই সরকারের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে হলেও বর্তমান ড. মুহাম্মদ ইউনুস নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের প্রশাসন ব্যবস্থায় কড়াকড়ি আরোপ করতে পারেন। যাতে করে গ্রামে গঞ্জে শহরে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিগ্রহ, বাড়িঘর মন্দির ধ্বংস ও আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা প্রতিরোধ করা যায়। দুর্বৃত্তরা সংযত ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়। এমন ধরনের অপরাধ থেকে নিবৃত্ত না হলে তাদের প্রাণসংশয়ও হতে পারে। এ ধরনের মেসেজ বা বার্ত্তা তাদের কাছে পৌঁছে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এই ধরনের জঘন্য অপরাধ সংগঠনের আগে সন্ত্রাসী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী আরেকবার চিন্তা করবে।

তাছাড়া, ভারতের ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘু নিগ্রহ নির্যাতন সংক্রান্ত বাংলাদেশ বিরোধী যে প্রপাগান্ডা ও ক্যাম্পেন বা অপপ্রচার ইদানিং চালানো হচ্ছে তাও প্রশমন হবে। এদিকে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ নিজ দেশে এ ব্যাপারে সোচ্চার না হলেও মার্কিন মুলুকের নিউ ইয়র্ক সিটি কেন্দ্রিক সংগঠনটির আন্তর্জাতিক শাখা ভিডিও ক্লিপিংসহ বাংলাদেশের কিছু কিছু তৃণমূল পর্যায়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রামাণ্য ভিডিও অন্তর্জালে ছড়িয়ে প্রচারণায় নেমেছে। এতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন বাংলাদেশের সুনাম মান মর্যাদা ভাবমূর্তি ভূলুূন্ঠিত হচ্ছে ।

গত সাত ও আটই ডিসেম্বরও সুনামগঞ্জ সদরে অতি উৎসাহী কোন উগ্র গোষ্ঠীর দুর্বৃত্তরা শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মন্দির, ইসকন মন্দির ও রাধা-গোবিন্দজির মন্দিরে আক্রমণ করে ভাংচুর করেছে। তাছাড়া, নারায়ণগঞ্জ জেলার রায়পুরা উপজেলা সদরেও মন্দির আক্রান্ত হওয়ার প্রামাণ্য ভিডিও ভাইরাল হয়েছে । সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের মধ্যে এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবার প্রয়াসে দুবৃত্তরা এ ধরণের অপকর্ম করে যাচ্ছে।
এইসব বিড়ম্বনা, বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার থেকে অন্তত:পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থনের লক্ষ্যেও একটি দূরদর্শী, সময়োপযোগী এবং ফলপ্রসু সিদ্ধন্ত নেয়া আশু প্রয়োজন। যাতে করে এ বছরের জুলাই ১৮ থেকে আগস্ট ০৫ তারিখ পর্র্যন্ত সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিপ্লব মাঠে মারা না যায়। দেশে নির্বাচন ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সেক্টরে যথোপোযুক্ত সংস্কার কর্মসূচি সফল করে জনগণের আশা আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন করা যায়। যাতে করে সামনের বছরে (২০২৫ সনে) জাতীয় সাধারণ নির্বাচন নিশ্চিত করা যায়। তাহলেই বিশ^বাসী জানবেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকার, যা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল হিসেবে ক্ষমতারোহন করেছে ০৫ আগস্টের পর, তা বাংলাদেশকে সঠিক গন্তব্যের দিকে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুন:প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে রাইট ট্র্যাকে বা নির্দিষ্ট পথ ধরেই এগুচ্ছে। জনগণও আর বিভ্রান্ত না হয়ে মহান একাত্তর সালের মতো এক সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলে আপাতদৃষ্টে পিছিয়ে পড়া পথভ্রান্ত বাংলাদেশের মান মর্যাদা সুনাম ভাবমূর্তি আবারো বিশ^ দরবারে তুলে ধরতে সক্ষম হবে।

কিন্তু ভুলে গেলে চলবেনা মহান একাত্তর সনে ৩০ লক্ষ তাজা প্রাণের আত্মাহুতির মাধ্যমে এবং তিন লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশে^র মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে।

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী, কর্নেল এমএজি ওসমানী, মেজর জিয়াউর রহমান, মণি সিংহ এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ প্রমুখ জাতীয় বীরদের আত্মত্যাগ ও অবদান থেকে আমরা যেন কোনক্রমেই বিস্মৃত না হই। এই মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরদের কৃতিত্বগাথা আন্তর্জাতিক ইতিহাসে এবং এ দেশের আপামর জনগণের হৃদয়ে সুদৃঢ়ভাবে গ্রন্থিত হয়ে রয়েছে। তা অপসারণ বা মুছে ফেলার ধৃষ্টতা বা অপপ্রয়াস অতীতেও ব্যর্থ হয়েছে, ভবিষ্যতেও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে অতি অবশ্যই।

ইতিহাস কিন্তু মীর জাফর আলী খান, উমি চাঁদ, রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, ঘসেটি বেগম এবং আরো অনেক জাতীয় বেইমানদের ক্ষমা করেনি। এমনকি লর্ড ক্লাইভের মতো ক্ষমতাধর পরাক্রমশালী বিজাতীয় ইংরেজ প্রশাসকের শেষ পরিনতি কি হয়েছিল তা বিশ^বাসী অবগত রয়েছেন। ইতিহাসে যার যা অবস্থান, অবদান ও কৃতিত্ব তাকে তা অবশ্যই দিতে হবে, স্বীকৃতি সম্মানে ভূষিত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে একটা ছোট ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা এই অবসরে বললে বোধকরি অত্যুক্তি বা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা।

ঠিক মনে নেই, বোধকরি ১৯৯৭ সন। এর এক বছর আগে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে। এর আগে বঙ্গবন্ধুর এপিএস মোহাম্মদ হানিফ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথমবারের মতো রাজধানী ঢাকার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তখন ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ জনসেবামূলক নানান প্রতিষ্ঠান কভার দায়িত্ব আমার উপর বর্তেছিলো। প্রায় প্রতিদিনই ফিনিক্স রোডে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সদর দপ্তরে যেতাম। সে প্রতিষ্ঠানের প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন (প্রয়াত) আমার অত্মীয় সমতুল্য বন্ধু। একদিন তার আপিসে গিয়ে দেখি করপোরেশনের বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধানরা এক জরুরি সভায় মিলিত হয়েছেন। প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা আবদুর রহিম আমায় জানালেন মেয়র সাহেবকে আজ সকালে অগ্নিশর্মা রূপে প্রথমবার কোন নির্দেশ দিতে দেখেছেন।
সকাল ১১টার দিকে মেয়র’স উইঙ্গ দিয়ে স্বীয় আপিসে ঢোকার আগে মেয়র হানিফ দেখতে পান কে বা কারা সিঁড়ির ডানপাশে প্রতিস্থাপিত প্রস্তর খন্ডটি গাঁইতি দিয়ে তুলে ফেলেছে। সে প্রস্তর খন্ডে মুদ্রিত ছিলো, মেয়র মির্জা আব্বাসের তত্ত্বাবধানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নগর ভবনের এই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
স্বভাবগতভাবে অত্যন্ত মার্জিত, শালীন এবং অভিজাত ঢাকার জনপ্রিয় মেয়র মোহাম্মদ হানিফকে ঐদিনের মতো রাগান্বিত হতে সম্ভবত: কেউ কোনদিন দেখেননি। পুরোনো ঢাকার ভাষায় গালাগাল দিয়ে হানিফ সাহেব করপোরেশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ওইদিন বলেছিলেন, আমার চেয়ে বড় আওয়ামীলীগার তোমরা হয়ে গেছো নাকি। আজ আমি আপিস থেকে চলে যারার আগে এই ভিত্তিপ্রস্তরটি পুন:প্রতিস্থাপিত হয়েছে দেখতে চাই। তিনি আরো বলেন, ইতিহাসে যার যা অবদান, কৃতিত্ব ত্যাগতিতিক্ষা তা স্বীকার করে তাকে সেই সম্মান স্বীকৃতি আমাদের অবশ্যই দিতে হবে। দ্যাট শুড বি দ্য এ্যাটিচুড অব এভরিবডি ইনক্লুডিং পলিটিসিয়ানস । (রাজনীতিকসহ সবারই এই ধরনের মন-মানসিকতা ও অভিব্যক্তি থাকা বাঞ্চনীয়)

বিভাজনের অপরাজনীতির কারণে এবং দলগত ও ব্যক্তিগত শত্রুতা এবং পরশ্রীকাতরতার বশবর্তী হয়ে রাজনীতির শাশ^ত আদবকায়দা রীতিনীতি শালীনতাবোধ ইত্যাদি আমরা বিস্মৃত হই। তাইতো আমাদের আপাতদৃষ্টে দুর্ভাগা এই দেশটার কাঙ্খিত উন্নয়ন অগ্রগতি হয়নি। বিশ^দরবারে ক্রমে ক্রমে পিছিয়ে পড়ছি। দেশ ও জাতির এ বিষদৃশ পরিস্থিতি আমরা আর দেখতে চাইনা।

৫৩তম মহান বিজয় দিবসের পূর্বাহ্নে প্রত্যাশা করি, সংশ্লিষ্ট সব মহলেরই শুভবুদ্ধির উদয় হবে। আমাদের প্রিয় মাতৃভ’মিতে গণতন্ত্র, মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা এবং জনগণের কর্তৃত্ব আবারো প্রতিষ্ঠিত হবে। সব্বাইকেই মহান বিজয় দিবসের হার্দিক শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন জানাচ্ছি।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কুমিল্লা প্রেস ক্লাব ।
মোবাইল: ০১৭৩১-৫১২৭২২ এবং ০১৫৫২-৩২০৯৫৭

 

আরো পড়ুন