ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কমছে পানি, বাড়ছে দুর্ভোগ

এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া ও কসবায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। উজানে বৃষ্টিপাত কমতে থাকায় পানি কমে আসছে। ভারতের ত্রিপুরায় পানি বিপদ সীমার নিচে নেমে আসায় হাওড়া এবং সালদা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে হাওড়ার পানি অবস্থান করছে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার নিচে। ফলে নতুন করে আর কোনো গ্রাম প্লাবিত হয়নি। তবে পানি কমলেও কমেনি দুর্ভোগ। দুই উপজেলার আটটি ইউনিয়নের ৬০ টিরও বেশি গ্রামের পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ এখনও পানিবন্দি।
ভারী বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির তোড়ে আখাউড়ার হাওড়া নদীর বাঁধের তিনটি অংশসহ আট স্থান ভেঙ্গে যাওয়া এবং কসবায় সালদা নদী দিয়ে প্রবল বেগে উজান থেকে পানি নেমে আসার কারণে আচমকা এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) রাত থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করে। ফলে নতুন করে আর কোনো এলাকা প্লাবিত হয়নি। এছাড়া হাওড়া ও সালদা নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। তবে এখনও পর্যন্ত পানিবন্দি অবস্থায় আছে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ। চুলা ডু্বে যাওয়ায় রান্না করতে না পেরে শুকনো খাবার খেয়েই দিন কাটছে পানিবন্দি মানুষের। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ১২ সেন্টিমিটার পানি কমেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছেন। ফলে বন্যা পরিস্থিতি ক্রমশই উন্নতি হচ্ছে। হাওড়ার পানি এখন অবস্থান করছে বিপদ সীমার ৩৫ সেন্টিমিটার নিচে। উজানে বৃষ্টিপাত কমতে থাকায় পানি কমে আসছে। কেন্দ্রীয় তথ্য অনুযায়ী আগামী ২৪ ঘণ্টায় পানি আরও কমবে। ভারতের ত্রিপুরায় পানি বিপদ সীমার নিচে নেমে আসায় আমাদের জন্যে সুখবর।
স্থানীয় এলাকাবাসী এবং প্রশাসন সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার রাত থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় ভারী বর্ষণ শুরু হয়। বুধবার সকালে স্থলবন্দরের পাশের কালন্দী খাল দিয়ে ভারত থেকে তীব্র বেগে পানি ঢুকতে থাকে। পানিতে তলিয়ে যায় আখাউড়া স্থলবন্দর এলাকাসহ ১০টি গ্রাম। ভেঙে যায় গাজীরবাজার এলাকার অস্থায়ী বেইলি সেতু। বন্ধ হয়ে পড়ে স্থলবন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও যাত্রী পারাপার। বুধবার রাতে আবারও প্রবল বৃষ্টি হলে কর্ণেলবাজার এলাকার আইড়ল-ইটনা সড়কের হাওড়া নদীর বাঁধের কয়েকটি অংশ ভেঙে যায়। এতে করে নতুন করে আরও কিছু এলাকা প্লাবিত হয়। উপজেলার বীরচন্দ্রপুর, আবদুল্লাহপুর, বঙ্গেরচর, রহিমপুর, সাহেবনগর, ইটনা, খলাপাড়া, কর্ণেলবাজার, উমেদপুর, সেনারবাদী, কুসুমবাড়ি, আওরারচর, ছয়ঘরিয়া, বাউতলা, দরুইন, বচিয়ারা, নোয়াপাড়া, নিলাখাদ, টানুয়াপাড়া, ধাতুরপহেলা, চরনারায়ণপুর, ভাটামাথা, চন্দ্রপুর,ধরখার,বিনাউটি, ভবানীপুর, খারকুট, মিনারকুট, কুড়িবিল, পদ্মবিল, টনকি, সহ অন্তত ৩৫টির বেশি গ্রামে পানি ঢুকে পড়ে। পানিবন্দি হয়ে পড়ে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফসলি জমি, শাকসবজির জমিসহ মাছের ঘের। হাওড়ার বাঁধ ভাঙ্গা পানিতে পার্শ্ববর্তী কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামও প্লাবিত হয়। অপরদিকে সালদা নদী দিয়ে প্রবল বেগে পাহাড়ি ঢলের পানি নামার প্রভাবে উপজেলার বায়েক ও কায়েমপুর ইউনিয়নের প্রায় ২০ টি গ্রাম প্লাবিত হয়। হাওড়া ও সালদা নদী দিয়ে পাহাড়ি ঢলের পানির প্রভাবে দুই উপজেলার আটটি ইউনিয়নের ৬০টিরও অধিক গ্রাম প্লাবিত হয়। তবে বৃহস্পতিবার রাত থেকে পাহাড়ি ঢলের পানির বেগ কমায় এবং বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। দুর্গত এলাকাগুলো থেকে সরতে শুরু করেছে বানের পানি।
আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের খলাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নারগিস আক্তার জানান, ‘গত বুধবার মধ্যরাতে হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে পানির তোড়ে আমাদের বসতঘর ভেসে যায়। কোনো জিনিসপত্রই রক্ষা করতে পারিনি। বর্তমানে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। পানিতে ঘরের জায়গার মাটি সরে যাওয়ায় নতুন করে ঘরও বানাতে পারবো না।’ আঙ্গুরা বেগম জানান, ‘গতকাল রাত থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। তবে রান্নাঘর এখনও পানিতে ডুবে আছে। ফলে রান্না করা যাচ্ছে না। তাই দোকান থেকে চিড়া-মুড়ি কিনে এনে খাচ্ছি।’আবুল কাশেম নামের প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, ‘ঘর থেকে পানি নেমে গেলেও বাড়ির উঠানে পানি জমে আছে। এর ফলে বাড়ি থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির শিশুদের নিয়ে দু:শ্চিন্তা বেশি, কখন পানিতে পড়ে বিপদ ঘটে।’
বৃহস্পতিবার রাত থেকে পাহাড়ি ঢলের পানির বেগ কমায় এবং বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। দুর্গত এলাকাগুলো থেকে সরতে শুরু করেছে বানের পানি। তবে পানি পুরোপুরি না সরায় মানুষজনের দুর্ভোগ কমেনি। এদিকে হাওড়া নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে বিপদ সীমার ৩৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বন্যার পানি কমলেও কমেনি দুর্ভোগ। জেলার দুই উপজেলার আটটি ইউনিয়নের ৩৬ টিরও বেশি গ্রামের পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ এখনও পানিবন্দি। তাছাড়া রান্নার চুলা ডু্বে যাওয়ায় রান্নাবান্নার অভাবে শুকনো খাবার খেয়েই দিন কাটছে পানিবন্দি মানুষদের।
আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজালা পারভীন রুহি বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। দুর্গত এলাকায় প্রশাসন থেকে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম চলাম আছে। পানি কমে গেলে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করে যান চলাচলের উপযুক্ত করা হবে।’
কসবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ শাহরিয়ার মুক্তার জানান, আখাউড়ার হাওড়া নদীর বাঁধ ভাঙ্গা এবং সালদা নদী দিয়ে উজান থেকে প্রবল বেগে পানি নামার কারণে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের (গোপীনাথপুর, কায়েমপুর, বায়েক) প্রায় ২৬ টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী এবং জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত হয়। বায়েক ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মানুষ আটকে পড়ে। দুর্গত মানুষের জন্য খোলা হয় ছয়টি আশ্রয় কেন্দ্র। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) রাতে কসবা ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা বায়েক থেকে পানিবন্দী থাকা ২৮ জন শিশু, দুইজন গর্ভবতীসহ মোট ১২১ জনকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠায়। শুক্রবার সকালে ওই এলাকার পানি কমতে শুরু করেছে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্বে) মনজুর রহমান শুক্রবার দুপুরে জানান, ‘হাওড়া নদীর পানি ৯ সেন্টিমিটার কমেছে। এখন পানি বিপদ সীমার ৩৫ সেন্টিমিটার নিচে অবস্থান করছে। উজানে বৃষ্টিপাত কমতে থাকায় পানি কমে আসছে। কেন্দ্রীয় তথ্য অনুযায়ী আগামী ২৪ ঘণ্টায় পানি আরও কমবে। ভারতে বিপৎসীমার নিচে পানি নেমে আসায় আমাদের জন্যে সুখবর।’