ভয়াল সেই দিনগুলো আর না ফিরুক

মহিউদ্দিন আকাশ ।।
আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই শ্লোগানে মুখর ঢাকা -চট্টগ্রাম মহাসড়ক। বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে তাল মিলিয়ে শ্লোগান দিচ্ছে স্কুল শিক্ষার্থীরাও। অন্যদিকে পুলিশ, র্যাব,বিজিবির সতর্ক অবস্থান। দীর্ঘক্ষণ ধরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক অবরোধ করে রাখা শিক্ষার্থীদের সরাতে মরিয়া পুলিশ কিন্তু তারুণ্যের বিক্ষোভের কাছে পরাজিত তারা।
সড়ক অবরোধ করে শ্লোগানে মুখর ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কের চিত্র বদলে গেলে কয়েক মিনিটেই অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যদের মুহুর মুহুর টিয়ার গ্যাস আর সাউন্ড গ্রেনেডে যুদ্ধক্ষেত্রে রুপ নিল কোটবাড়ি বিশ্বরোড। ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কজুড়ে রায়ট কন্ট্রোল ভ্যান, ট্যাংক আর অস্ত্রে সজ্জিত পুলিশ, র্যাব! এ যেন যুদ্ধক্ষেত্র।
লাইভে সংযুক্ত ছিলাম। দুপক্ষের সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে গেলাম মিনিটের মধ্যেই। হঠাৎ চোখ জ্বালাপোড়া শুরু করল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। তবুও হামাগুড়ি দিয়ে ফুটওভার ব্রিজ পাড়িয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কে গিয়ে শ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলাম। এরই মাঝে পুলিশ গুলি করতে করতে এদিকে আসতে শুরু করল। কে সাংবাদিক! কে শিক্ষার্থী? ভেদাভেদ নেই। সবাই যেন নিষ্ঠুর পুলিশের টার্গেট!
আরেকটু সামনে এগুতে দেখলাম অসংখ্য শিক্ষার্থী রক্তাক্ত, কেউ কেউ টিয়ারগ্যাসের কারণে চোখেমুখে পানি দিচ্ছে। কেউবা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়ে আছে।
এরই মাঝে দেখলাম কবি নজরুলের সুরে-
ওরে ও পাগলা ভোলা,দে রে দে প্রলয় দোলা,
গারদগুলা জোরসে ধরে হ্যাচকা টানে,মার হাঁক হায়দরী হাঁক
কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক,ডাক ওরে ডাক মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে।।
গান গেয়ে ইট পাটকেল মারতে মারতে ধাওয়া দিচ্ছে রাষ্ট্রের রক্ষক নামের ভক্ষকদের।
শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে পুলিশ, বিজিবি পিছু হটে আবার শক্তি সঞ্চার করে সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি করতে করতে আগায়। প্রায় ৪/৫ ঘন্টা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শেষে কিছু বিজিবি সদস্য এগিয়ে আসে সমঝেতার আহবান নিয়ে। সাথে পুলিশের কয়েকজনকে আসতে দেখে জনগণ ধাওয়া দিয়ে বিজিবির ট্যাংকে আগুন ধরিয়ে দেয়।
পিছু হটে পুলিশ বিজিবি ও র্যাাব। মিছিল আর উত্তাল শ্লোগানে আবারো প্রকম্পিত হয় কোটবাড়ি বিশ্বরোড। ঢাকা থেকে ঘোষণা আসে আজকের মত কর্মসূচি সমাপ্ত কাল সারাদেশে গায়েবানা জানাজা। এরপরই প্রশাসনের আহবানে সমঝোতায় আসে শিক্ষার্থীরা। পুলিশ বিজিবি র্যাাব একদিকে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই ক্লান্ত শরীরে স্বস্বস্থানে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের অগোচরে রাজপথ থেকে গন্তব্যে ফেরা শিক্ষার্থীদের ভিডিও ধারণ করছিলেন তৎকালীন কুমিল্লা ডিবির ওসি রাজেশ বড়ুয়া সঙ্গ দিচ্ছিলেন ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট কয়েকজন সাংবাদিক।

বলছিলাম ১৮ জুলাইয়ের কথা। সেই ধারণকৃত ভিডিও দেখে দেখে রাতভর কুমিল্লার বিভিন্ন বাসা,মেসে গ্রেফতার অভিযান চালায় পুলিশ। বিএনপি ও জামায়াতের নেতাসহ ১ হাজারেরও বেশি ছাত্র জনতা আটক হয়।
বিকেল থেকে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ। মুঠোফোনে যোগাযোগ করে শিক্ষার্থীরা পরদিন সকল ক্যাম্পাসে গায়েবানা জানাজা পড়ে।
এরই মাঝে হল ছাড়তে বাধ্য হয় শিক্ষার্থীরা। এগিয়ে আসে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বেরুবে দুপুর ২ টায়। আমরা বেশ কয়েকজন সাংবাদিক রওয়ানা হলাম। শহর থেকে একটু এগুতেই দেখলাম দৌলতপুর মোড়ে অস্ত্র হাতে মহড়া দিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। প্রত্যেক সিএনজি অটোরিকশা ও গাড়িগুলো চেক করছে। সন্দেহ হলেই মারধর করে ফিরিয়ে দিচ্ছে। সাংবাদিক পরিচয় পত্র গলায় ঝুলানো থাকায় আমরা বেঁচে গেলাম। তবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় যেতে যেতে প্রতিটি মোড়ে মোড়ে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের অস্ত্র হাতে মহড়া দেখে মনে হচ্ছিল আজকের কর্মসূচি হয়তো হচ্ছে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে থমকে গেলাম। চতুর্দিকে হামলা, হায়েনার থাবা উপেক্ষা করে শত নয় হাজার শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে শ্লোগান দিচ্ছে।
দুই দিক থেকে আওয়ামী লীগ ঘেরাও করে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করে। পরবর্তীতে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে বিশ্বরোডের দিকে এগুতেই পালিয়ে যায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা।
এরকম করে চলতে থাকে আন্দোলন। দেশব্যাপী গ্রেফতার, নেটওয়ার্ক বন্ধ, যেন যুদ্ধ চলছে।
নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে জুলাই পেরিয়ে আসে আগস্ট। পহেলা আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় জামায়াত শিবির। আলাদা কোন কর্মসূচি না দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
৩ আগস্ট কুমিল্লা জিলা স্কুলে আওয়ামী লীগের গণহত্যা নিয়ে গ্রাফিতি ও চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে ছাত্র জনতা। সেদিন সন্তানদের সাথে রাজপথে নেমে এসেছিলেন মা-বাবারাও।
জিলা স্কুলে অবস্থানকালে কান্দিরপাড় ও ঈদগাহ দুদিক থেকেই শিক্ষার্থীদের ঘিরে ফেলে অস্ত্র সজ্জিত আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। জিলা স্কুলের গেইট আটকে আতঙ্ক তৈরি করে। গেইটের তালা ভেঙে রাজপথে শ্লোগান দিতে থাকে শিক্ষার্থীরা। দুদিক থেকেই গুলি করতে থাকে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। অবরুদ্ধ শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে অভিভাবক,সচেতন জনতা পুলিশ লাইন্সে জড়ো হতে থাকে। মিছিল নিয়ে জিলা স্কুলের সামনে থেকে শিক্ষার্থীদের উদ্বার করে আবারো পুলিশ লাইন্স মোড়ে অবরোধ করে শ্লোগান দিচ্ছিল ছাত্র – জনতা। ঝাউতলায় জড়ো হয়ে গুলি আর লাঠিসোটা নিয়ে ছাত্র জনতাকে ধাওয়া দেয় আওয়ামী লীগ। নিরস্ত্র ছাত্র ছাত্রীরা গুলির মুখে টিকতে না পেরে দিক বিদিক ছুটতে শুরু করে। ড্রেনে পড়ে ছাত্রীদের অসহায় আর্তচিৎকারে কেঁপে উঠে কুমিল্লা।
সেদিন আওয়ামী লীগের প্রকাশ্যে গুলি,রামদা, হকিস্টিক, দা,ছেনির আঘাতে অসংখ্য শিক্ষার্থী জখম হয়। বাদ যায়নি ছাত্রীরাও। পশুর মত ছাত্রীদের পিটিয়ে হাত পা ভেঙে দেয় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। আমার পরিচিত ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হাজী শাহাজান ভাইয়ের মেয়েসহ অসংখ্য ছাত্রীর হাত পা ভেঙে দেয় সন্ত্রাসীরা। আঙ্কেল বাঁচান! বাঁচান চিৎকার যেনো আজও কানে ভাসে। কি ভয়াল দৃশ্য দেখতে হয়েছে আমাদের।
আমার ছোট ভাই ফয়সালসহ ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থীরা বাগিচাগাঁও এর দিকে দৌড়ে আশ্রয় নিতে গেলে সেখানেও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে জখম করে। আওয়ামী লীগের বর্বতার ভিডিও ধারণকালে সাপ্তাহিক আমোদ ও আকাশ টিভির মোবাইল ভাঙচুর করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী।
ফের আওয়ামী লীগকে ধাওয়া দেয় শিক্ষার্থীরা। সারাদেশে দাগ কাটে কুমিল্লার এই বর্বরতা।
সারাদিন নিউজ সংগ্রহ ও লাইভ করে নিজেদের সবচেয়ে অসহায় আর নিরুপায় নিরীহ মনে হত।
বাসার গলিতে হেটে যাওয়ারও সাহস হত না। সেই ভয়াল সময়গুলোতে বাসার গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতেন ময়মনামতি নিউজের সম্পাদক গিয়াসউদ্দিন ভাই।
৪ আগস্ট সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি। রাতভর নানান হুমকি ধমকি! পুলিশের হুঙ্কার তবুও খুব সকালেই বাসার গেইটে হেলমেট আর মোটরসাইকেল নিয়ে হাজির সাংবাদিক গিয়াসউদ্দিন। ভয় আর আতঙ্কের মধ্যেও সংবাদ সংগ্রহে বেরিয়ে পড়লাম। মহাসড়কে গাড়ি নেই মানুষও নেই।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী থেকে জানালো নাজিরা বাজার তারা অবস্থান করছে। কুবি শিক্ষার্থীদের কোথাও না দেখে আমরা চলে গেলাম নাজিরা বাজার।
দক্ষিণ জেলা বিএনপির বর্তমান সদস্য সচিব ভিপি আশিকুর রহমান মাহমুদ ওয়াসিম ও মহানগর বিএনপির আহবায়ক উৎবাতুল বারী আবুর নেতৃত্বে বিএনপি ও জামায়াতের কয়েক হাজার নেতাকর্মী ও ছাত্র জনতা মিছিল নিয়ে ক্যান্টেমেন্ট পার হচ্ছে।
বিক্ষুব্ধ জনতার চোখ রাঙানো শ্লোগানে কাঁপছে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণিত এলাকা। ঐ দিকে কোটবাড়ি বিশ্বরোডে অবরুদ্ধ ছাত্র জনতাকে উদ্ধার করতে যাচ্ছিল ওয়াশিম আবু নেতৃত্বাধীন মিছিল। আলেখারচর বিশ্বরোড পার হতেই বৃষ্টির মত গুলি করতে থাকে আওয়ামী লীগের প্রশিক্ষিত ক্যাডার বাহিনী। গুলির মুখে ইট পাটকেলে কতক্ষণ টিকে থাকা যায়?
পুলিশ না থাকলেও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে নিরব ভুমিকা পালন করছিল বিজিবি।
আওয়ামী লীগের নেতা কুমিল্লা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম টুটুলসহ শ’খানেক অস্ত্রধারী গুলি করতে করতে সেনাবাহিনীর গেইট অতিক্রম করে ক্যান্টমেন্টে গুলি করতে থাকে।
গুলি শেষে ফিরে যাচ্ছিল আওয়ামী লীগ। গুলির মুখে বিভিন্ন গলিতে অবস্থান নেওয়া বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মী ও সাধারণ ছাত্র জনতা বেরিয়ে এসে সেনাবাহিনীর গেইটে শ্লোগান দিতে থাকে, এ মুহূর্তে দরকার, সেনবাহিনীর সরকার। সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক বেরিয়ে আসে,ট্যাঙ্কে উঠেও চলে জনতার শ্লোগান। সেনবাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে এগুচ্ছে জনতাও শ্লোগান দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আলেখারচর যেতেই আবার গুলি শুরু করে আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী। শ্লোগান আর ইটপাটকেলে জবাব দেয় জনতা। আবারো বৃষ্টির মত আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা গুলি শুরু করলে ৫০ রাউন্ড গুলি ছুড়ে সেনবাহিনী। পিছু হটে আওয়ামী লীগ। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে ছাত্র জনতা।
রাবার বুলেটে আহত সাংবাদিক গিয়াসউদ্দিন ভাইসহ ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত শরীরের বসে আছি ছাত্র জনতার মাঝে। এমন সময় খাবার এগিয়ে দিলেন বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবিরের কুমিল্লা উত্তর জেলা সভাপতি আব্দুল আলিম।।
ছাত্রদল ছাত্রশিবির ও সাধারণ ছাত্র জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছিল সীসাঢালা প্রাচীরের মত।
বোরকা পরিহিত কিছু মহিলাকে দেখলাম ক্লান্ত ক্ষুধার্ত যোদ্ধাদের খেজুর, বিস্কুট,পানি বিতরণ করছেন। ওনারা কে বা কারা তার পরিচয় না পেলেও সবাই গ্রহণ করছেন সানন্দে। আবার লড়ছে নতুন সতেজতা নিয়ে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হলেও কুমিল্লা থেকে আওয়ামী লীগ পালিয়ে গিয়েছিল ৪ তারিখ বিকেলেই
কত সহজে হয়ে গেল বলা! অথচ আরো কত ঘটনা লুকিয়ে রয়েছে হৃদয়ে। ভয়াল সেই দিনগুলো চোখে ভাসলে বুক কেঁপে উঠে। আর না ফিরুক ভয়াল সেই দিনগুলো।
লেখক:সম্পাদক,আকাশ টিভি।