সাংবাদিক মুন্নি সাহার গ্রেপ্তার ও দুটি কথা
।। গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপু।।
আমাদের দেশে বলা হয়, কেউই আইনের উর্ধে নন। যদিও বাস্তবক্ষেত্রে সেটির বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রেই মারাত্মকভাবে ‘লংঘন’ হতে দেখি।
মুন্নি সাহার গ্রেপ্তার, তাকে মধ্যরাতে ছেড়ে দেয়া ও তার সম্পদের হিসাব নিয়েও ‘আইন যে সবার জন্য সমান নয়’ সেটি আবার নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে। এ নিয়ে অসংখ্য লেখাও ইতিমধ্যে পড়েছি। হাতেগুণা ২/১টি লেখাতে ভিন্নতা পেলেও, বেশীর ভাগ লেখার বিষয়বস্তু, উদ্যেশ্য প্রায় একইরকম দেখতে পেয়েছি।
আমি একটি উপজেলায় গত ২৮ বছর ধরে ‘সংবাদ শ্রমিক’ হিসেবে কাজ করছি।
আমার অবশ্য এসব নিয়ে লেখার এত জ্ঞান ও পড়াশুনা নেই।
এরপরও আমার কয়েকজন শুভাকাংখীর অনুরোধে, বিষয়টি নিয়ে একটু বিলম্ব হলেও দুটো কথা লেখার এই প্রয়াস।
দেখুন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগ সরকারের বিগত ১৬ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় একদিকে যেমন চেখে পড়ার মতো সর্বক্ষেত্রে ‘ডিজিটাল’ উন্নতি ও বিস্তৃতি ঘটতে দেখেছি, তেমনি এই ১৬ বছরে ‘দলবাজি ও লেজুরবৃত্তি’র সাংবাদিকতার চূড়ান্ত রূপ নেয়ার নির্লজ্ব নজিরও কিন্তু আমরা দেখেছি। সেসময় এদেশের নামকরা, খ্যাতিমান, স্বনামধন্য, অনেক বাঘাবাঘা সাংবাদিকদেরকেও তাদের কর্মযজ্ঞে দলবাজির উৎকৃষ্ট প্রমাণ পেয়েছি।
পাশাপাশি টকশোতে এসে বিগত সরকারের পক্ষে সুবিধাভোগীরা মন্ত্রের মতো মুখস্ত গতবাধা স্তুতিপাঠ করতেও দেখেছি। এমনকি, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে সেইসব স্বনামধন্য, অত্যন্ত মেধাবী, অভিজ্ঞ সিনিয়র সাংবাদিকদের অনেকেরই নির্লজ্বভাবে চাটুকারিতার প্রতিযোগিতাও ছিলো নজিরবিহীন।
এসব দেখে একজন সত্যিকারের সৎ, নির্লোভ, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল, ব্যক্তিত্ববান ও পেশাদার যে কোন সাংবাদিক সেসময়ে যে দারুণভাবে বিব্রত ও লজ্জিত হতেন, সেটি আমি হলফ করেই বলতে পারি।
এবার আসি আমার লেখার মূল প্রসঙ্গে। সম্প্রতি সাংবাদিক মুন্নির সাহার গ্রেপ্তার, আবার মধ্যরাতে তাকে ছেড়ে দেয়া এবং ব্যাংকে তার এত টাকা কিভাবে লেনদেন হয় ও জমা থাকে, সেসব নিয়েও বিস্তর লেখালেখি হয়েছে এবং এখনও তা চলছে?
যদিও ব্যাংকের লেনদেন ও টাকার মালিক নাকি মুন্নি সাহা নন। মূলত সেসবের মালিক তার স্বামী! সেসব নিয়েও কেউ কেউ বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন।
দেখুন, আমরা তো রাজধানি ঢাকায় সাংবাদিকতা করিনা, থাকি মফস্বলে, একটি উপজেলা সদরে। যেটুকু তথ্য পাই, সেটুকু বিভিন্ন লেখা পড়ে ও লোকমুখে শুনে জানতে পারি।
সেইসব লেখা পড়ে ও অনেকের মুখে শুনে জানতে পেরেছি, ঢাকার নামকরা স্বনামধন্য বাঘাবাঘা সাংবাদিকদের ‘নাকি’ রাজধানীতে একাধিক গাড়ি বাড়ি সহ ব্যাংকে শত কোটি টাকা জমা আছে।
যদিও আজকাল এই ডিজিটাল জামানায় রাজধানির বাইরেও দেশের বিভাগীয় শহর, জেলা শহর এমনকি উপজেলা শহরেও ‘নাকি’ সাংবাদিকতা পেশায় যুক্তদের অনেকেই এমন সব অর্থ বিত্ত বৈভবের অধিকারী হয়েছেন!
তবে এসব ‘শোনা’ অভিযোগ আসলেই কতটা সত্য, দুদকসহ সেটি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ গুরুত্ব দিয়ে যদি খতিয়ে দেখে দেশের ১৮ কোটি সাধারণ মানুষের সামনে সেসব বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হত, তাহলে বিষয়টি জনগণের কাছে একদম পরিষ্কার হয়ে যেত।।
যাক্ যেটি বলছিলাম, আপনারা নিশ্চয় জানেন, মুন্নি সাহা গ্রেপ্তার হওয়ার আগে একাত্তুর টিভির সাংবাদিক দম্পতি ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদ গ্রেপ্তারের পরও এই দম্পতির ধন সম্পদের পরিমাণ বিভিন্ন লেখায় পড়ে রীতিমত ‘তাজ্জব’ বনে গেছি।
আসলেই কি এসব তথ্য সত্য??
বলি, এত শত কোটি টাকা ও এত গাড়ী বাড়ি সহায় সম্পত্তির “মালিক” একজন সাংবাদিক কি করে হন??
যদিও মুন্নি সাহা গ্রেপ্তারের পর মধ্যরাতে আবার ছাড়া পেয়ে এখন মুক্ত জীবনে থাকা, তিনি ১৩৪ কোটি টাকার বিষয়ে তার ফেসবুকে একটি বিশদ ব্যাখা দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন।
আমরা মনে করি, এরপরও সরকারের পক্ষ থেকে এসবের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া খুবই দরকার।
তাই বর্তমান অন্তবর্তীকালীন এই নির্দলীয় সরকারের কাছে আমার একটি বিশেষ অনুরোধ থাকবে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগের একটি সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক। যেহেতু কোন দলীয় সরকারের পক্ষেই সাংবাদিকদের অনৈতিকতার বিরুদ্ধে বিশেষ করে রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকা দলের যারা অনুগত, চাটুকার, দলকানা থাকেন তাদের বেলায় বড় ধরণের কোন ব্যবস্থা নেয়া সাধারণত সম্ভব হয়না। সেহেতু বর্তমান নির্দলীয় সরকার একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন গ্রহণযোগ্য তদন্ত কমিটি গঠন করে রাজধানীসহ সারাদেশে কোন্ কোন্ সাংবাদিক অবৈধ উপায়ে কাড়ি কাড়ি টাকা কামিয়ে বাড়ি গাড়িসহ “আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ” হয়েছেন, তাদের একটি সুনির্দিষ্ট তালিকা করা হোক।
পাশাপাশি তালিকা তৈরীর পর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে থাকা অনৈতিকতা বিষয়ে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে, সেইসব সাংবাদিক নামধারী ধান্ধাবাজ, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর দৃষ্টান্তমূলক আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হোক এবং দুর্নীতিবাজ সেইসব সাংবাদিকদের নামের তালিকাটিও জনসম্মুখে ছবিসহ প্রকাশ করা হোক।
যা দেখে ভবিষ্যতে ‘রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ’ খেতাব পাওয়া অত্যন্ত সম্মানজনক এই মহান পেশার অধিকারী জাতির বিবেক খ্যাত সাংবাদিকেরা কখনও আর অবৈধ পথে কাড়ি কাড়ি টাকা কামিয়ে এতটা ‘প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত’ হবেন না।
আর যদি সুষ্ঠু তদন্তে মুন্নি সাহা, ফারজানা রূপা, শাকিল আহমেদ সহ যে কারও বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া না যায়, তাহলে তাদের সবাইকে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে এসব গতবাধা মুখস্ত অভিযোগ থেকে দ্রুত অব্যাহতি দেয়া হোক।
যাতে আমরা সাধারণ সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে অব্যাহতি পাওয়া সেইসব সাংবাদিক ভাই বোনদেরকে ঘটা করে জনসম্মুখে ‘নাগরিক সংবর্ধনা’ প্রদান করতে পারি।
ঈশ্বর সবার মঙ্গল করুন।
অপ সাংবাদিকতা দূর হোক,
সুসাংবাদিকতার জয় হোক।।
লেখক-
গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপু
যুগ্ম আহবায়ক
বাংলাদেশ সাংবাদিক কমিউনিটি
(বিএসসি) কেন্দ্রীয় পরিষদ
সিনিয়র সাংবাদিক
প্রতিদিনের বাংলাদেশ
(সাবেক কর্মস্থল প্রথম আলো
ও কালের কণ্ঠ)
সম্পাদক, নবীনগরের কথা।