বরুড়ার ১০ গ্রামে হোগলা পাতার পাটি তৈরির উৎসব

মহিউদ্দিন মোল্লা।।

 কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার ১০টিরও বেশি গ্রামে তৈরি হয়। স্থানীয় ভাষায় এই পাটিকে (বিছানা) ধারি বলা হয়। শত বছর ধরে চলা এই হাতের কাজে প্রায় দুই হাজার পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা। 

গ্রামগুলো বরুড়া উপজেলার শাকপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। উল্লেখযোগ্য গ্রামগুলো হচ্ছে, মধ্য লক্ষীপুর, কাঞ্চনপুর, কাঁচিয়া পুকুরিয়া, রাজপুর, জাগরিয়া ও নিশ্চিন্তপুর। তার মধ্যে বেশি পাটি বানানো হয় মধ্য লক্ষীপুর গ্রামে। এই পাটি বিক্রির জন্য স্থানীয় মধ্য লক্ষীপুর বাজারে সপ্তাহে দুই দিন পাটি বিক্রির হাটও বসে।

সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, বরুড়া পৌরসভার পাশের ইউনিয়ন শাকপুর। এই ইউনিয়নের মধ্য লক্ষীপুর গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে নারী পুরুষরা ব্যস্ত পাটি তৈরিতে। পাটির পাতা বোনার সাথে তারা নিজেদের স্বপ্নও বুনে থাকেন। এই পাটি বিক্রির আয়ে পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হয়। মাঠে চাষ করা হোগলা পাতা কাটছেন কেউ কেউ। কেউ সেগুলো পরিষ্কার করছেন। কেউ শুকাতে দিচ্ছেন। শুকনো পাতা দিয়ে পাটি বোনায় ব্যস্ত নারীরা।

 

পান চিবুতে চিবুতে নানা গল্প করতে করতে হাতও চলছে দ্রুত। ঘরে বাইরে হোগলা পাতা ও তৈরি পাটির স্তূপ। সারা বছরই এখানে পাটি তৈরির উৎসব দেখা যায়।

মধ্য লক্ষীপুর গ্রামে বাজার রয়েছে। সেখানে সোমবার ও শুক্রবার দুপুরে দুইদিন পাটি বিক্রির হাট বসে। সোমবার বাজারে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় বিক্রেতারা পাটি নিয়ে বসে আছেন। চলছে হাঁকডাক। বাইরের পাইকারি ক্রেতারা দরদাম করছেন। কেনা শেষে পাটিগুলো পিকআপ ভ্যানে তুলছেন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে এই পাটির চাহিদা বাড়ে। বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এই পাটি বিছানো হয়। আগে মসজিদ মন্দিরে হোগলা পাতার বিছানা বেশি ব্যবহার হতো। এখন সেখানে স্থান নিয়েছে কার্পেট ও প্লাস্টিকের মাদুর। তবে নির্মাণাধীন ভবনের কাজে,কোরবানির মাংস কাটায়,গ্রামের নিম্নবিত্তের পরিবারে এই পাটির চাহিদা রয়েছে।  

মধ্য লক্ষীপুর গ্রামের সন্ধ্যা রানী বলেন, তার শ্বশুরের সময় থেকে তারা পাটি তৈরি করেন। এখন তিনি ছেলে, ছেলের বউসহ পরিবারের পাঁচজন পাটি তৈরি করেন। একজনে দিনে চারটি পাটি তৈরি করতে পারেন। যারা বেশি কাজ করেন তারা পাঁচটি পর্যন্ত তৈরি করতে পারেন। প্রতিটি পাটি তারা বাজারে ৭০/৭৫ টাকায় বিক্রি করেন। এই পাটি বিক্রির আয় দিয়ে তাদের পরিবার চলে।

বাজারে পাটি বিক্রি করতে আসা নিখিল চন্দ্র সরকার বলেন, তাদের পরিবারে শত বছর ধরে পাটি তৈরি হয়। তারা নিজেরা পাটি তৈরি করেন। আবার অন্যদের মজুরি দিয়েও তৈরি করান। প্রতি পাটি তৈরিতে মজুরি দিতে হয় ২৫ টাকা। তখন লাভ কম হয়। নিজেরা তৈরি করলে প্রতিটিতে ৩০টাকা লাভ পান। তিনি প্রতি হাটে ৪০টি পাটি আনেন। পাটি বিক্রি করে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা আয় করেন।

দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ বাজার থেকে আসা পাইকারি ক্রেতা কামাল হোসেন বলেন, কুমিল্লার আর কোথাও হোগলা পাতার পাটি তৈরি হয় না। আমরা এগুলো কিনে নিয়ে দোকানে বিক্রি করি। প্রতিটি খুচরা ১০০/১২০টাকায়।

মধ্য লক্ষীপুর বাজার কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মন্তাজ মিয়া বলেন, ১৯৬২ সালে এই বাজার শুরু হয়। এর আগে এই এলাকার হোগলা পাতার পাটি বরুড়া বাজারে বিক্রি হতো। এখন লক্ষীপুর বাজারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার ক্রেতারা এসে নিয়ে যান। করোনার সময় গাড়ি চলাচল না থাকায় এই এলাকার পাটি তৈরির কারিগররা কর্মহীন হয়ে পড়েছিলো। সরকারের প্রণোদনা পেলে তারা উপকৃত হবে।

শাকপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বলেন, এই ইউনিয়নের ১০টির বেশি গ্রামে হোগলা পাতার চাষ, পাটি তৈরি ও বিক্রি করা হয়। এই পেশার সাথে দুই হাজারের বেশি পরিবার জড়িত। তাদের সহযোগিতার জন্য উপজেলা পর্যায়ে আবেদন জানিয়েছি।

বরুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনিসুল ইসলাম বলেন, সমাজসেবা কার্যালয় থেকে তাদের বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা দিয়ে থাকে। তাদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে সহযোগিতার চেষ্টা করবো।