‘মাছের নেশার কাছে শীত আর গরম কিছু না’

 

মাহফুজ নান্টু ।

বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা ডিঙি নৌকা। চলছে রান্নার প্রস্তুতি। ছোট মাছ ও বেগুন দিয়ে রান্না। নদীর পানিতেই চাল ধুয়ে নৌকার মধ্যেই রান্না। ছোট মাছগুলো নদী থেকেই শিকার করা।
রান্না শেষ হলে ভাত খেয়ে ঘুম। সারা দিন ঘুমিয়ে সন্ধ্যায় উঠে চলবে মাছ ধরার প্রস্তুতি। কুয়াশাঝরা শীতের রাতে ডিঙি নৌকা বেয়ে চলবে মাছ শিকার। সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া মাছ শিকার ভোর পর্যন্ত চলবে। রাতভর যে মাছ পাওয়া যাবে তার সিংহভাগ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে বাকিটুকু নিজেদের খাওয়ার জন্য রেখে দিবেন।
গোমতী নদীতে এভাবেই মাছ শিকার করে ৪০ বছর পার করলেন হোসেন ও জাহাঙ্গীর মিয়া। এ দুজনের বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জে। মাছ শিকার করে বাজারে বিক্রি করে পরিবার নিয়ে ভালো আছেন।
সুখী মানুষ দাবি করা হোসেন মিয়া বলেন, ‘বছরের ৮ থেকে ১০ মাস গোমতী নদীতে মাছ শিকার করি। বাকি দুই-এক মাস ফেরি করি।
কোন সময়টা ফেরি করেন এমন প্রশ্নে হোসেন মিয়া বলেন, ‘বর্ষায় যখন পানি বাড়ে, তখন নদীতে খর ¯্রােতের কারণে ডিঙি নিয়ে চলা যায় না। তাই ওই সময়টা বাড়ি বাড়ি ফেরি করি। নদীতে পানি কমতে শুরু করলে আমরাও মাছ শিকার শুরু করি।
আমাদের বাপ-দাদাদের পেশা ছিল মাছ শিকার। আমরাও বংশপরম্পরায় মাছ শিকার করি। অন্য পেশায় মন টেকে না। মাছের নেশা বড় নেশা। একবার পাইলে আর ছাড়ে না।’
জাহাঙ্গীর মিয়া আওয়াজ দিয়া বলেন, ‘দেহেন না এক নেশায় ৪০ বছর পার করলাম।’
কীভাবে মাছ ধরেন এমন প্রশ্নে ডিঙির আরেক পাশে বসা জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, ‘আমাদের নৌকায় একটি ব্যাটারি আছে। নৌকায় একটা লাইট বেঁধে একজন বৈঠা চালাই। আরেকজন হাতে টেঁটা ও লোহার তৈরি চল নিয়ে বসে থাকি। নদীর একদম কিনারায় রাতের বেলা বিভিন্ন মাছ বসে থাকে।

লাইটের আলোয় দেখামাত্র টেঁটা দিয়ে ঘাই মেরে মাছ ধরি। ডিঙি নৌকায় বিভিন্ন আকৃতির ছয়টা কোঁচ ও টেঁটা আছে। ছোট মাছের জন্য এক রকম টেঁটা, বড় মাছের জন্য আরেক রকম।
গোমতীতে কী কী মাছ পাওয়া যায় এমন প্রশ্নে হোসেন মিয়া বলেন, ‘এহন আর আগের মোত মাছ পাওয়া যায় না। আগে বহুত মাছ পাওয়া যাইত। এখন বাইম, বোয়াল, টাকি, বাইলা, বাংলা, গ্রাস কাপ, আইড় পাওয়া যায়। ভাইগ্য বালা অইলে বড় মাছ পাই।’
বড় মাছ নদীতে আর আছে কি না এমন প্রশ্নে হাতের কোঁচ ঠিক করতে করতে হোসেন মিয়া বলেন, ‘আছে বড় মাছ। মাঝে মাঝে ধরা পড়ে। গত বছর ১৫ কেজি ওজনের একটি গ্রাস কাপ মাছ পেয়েছিলাম। ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। নদীতে বোয়াল ও আইড় মাছ আছে। তবে আগের মতো বেশি নেই।’
শীতের রাতে নদীতে মাছ শিকার করতে কষ্ট হয় কি না জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, ‘গায়ে চাদর পেঁচিয়ে নেই। বেশি শীত লাগলে বিড়ি ফুঁকে শরীর গরম করি। মাছের নেশার কাছে শীত আর গরম কিছু না।

একবার ডিঙি লইয়া টিক্কারচর থাইক্কা ভাটির দিকে যাইতাছি। বৈঠার লগে বাড়ি খাইয়া একটা বোয়াল মাছ লাফ দিয়া ডিঙির উপরে আইসা পড়ছে। বোয়ালডা ধরতে গিয়া নদীর পানিতে পইড়া ভিজ্জা গেছি। এরুম কত স্মৃতি আছে।’

 

আরেকবার রাইতে দেহি সাদা ধোয়া। পরে বুচ্ছি আলগা আছিলো। এরুম বহুত আলগা, পেত্তিনি সামনে পড়ছে। তবে কোন ক্ষতি করছে না। আলগা দেইখ্খা বিড়ি ধরাইছি।
কথা শেষে জাহাঙ্গীর মিয়া ডিঙি নৌকায় রাখা কোঁচ, টেঁটা, রান্নার চুলা, কাঁথা-বালিশ ঠিক করেন।

হোসেন মিয়া বৈঠা বেয়ে উজানের দিকে রওনা দেন। ভাঙা গলায় গান ধরেন: ‘মন মাঝি তুর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না…’