শাব্দিক গল্পেরা! —তাহরিমা ইসলাম

আজকাল ঘুম হয় কম! মাঝতাতে ঝিঁঝিঁদের শব্দে গাঁ ছমছমিয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায়। কি অদ্ভুত এক ভয় ভর করেছে!
এই ভয় রাতে ঘুম ভেঙ্গে যখন “ভয় পেও না,আমি আছিতো!” পাশে বসে দু’চারটা শব্দ, চার/পাঁচ শব্দের ছোট একটা মেইল,ছোট একটা ম্যাসেজ এর অপেক্ষা  কুড়ে কুড়ে খায় তখন চোখ তুলে আকাশে তাকাই! কি অদ্ভুত, সেখানে মেঘেরাও যে যার ন্যায় ব্যস্ত। কারও জন্য কারও দুদন্ড সময় নেই,আর এতো রক্তপিন্ডে গড়া মানুষ, এতো সময় কোথা পাবে!!
এই যে মানুষগুলোর সময় নেই! ব্যস্ততা! মুঠোফোনে মায়ের ব্যস্ততা, PUBG তে ভাইয়ের ব্যস্ততা, ক্যারিয়ার সাজাতে প্রিয়জনের ব্যস্ততা, বোনের কথা নাই বললাম, চারপাশে  কিলবিল করা ব্যস্ততা। ব্যস্ততার বেড়াকলে কেউ কাওকে না বুঝতে পারা দিয়ে কি আমার ভয় নামক সত্ত্বাটাকে জাগিয়ে দিচ্ছে? মানুষিক অসুস্থতার কারণ হচ্ছে? বলতে চেয়ে বলতে না পারার অসুখ নাকি দুরারোগ্য ব্যাধি। এই ব্যাধি উপশমের ঔষুধ কি ডাক্তারেরা দেয়? আবিষ্কার হয়েছে? তাহলে কি কোনটা ই নেই! তাহলে অভাবটা কি বলতে দেয়ার পরিবেশের? ধৈর্য্য নিয়ে শুনার? নাকি নিজের জগৎের সাথে পাশের ব্যক্তির জন্য সামান্য সময় গুনে দেয়ার? সময় কি গুনা যায়!
ছোটবেলায় দাদীমার কোলে শুয়ে ঘুমিয়া পড়ার শখ আজকাল তাড়া করে বেড়ায়। মায়ের বকুনির চেয়ে দাদীমার বলা সুয়োরানী দুয়োরাণীর গল্পই মনে দাগ কেটেছে বেশি। ছোটবেলা থেকে বড়বেলায় আসার ঠিক কয়েকদিন পূর্বেই দাদী চলে গেলেন,আর গল্প শুনা। মায়েরা ঠিক গল্প বলতে জানেন না। মোটা ফ্রেমের কাচের চশমা না পড়লেও মায়েরা বেশ রাশভারী ধরনের বলেই আমার জানা।
বাবা ভীষণ ব্যস্ত ব্যবসা,বাগান,চারপাশের মানুষজন সবাইকে সময় দিয়ে নিজের জন্যই সময় পেতো না। তবে দুপুরের খাবারের পর যখন বাবার কৈশরের গল্প বলতেন মনে হতো- না,বাবারাও গল্প বলতে জানেন।অদূর অতীতে বাবার কাছেই শুনেছি সঙ্গ দেয়া বা সঙ্গী হওয়াতে যে আনন্দ তা কয়েক রাজ্যভ্রমণের ন্যায়। বাবার গল্প শুনে ভাবতাম, বাবা আমার সত্যিকারের রাজপুত্র ছিলেন,না হয় এতোদিক সামলে গল্প কিভাবে বলেন!বাবা আজ নেই,তাই রাজপুত্রের গল্পটাও নেই।
বন্ধুবান্ধব আমার বরাবরই কম। এর কারণ অবশ্যই মা,উনার কড়া শাসনের পরে বন্ধুবান্ধব কে সময় দেয়া আকাশ-কুসুম কল্পনার ন্যায়। কলেজের এক নামকরা বান্ধবী রীতিমত আমায় রোবট বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সাত বছরের বেশি পথচলা তার সাথে,তাই তার বলা এ উক্তি আমাকে সমীহ করতেই হবে।
বেশ ভালো একজন বন্ধু ছিলো আমার,তবে বন্ধুকে প্রিয়জনের জায়গা দিতে পারিনি,ও যন্ত্রনায় সে নিজে লাপাত্তা হয়েছে। আচ্ছা আমাদের সমাজ বন্ধু আর প্রিয়জন শব্দের পার্থক্য কেনো বুঝার জায়গা রাখে না? কতো বন্ধুত্ব কে প্রিয়জন এর কাতারে টানতে গিয়ে কি সুন্দর সম্পর্ক গুলো দেয়ালের ন্যায় ফেঁটে চৌচির হয়ে যায়!অদ্ভুত!
প্রিয়জন!
হুম,খুব কাঙ্ক্ষিত একটা শব্দ তারচেয়েও বেশি কাঙ্ক্ষিত হলো প্রকৃত প্রিয়জন শব্দটা । তার সাথে গল্প করা যায়, আদৌ থেকে অন্ত সব শেয়ার করা যায়। মন খারাপে মৌন ভাষায় সবকিছু নিংড়ে দেয়া যায়, শাব্দিক অর্থে কমফোর্ট জোন বলা যায়। তবে মুশকিল হয় তখনি যখন সে নিজেই ক্যারিয়ারে সময় দিতে গিয়ে নিজের জন্য দুদন্ড সময় বের করতে না পারে।নিজের আয়েশের ঘুম টা যেখানে জলাঞ্জলি সেখানে অন্যের জন্য সময় তো ভাবাই মুশকিল!
কতো কিছু ভেবে নিলাম,কিন্ত নিজের পরিচয় টুকু তুলে ধরা হলো না।আমি “রাতি”, পৃথিবীতে আমার বসবাস। ব্যক্তি,পড়াশোনা,সমাজের বাইরে আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি একজন মাইগ্রেনের রোগী,মারাত্মক পর্যায়ে আমার এ অবস্থান। নিজেকে রোগী বলতে আর অস্বস্তি হয় না,কেননা এটাই আমার পরিচয়। গুনে গুনে তিনদিন মাইগ্রেন এর পেইনে ভুগে আজ চতুর্থদিনের রাতে বসে আমি এসব ভাবছি। বড্ড বেশি যন্ত্রনা পেয়েছি এবার,হয়তো মাত্রাবৃত্ত ছন্দকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে!
আমার ২৪ বছর জিবনের হিসেব মিলাচ্ছি।এতো গড়মিল করে রেখেছি যে রাত চারটা বেজে গেলো কিন্ত  হিসেব মিললো না। সব অসফল স্বপ্নগুলো নিজের মাঝে বয়ে বেড়াচ্ছি যা সফল হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। মাঝে মাঝে কারো স্বপ্ন পূরনের জন্য নৌকো হতে চেয়েছি,সেখানেও শুভাকাঙ্ক্ষীর চেয়ে বেশি “বালাইষাট” শব্দের ন্যায় হয়েছি আর চেয়ে দেখেছি। হয়তো ২৪ বছর হিসাব মিলানোর জন্য বড্ড কম সময়,তাই এরকম ভুলভাল মনে হচ্ছে নয়তো আমি তো বরাবর একজন রোগী তাই ভুল হিসেব মিলাচ্ছি, হবে কোন একটা।।
হিসেব মিলোক বা না মিলোক এর শেষ খুঁজে আমার কি! আমি তো ব্যস্ত শহরে এই সংলাপের উপলক্ষ মাত্র! ব্যস্ততা আমায়ও ঘিরে নিবে সে অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ যাত্রী আমি
পরিচিতি
তাহরিমা ইসলাম
শিক্ষার্থী, কুমিল্লা সরকারী মহিলা কলেজ