অখেরী চাহার সোম্বার তাৎপর্য; মাও.মো.ওমর ফারুক

 

আল্লাহর প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ (স.) এই পৃথিবীতে তেষট্টি বছর হায়াত পেয়েছিলেন। এর মধ্যে কখনোই তিনি বড় ধরনের কোনো রোগ-ব্যাধির কবলে পড়েন নাই। কাফের মুশরিকদের শত অত্যাচার ও নির্যাতনের মাঝেও তিনি ছিলেন হিমাদ্রির ন্যায় অবিচল। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ (স.)কে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নিবেন, তার আগে রোগে আক্রান্ত হলেন তিনি। উম্মুল মু’মেনীনগণও সাহাবা আজমাইনগণ তাতে খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। এর আগে সফর মাসের বুধবার তিনি সুস্থতা অনুভব করলেন। তিনি আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)কে ডেকে বললেন, ‘বিবি আমার কাছে আসুন ও আমার কথা শুনুন।’ হযরত আয়শা (রা.) দৌঁড়ে চলে এলেন এবং বললেন, হে আল্লহর রসূল (সা.) আমার বাবা-মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক বলুন! আমাকে কি জন্য ডেকেছেন।’ মহানবী (স.) বললেন, ‘আয়েশা আমার মাথাব্যথা চলে যাচ্ছে এবং আমি সুস্থতা অনুভব করছি। আপনি হাসান, হোসাইন ও মা ফাতিমাকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে আসেন।’ হযরত আয়েশা (রা.) তাই করলেন। রসূল (স.)-এর মাথায় পানি ঢাললেন। তাঁকে সুন্দরভাবে গোসল করালেন। এই খবর মদীনার সকল স্থানে ছাড়িয়ে পড়লো। অনেক সাহাবী এই খবর পেয়ে আনন্দে আত্মাহারা হয়ে গেলেন। কেউবা দাস মুক্ত করে দিলেন। কেউবা উট দান করলেন। কেউবা বহু দান-সাদকা করলেন। সাহাবীরাও অনেকে রাব্বুল আলামীনের কাছে শুকরিয়ার নামাজ ও দোয়া করলেন।

এটা ছিল সফর মাসের শেষ বুধবার। এজন্য এই দিনটিকে আখেরী চাহার সোম্বা বলা হয়। আখেরী অর্থ শেষ আর চাহার সোম্বা হলো বুধবার। এটাই ছিল রসূল (স.)-এর জীবনের শেষ বুধবার। এরপর বৃহস্পতিবার হতে আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রসূল (স.)-এর আগে তাঁর পরম বন্ধু আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌছানোর জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। একজন মুসাফির যেমন দূরবর্তী সফরে বের হওয়ার আগে সবার কাছ থেকে বিদায় নেয় সব কিছু গুছিয়ে নেয়- যা দেখে অনুভব করা যায় যে, উনি কোনো সফরে বের হবেন। ঠিক তদ্রূপ মহানবী (স.) তাঁর ইত্তেকালের আগেই তাঁর বিদায় যাত্রার প্রস্তুতি দেখে নিকটতম সাহাবীরা অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, রসূল (সা.) বোধহয় আমাদের মাঝে আর বেশিদিন থাকবেন না। উদাহরণস্বরূপ, রসূল (স.) প্রত্যেক রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ পালন করতেন। প্রত্যেকবার রমজানে মহানবী (স.)-এর কাছে জিব্রাইল (আ.) আসতেন এবং একবার সমস্ত কুরআন মহানবীকে শুনাতেন। আর মহানবী (সা.)ও সমস্ত কুরআন শরীফ জিব্রাইল (আ.)কে একবার শুনাতেন। কিন্তু ইন্তেকালের বছর জিব্রাইল (আ.) রসূল (স.)কে দুই বার শোনালেন। রসূল (স.) ও জিব্রাইল (আ.)কে দুইবার শোনালেন। এর পর বিদায় হজ্বের ভাষণের মাঝে তিনি বললেন, আজকের দিন যেসময় তোমাদের মাঝে আমি একত্রিত হয়েছি। আর হয়ত তোমাদের মাঝে আমি এখানে একত্রিত হতে পারবো না।

একথার মাধ্যমে তিনি তাঁর বিদায়ের ইঙ্গিত দিলেন। এরপর তিনি যেন সবার কাছ থেকে একে একে বিদায় নিচ্ছিলেন। তিনি ওহুদের প্রান্তরে চলে গেলেন। সেখানে তাঁর প্রাণপ্রিয় চাচা, ইসলামের বীর সিপাহসালার হয়রত আমীর হামজা ও ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হওয়া সত্তরজন জান্নাতী সাহাবীর কবর রয়েছে। রসূল (সা.) তাদের কবর জিয়ারত করলেন। এরপর একদিন জান্নাতুল বাকী কবর স্থানে চলে এলেন। এখানে কবরবাসীদের সম্বোধন করে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া দারু কওমি মু’মিমিন। হে মুমিন সমপ্রদায়ের আসল নিবাসের অধিবাসীগণ! আমি অতি শিঘ্রই তোমাদের সাথে মিলিত হচ্ছি। ‘এরপর হঠাৎ জিব্রাইল (আ.) আসলেন এবং বললেন, ‘হে রসূল (স.) আল্লাহ তায়ালা আপনাকে শীঘ্রই এই পৃথিবী থেকে চলে যাবার অথবা আরো কিছুদিন এখানে থাকার অবকাশ দিয়েছেন। এখন আপনি যেটা পছন্দ করেন।’ প্রিয় পাঠক! আল্লাহর নবী রসূলগণ হলেন জগতের সেরা সন্তান। তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা ম্তৃ্যুর

আগে ছালাম জানিয়েছেন এবং থাকা ও যাবার স্বাধীনতা দিয়েছেন। কিন্তু সকল নবী যাওয়াটাকেই বেছে নিয়েছেন। মহানবী (স.)ও তাই করলেন। তিনি একদিন বলেছিলেন, আলস্ন্লাহ তাঁর কোনো এক বান্দাকে এই পৃথিবীতে থাকার ও এখান থেকে যাবার ইখতিয়ার দিয়েছেন। কিন্তু সেই বান্দা বলেছে-‘আলস্ন্লাহুম্মার রফিকুল আলা।’ আমি আমার পরম বন্ধু আলস্ন্লাহ রাব্বুল আলামীনের সান্নিধ্যকেই বেছে নিচ্ছি। সাহাবীরা বলেন, রসুলের এই কথা শুনে নিকটতম সাহাবী আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী, তালহা, যুবারের, আবদুর রহমান বিন আউফ এসব জলিল-এ-ক্বদর সাহাবীরা ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন। তাদের কান্নার শব্দ পিছনের কাতার থেকে শোনা গিয়েছিল। সাহাবীরা বুঝে ছিলেন রসূল (স.) হয়ত আর বেশিদিন আমাদের মাঝে থাকবেন না। এরপর রসূল (স.) শেষ অসুস্থ হলেন-তার স্ত্রী মায়মুনার বাড়ি থেকে ফেরার পথে হযরত আয়শার কাছে আসলেন।

রসূল (স.) আয়শাকে বললেন, আয়শা! খয়বারের ইহুদিনী মহিলার সেই বিষ মিশানো খাবার এখনো আমাকে পীড়িত করছে।

বৃহসপতিবার আসরের নামায়াজের পর হতে আর মসজিদের জামাতে যেতে পারেননি নবী করীম (স.)। এরপর ধীরে ধীরে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। গোটা মদিনা নগরী নীরব নিস্তব্ধ। সোমবার সুব্হে সাদিকে বেলালের আজান নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে জাগিয়ে দিল সব মানুষকে। রসূল (স.) ইশারায় ফজরের নামাজ আদায় করলেন। হযরত আয়শা (রা.) বললেন, আমার হুজরার বাতি সে সময় নিভে গেল। মহানবী (সঃ)-এর সকল সম্পদ এই মুহূর্তে এমনভাবে শেষ হলো যে, বাতিজ্বালানোর তেলটুকুও ছিল না। অর্থাৎ তাঁর প্রাণপ্রদীপ নিভে যাবার আগেই আলোর প্রদীপ নিভে গেল। হযরত জিব্রাইল (আ.) এসে বললেন, হে রসূল (স.)! আপনাকে আলস্ন্লাহ সালাম দিয়েছেন। রসূল (স.) তখনই ধরাধাম হতে চিরবিদায় নিবেন। মেয়ে ফাতিমা সে সময় খুব কাঁদছিলেন। মহানবী (স.) ফাতেমাকে ডাক দিয়ে কি জানি বললেন। তাঁর কান্না বন্ধ হয়ে গেল। হযরত আয়েশা (রা.) ফাতেমাকে ডেকে বললেন, তোমার আব্বা তোমার কানে কি বললেন, আর তোমার কান্না বন্ধ হয়ে গেল? ফাতেমা বললেন, আব্বাজান আমাকে বলেছেন মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের সবার মধ্যে আগে তাঁর সাথে আমার দেখা হবে। এরপর মালাকুল মওত আজরাইল (আ.) আসলেন। আর একটু পরেই জান কবজ হবে। জিব্রাইল (আ.) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসূল (স.)! আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে। মহানবী (স.) বললেন, হ্যাঁ, মৃত্যুর যন্ত্রণা খুবই কষ্টকর। জিব্রাইল (আ.) বলেন, ইয়া রসূল (স.) পৃথিবীর সব মানুষের চেয়ে কম কষ্টে আপনার জান কবজ করা হচ্ছে। মহানবী (স.) বলেন, আমার তো মনে হচ্ছে ওহুদ পাহাড়টি আমার বুকের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

প্রিয় পাঠক! একবার অন্তত গভীরভাবে চিন্তা করুন- সবচেয়ে কম কষ্ট যদি এই হয় তাহলে যারা আলস্নাহ বিরোধী, বিপদগামী, বেনামাজী মৃত্যুর সময় তাদের কি অবস্থা হবে! এরপর রসূল (স.) আস্-সলাত! আস্-সলাত!! অমা মালাকাত আইমানুকুম। নামাজ! নামাজ!! তোমরা তোমাদের অধীনস্থদের ব্যাপারে সাবধান থাকবে। এই কথা বলতে বলতে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে গেলেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)। ভোর না হতেই চারদিকে আওয়াজ উঠল: রসূল নেই! রসূল নেই!! সবাই যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। নিকটতম সকল সাহাবী খবর পেয়ে হাজির হলেন। হযরত উসমান একবার হুজরার মধ্যে যান আবার বের হয়ে এসে লোকদের শান্ত করেন। সাহাবী উনায়েস (রা.) বেহুঁশ হয়ে গেলেন। হযরত ওমরের মত বড় বীর পাগলের মতো হয়ে গেলেন। নাঙ্গা তরবারি বের করে বলছিলেন, যে বলবে মুহাম্মদ (স.) নেই, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দিব। এ খবর যখন হযরত আবুবকরের কাছে গেলো। তখন তিনি সুনুহ পলস্ন্লীতে অবস্থান করছিলেন। হযরত আয়শা (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমার পিতা হযরত আবুবকর (রা.) একটি ঘোড়ায় চড়ে এলেন। ঘোড়া হতে নামলেন। কারো সাথে কোন কথা বললেন না। সোজা হুজরায় ঢুকলেন। রসূলের চেহারা হতে কাপড় উঠালেন। ললাটে চুম্বন করলেন। আর বললেন, হে প্রিয় বন্ধু! তুমি সত্যি ইন্তেকাল করেছো। এরপর তিনি মনটাকে হিমাদ্রির মতো শক্ত করে বাইরে এসে বললেন, হে জনমণ্ডলি! তোমাদের মধ্যে যারা মুহাম্মদের পূজারি তারা শোন, মুহাম্মদ (স.) মারা গিয়েছেন। আর যারা আলস্ন্লাহর পূজারি, তারা শোন, সেই আলস্ন্লাহ চিরঞ্জীব, অমর। তিনি কখনো মৃত্যু বরণ করবেন না। হে ওমর! ঠাণ্ডা হও। অতঃপর তিনি কোরআনের ‘অমা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল’ আয়াত পাঠ করলেন, যার অর্থ হলো: মুহাম্মদ (স.) একজন রসূল ছাড়া আর অন্য কিছু নন। তার আগে বহু রসূল এসেছিলেন ও তাঁরাও মৃত্যুবরণ করেছেন। সুতারাং যদি মুহাম্মদ (স.) মারা যান, অথবা নিহত হন তাহলে কি তোমরা তোমাদের পূর্বের অবস্থায় (জাহেলিয়াতে) ফিরে যাবে? হযরত ওমর (রা.) বললেন, যখন আবুবকর এই কথাগুলো বলছিলেন ও কুরআনের আয়াত পড়ছিলেন তখন আমার হাত থেকে তরবারি পড়ে গেল। ধীরে ধীরে পা ভারি হতে লাগলো। অবশেষে আমি বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলাম।

সম্পাদক, ত্রৈমাসিক আন নকিব।