অগ্রসরমান এক মহিয়সী নারী–গাজীউল হক সোহাগ

কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা আমোদ ৬৬ বছর পার করেছে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পত্রিকাটি পাঠক প্রিয়তার পাশাপাশি বস্তুনিষ্ঠতার মান ধরে রেখেছে। প্রাচীনতম সাপ্তাহিকী হিসেবে এর সুনাম সবখানেই। স্বীকৃতিও পেয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। বয়সে প্রবীণ বলেই ৬৩ বছর পর্যন্ত আধুনিকতার চাপ ছিল না এর কলেবরে। সাদাকালোই’তে এর সংবাদ, ছবি, মতামত ছাপা হতো। তিন বছর আগে সেটি রঙিন করা হয়। এখন রঙিন বের হচ্ছে। আমোদে অসাধারণ কিছু চৌকষ শিরোনাম থাকে প্রতিটি প্রতিবেদনে। দৈনিক পত্রিকার কাটপিচ খবর এক করে সেটি প্রকাশিত হয় না। থাকে টাটকা সব খবর। ব্যতিক্রম ও সাহসী সংবাদ।

 

বৃহস্পতিবার এলেই শহরবাসী হুমড়ি খেয়ে পড়ে। চাই আমোদ। আমোদে কী আছে? কেন এর পাঠকপ্রিয়তা? কীভাবে টিকে আছে পত্রিকাটি? এমন প্রশ্নের জবাব মেলে পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাকীন রাব্বীর কণ্ঠে। … ‘পাঠকের চাহিদা আর বাবার আদর্শকে লালন করেই পত্রিকাটি এগিয়ে চলছে। ভালো প্রতিবেদন থাকলে পত্রিকা রঙিন কি সাদাকালো সেটা কোন ফ্যাক্টর নয়। কিন্তু এখন রঙিন ছাপা হয়। এর প্রতিবেদন, মতামত এবং কুমিল্লার উত্তর জনপদের খবর বেশি ছাপা হওয়ার কারণেই এর চাহিদা অনেক।’

পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী ছিলেন খেলাধূলাপ্রেমী। খেলার মাঠেই তাঁর সময় কাটতো। তখন তিনি খেলার ধারা বর্ণনা করতেন। হঠাৎ করেই মাথায় এলো ক্রীড়া বিষয়ক একটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা করবেন তিনি। ১৯৫৫ সালের ৫ মে উদ্বোধনী সংখ্যা বের হয়। আকার ট্যাবলয়েড। ছাপা হতো ট্রেডেল মেশিনে। দাম তখন এক আনা ছিলো। এতে পূর্ব পাকিস্তানের সব খেলার খবর ছাপা হতো। বছর তিনেক চলার পর মনে হলো, এতো খেলার খবর পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন কিছু করতে হবে। খেলার খবর ছাড়াও বাইরের সব ধরণের খবর ছাপতে হবে। তখন কুমিল্লার সিনেমা হলগুলো দর্শকে ঠাসা ছিলো। সম্পাদক সিনেমা হলে যেতেন। ছবি দেখতেন। এরপর ছবির রিভিউ লিখে বেশ সাড়া পান। তখন ছবি নিয়ে মজাদার লেখা পাঠককে আকৃষ্ট করতো। এ অবস্থায় পত্রিকাটির কাটতি বেশ বেড়ে গেলো। ওই পত্রিকা বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা ও সোনামূড়াতে যেতো। ওই পত্রিকা বিক্রি এবং এর বিজ্ঞাপন দিয়ে তাঁর পরিবারের খরচ চলতো।

৫.৫.১৯৫৫ সালে পত্রিকাটি বের হলেও নিজস্ব প্রেস থেকে পত্রিকা ছাপা হয় ১৯৬৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। ডাবল ডিমাই সাইজের চাইনিজ ফাট মেশিনের মাধ্যমে তা বের হতো। বর্তমানে পত্রিকাটি নিজস্ব অফসেট প্রিন্টের মেশিনে ছাপা হচ্ছে।
আমোদের স্বীকৃতিও কম নয়। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো থেকে এশিয়া মহাদেশের সকল আঞ্চলিক সংবাদপত্রের উপর একটি জরিপ কাজ চালানো হয়। ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগ থেকে ড. ক্রিসপিন সি মাসলগ ওই জরিপ কাজ চালান। ওই সময়ে তিনি ১০ টি আঞ্চলিক পত্রিকার উপর কাজ করে পাঁচটি আঞ্চলিক পত্রিকাকে সফল হিসেবে ইউনেস্কোতে প্রতিবেদন দেন। এতে বাংলাদেশের আমোদ ছিলো। তখন ‘ফাইভ সাকসেসফুল এশিয়ান কমিউনিটি নিউজপেপার’ নামে একটি বই বের হয়। তাঁর মধ্যে কুমিল্লার সাপ্তাহিক আমোদও অন্তর্ভূক্ত হয়। ২০০৩-২০০৪ সালে ‘ভয়েস অব আমেরিকা’ আমোদ‘র উপর আলাদা সাক্ষাতকার অনুষ্ঠান প্রচার করে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে আমোদ ১০ হাজার বুলেটিন বের করে।

দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমোদও নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের মার্শাল ল-এর কারণে দুই সপ্তাহ, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন ২৮ সপ্তাহ এবং ১৯৭৫ সালে ১৪ সপ্তাহের জন্য পত্রিকা সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে বন্ধ হয়। কিন্তু কোন ঝড় ঝাপটাই আমোদকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আমোদ কুমিল্লার প্রথম ওয়েবসাইট পত্রিকা। ২০০৬ সালে সেটি ইন্টারনেটের পাঠকদের জন্য চালু করা হয়।
১৯৯৪ সালে পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী গত হন। এরপর তাঁর স্ত্রী শামসুন নাহার রাব্বী পত্রিকার হাল ধরেন। ২০১৫ সালে ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আগে মনে হল, আমোদ নিয়ে কিছু লেখা দরকার। বাকীন ভাইকে ফোন করে চলে গেলাম আমোদ এ। অফিস, বাসা ও ছাপাখানা এক ক্যাম্পাসে। মা, ছেলের সঙ্গে আলাপচারিতায় আমোদ প্রকাশনা টিকে থাকার গল্পটা শুনলাম। কুমিল্লায় রঙিন ট্যাবলয়েড পত্রিকার যুগে তখনও পত্রিকাটি সাদাকালো নিউজপ্রিন্টে বের হতো। লেখার মান, শিরোনাম ও কলামগুলো ভাল ছিল।

 

বাংলাদেশের বিশিষ্ট গাড়ি ব্যবসায়ী বরুড়া উপজেলার ফলকামুড়ি এলাকার বাসিন্দা ও রাজধানী ঢাকার নয়াপল্টন এলাকার হকসে বে গাড়ির শোরুমের স্বত্বাধিকারী আবদুল হক আংকেলও এই পত্রিকার চরম ভক্ত ও পাঠক। ঢাকায় যখনই যেতাম, দেখা হলেই বলতেন, রাব্বী সাহেবের আমোদ এর খবর কি? তো সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে খালাম্মা ( শামসুন নাহার রাব্বী) বললেন, সোহাগকে আমোদ এর প্রথম সংখ্যাটা দেখাও। আমি হাতে নিলাম। নতুন বইয়ের মতো ঘ্রাণ নিলাম। আমার জšে§র দুই যুগ আগে যাত্রা শুরুর উদ্বোধনী সংখ্যায় চোখ বুলালাম। যেন একটা ইতিহাসকে ধরলাম। সাক্ষাতকারে খালাম্মা বলেন, ‘৪০ বছর ছয় মাস পত্রিকাটির প্রকাশনা দেখে গেছেন রাব্বী (তাঁর স্বামী) সাহেব। এটা অনেক বড় ব্যাপার। তিনি পত্রিকার সংবাদ লেখা, বানান ঠিক করা, ছাপানো, ভাঁজ করা সবই করতেন।’

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বললেন, একদিন কুমিল্লার রুপালী সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গেলাম। তখন সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে হলের মধ্যে চা খাওয়ালো। হঠাৎ করে তিনি আমাকে বললেন, এটা নিয়ে একটি নিউজ করো। ওনার পীড়াপীড়িতে লিখলাম, ‘সিনেমা হলে চা চক্র’। ওই লেখা বেশ সাড়া পড়ে গেলো। ওই লেখার মধ্য দিয়ে আমিও সাংবাদিকতায় নাম লিখলাম। এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছি, তাই একমাত্র ছেলেকে (বাকীন রাব্বী) ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছি।’
১৯৮৫ সালের ৫ মে মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী হলেন প্রধান সম্পাদক। তাঁর স্ত্রী শামসুন নাহার রাব্বী হলেন সম্পাদক। তখন পত্রিকার দাম ছিলো পঁচাত্তর পয়সা। বর্তমানে এর দাম পাঁচ টাকা।

১৯৯৪ সালের ২৮ নভেম্বর পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী গত হন। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী শামসুন্নাহার রাব্বী এবং একমাত্র ছেলে বাকীর রাব্বী এর হাল ধরেন। এখন খালাম্মাও চলে গেলেন। বাকীন ভাইও আমেরিকায় থিতু হচ্ছেন। আমোদ নিয়মিত বের হলে শামসুন নাহার রাব্বীকে আমরা খুঁজে পাব। নতুন প্রজš§ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের অগ্রসরমান এক মহিয়সী নারীর পত্রিকা সম্পাদনায় যুক্ত থাকার খবর জানতে পারবে। এমন আশা নিয়েই থাকব আমরা। খালাম্মার প্রতি রইল অতল শ্রদ্ধা।
লেখক: স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক প্রথম আলো, কুমিল্লা।