আমাদের সাদা-কালো কুকুর

।। ইলিয়াছ হোসাইন।।
বর্ষাকাল। চারদিকে মহামারির কানাঘুষো আতঙ্ক! রাত তখন ১২ টা। ছোট বোন জান্নাত ফোন করলো শাহজাহান ভাইয়ার (জেঠাতো ভাই এবং বোনের স্বামী) জ্বর ১০৪ডিগ্রি এবং শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। তখন শ্বাসকষ্ট মানেই ভয়ংকর কোনো কিছু! টিনের চালে বৃষ্টির টাপুর-টুপুর শব্দ! বাড়ির মানুষ ততক্ষণে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। একজন মানুষও জেগে নেই। আকাশ ধবধবে সাদা। কিন্তু আকাশের কান্না কোনো ক্রমেই থামছেনা। বাড়ির অলি-গলি ও উঠোন বৃষ্টির পানিতে টইটম্বুর অবস্থা। আমি আর মা মোবাইল ফোনের টর্চ মেরে শনশন করে হেঁটে যাচ্ছি। পুরান বাড়ি থেকে নতুন বাড়ি। কারো ঘর থেকে কোনো ফিসফিস শব্দও বের হচ্ছে না। চারপাশ নির্জনতায় ঘেরা। কিছুটা ভয় ভয় লাগছে! আমরা বাতাসের গতিতে পা টিপে টিপে কাদায় হাঁটছি। পিচ্ছিল উঠোন! কিছুদূর যেতে হঠাৎ ধপাস করে পড়ে গেলাম। ডান হাতে ব্যথা পেয়েছি। কিন্তু বিপদের রাত ব্যথা অতটা টের পাইনি। বিপদের সময় গুলোতে হয়তো আমরা আমাদের কঠিন কষ্ট অনুভব করতে পারিনা। কারণ বিপদটাই তো সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা বা আতঙ্কের! মা’র হাত ধরে উঠে দাঁড়ালাম। শব্দ পাচ্ছি; কেউ একজন চারপায়ে পাতলা শরীরে পিছন পিছন দৌঁড়াচ্ছে।
পিছন ফিরে দেখি -আমরা একা নই। আমাদের সাথে আরো একজন আছে। সে এখনো ঘুমায়নি। আমাদের বিপদের রাতের সঙ্গী আমাদের ‘টাইগার’;আমাদের পোষা সাদা-কালো কুকুরটা। অথচ মানুষ হিসেবে আমাদের বিপদ যাত্রায় কোনো প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজন থাকার কথা ছিলো। সেখানে একটা নিরীহ কুকুর! শুধু ঐদিন নয় বাড়িতে গেলে এখন প্রতিটা নি:সঙ্গ রাতে অথবা সকল বিপদে টাইগার আমার পাশেই থাকে।
সাদা-কালো কুকুরটাসহ তার ভাই-বোনের সংখ্যা আট ছিলো। সবগুলো অবহেলা-অযতেœ মরে সাফ। কুকুরের জীবন! শুধু বেঁচে রইলো সাদা-কালো ডোরার কুকুরটি। ওকে আমি আর জিলানী ভাইয়া লালন-পালন করছি। নাম দিয়েছি টাইগার। দেখতে মোটা-সোটা বাঘের বাচ্চার মতো। টাইগার একটু একটু করে বড় হচ্ছে। শিশু থেকে কৈশোরে পদার্পণ করলো। এর মাঝে মোটা-সোটা হওয়ার জন্য এঁকে খাসি করে দেওয়া হলো। কাঠ পোড়া রোদ। একদিন টাইগারের পা থেকে রক্ত ঝরছে। জানলাম পাশের বাড়ির এক ভাতিজা তাকে দা ছুঁড়ে মেরেছে। মেজাজ ঠিক রোদ্রের খড়তাপের মতো প্রখর হলো। কাছে পেলে ছেলেটিকে কষে ক’টা তাপ্পর মারতাম। টাইগারের পা’টা একেবারে পড়ে যাওয়ার মতো। নড়বড়ে ঝুলে আছে। তার(টাইগারের)জীবনে নেমে এলো কালো অধ্যায়। সে ব্যথা যতোটুকু পাচ্ছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট অনুভব করেছিলাম আমরা। ভেবেছিলাম পঁচা লেগে মরে যাবে হয়তো। বড় ভাইয়া(জিলানী) তার ফার্মেসিতে নিয়ে গেলো। ইনজেকশন দিয়ে দিলো। তারপর টাইগার ধীরে ধীরে সুস্থ হওয়া শুরু করলো। এখন টাইগার পুরো তাগড়া জোয়ান।
বন্ধু-বান্ধব জুড়িয়েছে অনেক। বাড়িতে এখন টাইগারসহ ছয়-সাতটে কুকুর। আমি বাড়িতে গেলে সময়ে সময়ে খাবার পায়। আশে-পাশের বন্ধুবান্ধবদেরও খাবারের দাওয়াত দিয়ে হাজির করে রাখে।
বাড়িতে আয়োজন। পনেরোটা মুরগি ঝুড়িতে রাখা।
আশে-পাশে অনেক কুকুর ঘুরপাক করছে। পাহারাদার হিসেবে ঝুড়ির সামনে বসা আমার সাদা-কালো টাইগার। মনে মনে ভাবি অন্য কুকুরগুলোর মতো তারওতো মুরগীর কাঁচামাংস চিবোতে ইচ্ছে করে। তারপরেও না, মনিবের বিশ্বাস কি ভাঙ্গতে পারে! যে বিশ্বাস আজকাল মানুষ হরহামেশাই ভেঙে ফেলে। এ বিবেচনায় নিরীহ কুকুর এ ব্যাপারে খুব সচেতন। ওরা মনিবের বিশ্বাস ভাঙ্গতে কখনোই প্রস্তুত নয়।
সে বসে আছে। সামনে মুরগির ঝুড়ি। খাওয়ার সুযোগ থাকলেও খাচ্ছেনা। দায়িত্বে ভীষণ অটুট। যে দায়িত্ব মানুষ এখন পালন করতে পারেনা। সে কুকুর হয়েও পারছে। এ দায়িত্ব প্রতিটি আয়োজনেই সে পালন করে থাকে।
সারাদিন বাড়িটাকে আগলে রাখে। বাড়িতে অপরিচিত কেউ ঢুকলেই ঘেউ ঘেউ করে পুরো বাড়ি সাড়া জাগিয়ে তোলে!
সবসময় আমার বিদায় নেবার বেলায় খেয়াল করি- টাইগারের চোখে অশ্রু টলমল করে। লেজ নাড়াতে নাড়াতে নাক দিয়ে আমার গা থেকে কিসের গন্ধ যেনো শুকার চেষ্টা করে। সে হয়তো চায় আমাকে দু’হাত দিয়ে কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকতে। হয়তো তা নয়;সম্পূর্ণই এ আমার মনের ইচ্ছে!
সে আমার আগে আগে হাঁটবে। সাথের বন্ধু-বান্ধব সবাইকে নিয়ে আমাকে বিদায় দেবার জন্য আগে আগে দৌঁড়াবে। মহেশপুর বৈরাগীর বাজার পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসবে। বাজারে কিছু বলিষ্ঠ কুকুর আছে। ওরা খুব ভয়ঙ্কর! অন্য কুকুরকে ওরা দেখলেই চিতা বাঘের মতো তাড়া করে। শ্বাস না বের হওয়া পর্যন্ত দৌঁড়াতে থাকে। টাইগার আমাকে এগিয়ে দিতে সেই ভয়কেও তুচ্ছ করছে। শুধু এগিয়ে দিতে নয়-বাবার কবর জিয়ারতের সময় বাজারের কুকুরের ভয়কে তুচ্ছ করে প্রতিদিন সে আমার পিছন পিছন যাবে।
বাবার কবরটা আমাদের বাজারের পাশেই। বাবার কবরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ভাবি-আমরা কেমন মানুষ! মানুষ যা করার কথা ছিলো,এখন কুকুর-বিড়াল এবং বোবা প্রাণীরা তা করে।
লেখক: আলোকচিত্রী ও সংবাদকর্মী।