আমার প্রবীরদা– নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

বাংলাদেশের প্রবীর বিকাশ সরকার জাপানে আমার এক সেরা সময়ের অভিভাবক, বন্ধু।

১৯৯৯-এ বিশ্বভারতীর ইংরেজি বিভাগে পড়া শেষ শেষ হবার পর জাপানি ভারততাত্ত্বিক অধ্যাপক কাজুও আজুমা আমাকে জাপানে নিয়ে গেলেন। রেইতাকু বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানি ভাষার এক বছরের একটা কোর্সে আমাকে ভর্তি করে দিলেন। সেই প্রথম আমার প্লেনে চড়া, সেই প্রথম বিদেশ যাওয়া। মার্চ মাস। চারপাশে সাকুরায় সাদা। ইচিকাওয়ায় ওঁদের বাড়ি ছুইঁয়ে আজুমা সেনসেই আর তাঁর ভালোমানুষের থেকেও ভালো স্ত্রী কেইকো আজুমা আমাকে রেইতাকুর ডর্মে দিয়ে গেলেন। কাজুও আজুমা, কেইকো আজুমা আর আজুমা সেনসেইয়ের বোন মিনাকো আজুমা তারপর কবে আমার আত্মীয় হয়ে গেলেন, জাপান আমাকে একেবারে গ্রাস করে নিল। কেবলই আমার মনে হত, পূর্বজন্মে আমি জাপানি ছিলাম। সেই যে জাপানের নেশা আমাকে পেয়ে বসল, আজও তার হাতছানি থেকে একমুহূর্তের জন্যও আমি বেরোতে পারিনি। আমার নিজের দেশ ভারতবর্ষ, বাবার দেশ বাংলাদেশ ছাড়া জাপানের মতো অন্য আর কোনও দেশের প্রতি আমার আর এতো টান হয়নি। একটা ভয়ঙ্কর অসুখে পড়ে সেবার আমাকে দেশে ফিরে আসতে হয়, যদিও সেরে উঠে অল্প কয়েক মাস বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সুযোগ হয়েছিল। প্রবীর বিকাশ সরকার তখন আমার অচেনা।

 

২০০৩। একবছরের জন্য আজুমা সেনসেই আবার আমাকে নিয়ে গেলেন রেইতাকু বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার জাপানের কুসংস্কার নিয়ে গবেষণা আর বাংলা পড়াতে। আমার চমৎকার থাকার জায়গা ছাড়াও, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর নিজের একটা ঘরও পেলাম। মাঝে মাঝে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হত। দীর্ঘ সময় হয় ঘুরে ঘুরে, না হয় কম্পিউটারে কাটাতাম। জাপানের প্রবাসী বাঙালীদের চেনার ইচ্ছেয় একদিন পেলাম “মানচিত্র” বলে একটা পত্রিকার খোঁজ। সম্পাদকের নাম প্রবীর বিকাশ সরকার। একটা টেলিফোন নম্বর অথবা ইমেইল সম্ভবত ছিল। টেলিফোনে প্রথম যোগাযোগ। তারপর আলাপ। জাপানের এক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রবীরদাকে দেখে, তাঁর কাজ, আগ্রহ দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম! তখন জাপানে তাঁর সম্ভবত কুড়ি বছর থাকা হয়ে গিয়েছে। জাপানি স্ত্রী আর ফুটফুটে সুন্দরী পুতুলের মতো এক মেয়েও আছে। প্রবীরদা নিজে একজন ঈর্ষনীয় লেখক, সম্পাদক, গবেষক। তাঁর গবেষণার বিষয় মূলত সাংস্কৃতিক বিনিময়, জাপান আর রবীন্দ্রনাথ। কিছুদিন আলাপের পর প্রবীরদাকে আজুমা সেনসেই আপন করে নিলেন। জাপানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্রবীরদা খুবই সমর্থন করেন। জাপানিদের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফাঁসি হওয়া জাপানি প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজোর আদর্শের তিনি বিশেষ ভক্ত। তোজোর নাতনি ইউকো তোজো প্রবীরদাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। প্রবীরদা একবার আমাকে তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। আমিও তোজোসানের অফুরান স্নেহ পেয়েছিলাম।

জাপানে দীর্ঘসময় কাজ করে প্রবীরদা খুবই ক্লান্ত থাকতেন। তবু ছুটিরদিন মাঝে মাঝে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসতেন। সারাদিন আমরা গল্প করতাম, রান্না করতাম, কখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি অথবা তুষারপাতের ভিতর ছাতামাথায় দুজনে কাগজের লণ্ঠনে মোড়া “সানকো হানতেন” বলে একটা দোকানে খেতেখেতে অনেক আলোচনা করতাম। সেইসব দিন আমার স্বপ্নের মতো মনে হয়। আমার একজন আমেরিকান বান্ধবী হয়েছিল, যার নাম ফ্র্যাঞ্চেস্কা লিডার। তার সঙ্গেও প্রবীরদার বেশ ভাব হয়েছিল। নববর্ষের দিন একসঙ্গে বর্ষবরণের উৎসবে আমরা একবার রাতজেগে অনেক আনন্দ করেছিলাম।

প্রবীরদা আমাকে জাপানের বহু সাংস্কৃতিক সৌধে, মন্দিরে, সংগ্রহশালায় নিয়ে যেছেন। নতুন বছরে জাপানে ছোটদের “ওতোশি দামা” হিসেবে টাকা দেওয়ার চল রয়েছে। একটা খামে মুড়ে প্রবীরদা আমাকে টাকা দিতেন, আমি খুব খুশি হয়ে কিছু কিনে ফেলতাম।

প্রবীরদার আগ্রহের, গবেষণার যেন শেষ নেই। প্রতিদিন জাপান আর ভারতের বিনিময় নিয়ে নানা অদেখা, অজানা মণিমুক্ত তিনি তুলে নিয়ে আসেন নিজের কাজের ফাঁকে-ফাঁকে, উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন ছাড়াই। একটা বইঘেরা ছোট্ট বাড়িতে এই কাজে তাঁর সহায়ক তাঁর অসম্ভব ভালো জাপানি স্ত্রী। ঐ বাড়িতে একবার গিয়েছিলাম। প্রবীরদার মেয়ে টিনার চমৎকার পিয়ানোর হাত। পিয়ানো শুনেছিলাম। আমার হিরোশিমায় পারমাণবিক অত্যাচারের ইতিহাস জানার ইচ্ছে পূর্ণ করেছিলেন প্রবীরদাই। শুধু হিরোশিমাই নয়, আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন হিরোশিমার কাছেই স্বর্গের মতো সুন্দর এক দ্বীপ মিয়াজিমাতেও।

অধ্যাপক আজুমার সঙ্গে কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির অধীনে “ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র” প্রতিষ্ঠায় প্রাণপাত করেছিলেন প্রবীরদা। ২০০৭-এ জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে কলকাতায় এসে উদ্বোধন করেছিলেন সেই কেন্দ্রের।
জাপানিদের মতো ছোট করে চুল কাটতেন প্রবীরদা। জাপানে থেকে থেকে তাঁর জীবনযাত্রার ধরণ অনেকটা হয়ে গিয়েছিল খাঁটি জাপানিদের মতোই। জাপানিদের ভিতর থেকে ভালবাসতেন বলে তাদের কেউ ঠকালে অথবা অসম্মান করলে অসম্ভব রেগে যেতেন। শান্তিনিকেতনে আমাদের বাড়িতেও এসেছেন তিনি ২০১১ সালে।

 

গবেষণার কাজে প্রবীরদাকে বিশ্বভারতী থেকে একবার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। নানা প্রতিকূলতায় শেষ পর্যন্ত আর তাঁর আসা হয়নি। জাপানে আর্থিক মন্দার প্রভাব পড়েছিল প্রবীরদার উপরও। লম্বা সময়ের জন্য চলে এসেছিলেন বাংলাদেশে। বোঝা যেত নিজের বাবাকে খুবই ভালোবাসতেন। তারপর একদিন দেখলাম প্রবীরদা আবার ফিরে গেছেন জাপানের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়।

সুযোগ পেলে আমি সারাজীবন, অন্তত বাকি জীবন জাপানেই থাকতাম। চোখ বুজলেই আমি দেখতে পাই জাপানে আমার স্মৃতির সরণী ধরে মিলিয়ে যাওয়া একটা আলোর মতো হেঁটে যাচ্ছেন আমার সুসময়ের, দুঃসময়ের বন্ধু প্রবীরদা। তাঁর বুকে আমার মতোই মাতৃভূমি আর জাপানের প্রতি এক-পৃথিবী ভালোবাসা, পাইন বনের হাওয়ায় হাতে একটা মাইল্ড সেভেন।

লেখক:  কবি, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, গ্রন্থকার ও টিভি উপস্থাপক। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। 

শান্তিনিকেতন, ২১.৪. ১২