আমার সংগ্রামী মা

।।হুমায়ুন কবির।।
৮ আগস্ট,২০২৪। ড: মোহাম্মদ ইউনুস যেদিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অভিষেক হল যেদিন। ঠিক সেদিন আমার মা নাজমুন নাহার ওরফে নাজমা কবির আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। ‘মা’ কথাটি পৃথিবীর যেকোনো ভাষাতেই তার অবস্থান সবার উপরে এবং সবকিছুর উর্ধ্বে।
আমার বাবা-মায়ের বিয়ে হওয়ার ৫-৬ বছর পর আমার জন্ম। আমার বাবার দিকের যে প্রথম কেঁদেছি পৃথিবীর বুকে। আমার জন্মের আগের ৫-৬ বছর আগের পৃথিবীটা আমার মায়ের কাছে ছিল বিভীষিকাময়। আমার দাদী তার ছেলেকে অর্থাৎ বাবাকে আবার বিয়ে করানোর হুমকি দিলেন। এমন সময় মায়ের মনে হল যে যা বলত তাই করতেন। কেউ যদি তাকে বলতো ইট বা পাথর খেয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হবে কিন্তু বিনিময়ে তার সন্তান হবে। তিনি তাই করতেন। মা সন্তানের জন্য এমনই পাগলপারা ছিলেন। তেমনি ভীতশ্রদ্ধতায় ভরা ছিল তার জীবন । ঠিক সে সময় সবার কোল জুড়ে আমার জন্ম। সে কি খুশি সবার মনে। মাথায় রাখে নাই ওকুনে খাবে। মাটিতে রাখে নাই পিঁপড়ায় খাবে। তাই কোলে কোলে করে রেখেছে।
একটা বুজুর্গ মানুষকে স্বর্ণের চাঁদ বানিয়ে দিয়েছিলেন আমার জন্ম উপলক্ষে। বাড়িতে দাদার খুশি আর ধরে না। তিনি সাতদিন পর্যন্ত চারদিকের গ্রামের মানুষকে তদানীন্তন সময়ে চিটাগং সিডিএ মার্কেট থেকে মহিষ কিনে এনেছিলেন। শুধু সবাইকে মহিষ জবাই করে তা দিয়ে নেমন্তন্ন করেছিলেন। যা এখনো ওই জেনারেশনের লোকের মুখে মুখে আছে আজও স্মৃতিতে ভাস্বর।
আমার “মা” ছিলেন এক বনেদী পারিবারের মেয়ে। “চন্ডিপুর”,ব্রাহ্মণ পাড়ার আমির ভূঁইয়া পরিবারের আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া মাস্টার এর সবচেয়ে ছোট মেয়ে। আমার নানা ১৯২১ সালে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে মুসলিম ছাত্র হিসাবে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে তিনবার দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। তখন কলকাতায় সাব রেজিস্টারের চাকরির অফার পান।
তিনি সে চাকরি না করে, গ্রামে চলে আসেন। এসেই গ্রাম গড়ে তোলার কাজ করেন। মজিদ মাস্টার, আমার “মা” তার বাবাকে চোখে দেখেন নাই। কারণ নানীর পেটে ছিলেন যখন নানা মারা যায়। নানীকে নিয়ে চলে তার জীবনযুদ্ধ।
মা-বাবার বিয়ে হবার পর আমাদের বাড়িতে প্রথম আসেন একটি রিক্সার চারদিকে কাপড় মুড়িয়ে রিক্সার ড্রাইভার ছিলেন শিকারপুর গ্রামের ‘আলতা’ ভাই। তিনি এখন অতিশীপর বৃদ্ধ। গত বছরও এসেছিলেন আম্মার সাথে দেখা করতে।

আলতার কাছে তার নিজের অনেক অভাব অভিযোগের কথা “মা” শুনলেন এবং সব মিটিয়ে দিলেন। আমার মা-বাবা দুজনই নিজে না খেয়ে থাকবেন কিন্তু কেউ তাদের কাছে অভাবের কথা বললে তা সহ্য করবেন না। একবার অনেকের অভাব মিটাতে গিয়ে শেষ সম্বল নিজের পায়জামাতে গিয়ে ঠেকল। এমনি পরোপকারী ছিলেন।
আমার ‘মা’ শুনলেন যে আমি একটা গালাগাল দিতে শিখেছি। এটা বুঝেছেন। আর অমনি বাবার সাথে শহরে গিয়ে বাসায় থাকার বাসনা। কারণ ছেলে গালাগাল দেয়া শিখছে। তারপর মায়ের আরেক সংগ্রাম শুরু হল শাশুড়িসহ আমাদের ছোট ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে। প্রথমেই একটা সমস্যা হল তাদের পড়াতে অনেক টাকা লাগবে। টাকা কোথা থেকে আসবে? ‘মা’ একটা বুদ্ধি করলেন। মা-বাবা আমাকে ভালোভাবে পড়াতেন। তারপর আমিও ভালোভাবে আমার ছোট বোনকে পড়াতাম। তারপর সেই বোন আবার তার ছোট ভাইকে পড়াবে। এভাবে যে যার ক্লাসের চেয়ে বড় সে হবে তার শিক্ষক। মার বুদ্ধির কারণে আমরা পড়াশোনায় উন্নতি করেছিলাম।
তারপর মা বাবাকে বললেন আমরা গরু পালন করতে পারি। ছেলেমেয়েদের দুধের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হবে আর দুধ বিক্রির মাধ্যমে বাড়তি টাকাও আসবে। কিন্তু কাজটি ছিল খুব কঠিন। শুধু বললেই হবে না। সেই কাজটিও আম্মা সঠিকভাবে করেছিলেন। দিন-রাত প্রচন্ড পরিশ্রম করতেন ছেলেমেয়ের পড়ালেখার জন্য।
আম্মার শাড়ি,সোনার গয়নার প্রতি কোন লোভ বা মোহ ছিলোনা। একবার ঈদে অনেক টাকার সমস্যা হয়েছিল. যার ফলে ঈদের জামা কাপড় কিনা হবেনা? সবার মন খারাপ। আম্মা বললেন- হবে। আম্মার জর্জেটের খুব সুন্দর একটা শাড়ি ছিল। সেটা দিয়ে দর্জির দোকান থেকে তিন বোনকে জামা বানিয়ে দিয়েছিলেন। তিন বোন খুবই ফর্সা ছিল। আর মানিয়ে ছিলও খুব বেশ। আমার আম্মার বুদ্ধিদীপ্ত কাজের প্রশংসা না করে থাকা যায় না।
‘মা’ ভাই-বোন সবাইকে বলতেন প্রতিদিন একপাতা হলেও কোরআন পড়ো। নামাজ না পড়লে বাড়িতে ভাত হবে না। এমন কড়াকড়ি ছিল তার নির্দেশ। আর সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাইরে থাকা উনি পছন্দ করতেন না। যে কোন কাজ সন্ধ্যার পরে করা উনি পছন্দ করতেন না। যাই করো না কেন? চাইতেন সন্ধ্যার আগে বাড়িতে পৌঁছ।
“মা” বাড়িতে ‘দাই’ এর কাজ করতেন। কি কি সন্ধ্যা? কি রাত? যখনই ডাক পড়তো তখনই ছুটতো সেই বাড়ি। আর তাকে ঐ মাকে উপহার দিতেন অনেক কষ্টের পর পাওয়া সুন্দর একটি ফুটফুটে বাচ্চা। আমি তখন “অরগানন ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড” এ চাকরি করি। মাকে বললাম- ‘মা’ একটা ট্রেনিং নিয়ে নাও। আধুনিক চিকিৎসার সাথে ট্রেনিং হলে তুমি আরও ভালো করতে পারবে ‘মা’। এর পরের বার এসে দেখলাম একটা “মেটারনিটি টুল বক্স” তার সাথে। যাকে বলে সবকিছু মিলে খুবই সুন্দর। ট্রেনিংটা বড়িচং এ হয়েছিল। আমাদের বাড়িটা এই এলাকায় এই জন্য নাম করা।
বাড়িতে যেই আসুক যখনি আসুক। তার সাথে সব কথার সবচেয়ে বড় কথা। আগে একটা হাসি এবং তারপর প্রথম প্রশ্ন,” কি খাইছো বাপ বা মা?” খেয়ে নে তারপর সবকিছু। কোন কথাই শুনতেন না। আপনি খেয়ে এলেও খেতে হত। এতই মায়া ছিলো তার দরদ ভরা আবদারে।

আম্মার নিউজপেপার পড়ার অভ্যাস ছিল খুব বেশি। পেপার দেখলেই পড়তে চাইতেন। হউক তা পুরোনো বা নতুন। আম্মা যখন অসুস্থ ঢাকায় গিয়ে আমাকে ফোন দেয়। এইতো গুলশান, এইতো বাড্ডা বাবা সবইতো চিনি বাবা। শুধু আমার বাবা নাই, এই ঢাকাতে। ভয় পেওনা। মা আছিতো বাবা। এখন সবই আছে। শুধু “মা” নেই। ‘মা’ ডাকতে পারিনা। মায়ের ফোনটা পড়ে আছে। কই কেউতো ফোন করে না? এই যন্ত্রণা যে কি! তা বুঝাতে পারব না।
ভাই-বোন সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত হবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ জীবনে মার তুলনা শুধু মা। এক সংগ্রামী মা। যাকে এক জীবনে ভোলা যাবেনা। যার সাথে অনেক ঘটনা আছে। খাতার পাতা ফূরাবে কিন্তু মা‘র সাথে ঘটনা ফূরাবে না। কারণ আমি যে তার থেকেই তৈরি। আমার চোখের পানি চলে আসছে। কিছুতেই বাধা মানছে না। মা মাগো ওমা। মা তোমার জন্য দোয়া করি।
হে আমার রব, তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন।
রর্ব্বি হাম্হুমা-কামা-রব্বাইয়া-নী ছোয়াগীর।
আল্লাহ পৃথিবীর সকল মাকে ভালো রাখুন। আমিন।
লেখক:কৃষি উদ্যোক্তা,মিথিলাপুর,বুড়িচং।