‘আমোদ আনন্দে’ একটি পরিবার ও কয়েকটি জীবন

 

।। প্রফেসর আনোয়ারুল হক।।
‘অভাব-অনাটনের সাথে যুদ্ধ করে এ পর্যন্ত টিকে থেকেছি। আমার উত্তরসূরীরাও তেমনিভাবে কোন অন্যায়-অবিচারের কাছে নতি স্বীকার না করে, মাথা উঁচু করে যেন ‘আমোদ’কে চালিয়ে নিতে পারে।’ – এই ইচ্ছেটা ব্যক্ত করেছেন, মোহাম্মদ ফজলে
রাব্বী (১৯২৫-১৯৯৪) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, সাপ্তাহিক আমোদ।
পাঠকপ্রিয় এই পত্রিকাটি বর্তমানে ৭০ বছরে পদার্পণ করেছে। কম কথা নয়!
ঝকঝকে, পরিুছন্ন ‘আমোদ’ পত্রিকা হাতে নিলে আমি আজও সেই পুরনো গন্ধ থেকে
বিচ্যুত হই না। যেসময় থেকে আমি একটু একটু করে আজকের ‘আমি’ হয়ে উঠছি।
এখনকার খবর রাখা হয় না। কেননা, আজকাল লেখকের সঙ্গে প্রেসের সম্পর্ক নেই।
কিন্তু যে সময়ে ‘আমোদ’ পত্রিকা আলোর মুখ দেখেছে, সেই সময় সম্পাদক তো বটেই,
আমরা যারা লেখার ক খ শুরু করেছি এইরকম একটি পত্রিকাটিকে ঘিরে, চোখে লেখক,
কবি হবার স্বপ্ন, তখন প্রেসের কালির গন্ধ যেকোন সুগন্ধের মতোই মনে হতো।
সিসার ছোট ছোট অক্ষরগুলি কাঠের কোটরে বর্ণমালা অনুযায়ী সাজানো সজ্জা থেকে
আমাকে যাদুর মতো টানতো। কম্পোজিটারের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি দেখতাম, তার
নৃত্যরত আঙুল থেকে এক একটি বর্ণমালা উঠে আসছে আর কলাম মিলিয়ে কাগজের
পৃষ্ঠায় যেভাবে সেজে উঠতো তার চিত্রটা আমাদের কাছে ছিল প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে
থাকার মতো।
উনসত্তুরের পর থেকে সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে যখন কবিতা লিখতে আমাদের
কলম আবেগে কাঁপতো, লেখাটি রাব্বি মামা, সম্পাদকের হাত ঘুরে কম্পোজিটারের কাছে
যেত, আমার তর সইতো না। আমি মামার চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রেসটিতে ঢুকে যে
কর্মচারি কম্পোজ করতো কখনো তার কাছে, কখনো ছাপা-মেশিনের যান্ত্রিক শব্দের
কাছে আমার কৌতুহলি চোখ অপেক্ষা করতো কখন পত্রিকার পাতায় নিজের লেখাটি
দেখতে পাবো।
আসলে সেই সময়, আজ থেকে সত্তুর বছর আগে, প্রথম সময়, শিশুর যত্নের মতো
গড়ে তোলার জন্য পরিশ্রমের কঠিন সময়, সম্পাদকের মনের ইচ্ছেকে বাস্তবায়নের
প্রবল তাগিদের সময়কে অতিক্রম করে পত্রিকাটি আজ এই পর্যায়ে এসেছে।
পত্রিকার ইতিহাসে প্রাচীন, পাঠকের রুচির সাথে তাল মিলিয়ে সমকালীন চরিত্র বজায়
রেখে চলা এই পত্রিকাটি নিঃসন্দেহে আমাদের কুমিল্লার গর্ব। প্রকৃতির নিয়মে
শ্রদ্ধেয় সম্পাদক প্রয়াত হওয়ার পরে তাঁর কথামতো সৎ-উদ্যোগ নিয়ে কলুষমুক্ত
চরিত্র বজায় রেখে পত্রিকাটি কুমিল্লার মাটি-জল-হাওয়ায় মিশে পাঠকের পাঠ-তৃষ্ণা
মিটিয়ে যাচ্ছে আনন্দে। মামার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী বাকীন রাব্বিসহ সংশ্লিষ্ট

সকল কর্মকর্তা- কর্মচারির প্রচেষ্টাকে সম্মান জানাতে তাদের জন্য আমার প্রাণের
উষ্ণ অভিনন্দন।
‘আমোদ’ পত্রিকাটির বয়সের হিসাবের সঙ্গে আমার বয়সের হিসাব মিলালে এই
পত্রিকার বয়স আর আমার বয়সের ব্যবধান দুই বৎসরের। মোগলটুলিতে লালাদিঘির
উত্তর পূর্ব কোণের বাড়িটি, যেখানে আমার জন্ম সেটি আমার নানা সুজাত আলী
মোক্তার সাহেবের। নানা বাড়ির গায়ে লাগা পাশের দক্ষিণের বাড়ি দুটির মধ্যে আলো-
হাওয়ার ভাগাভাগি আছে। সেটি সৃষ্টিশীল এই মহান মানুষটির, যাঁকে নিয়ে আমি লিখছি,
তিনি আমার মেজমামা খুরশিদ আলম খানের বন্ধু, প্রতিবেশী এবং এই মামাদের সুবাদে
তিনিও আজীবন ছিলেন আমার রাব্বী মামা।
আমি যদি কল্পনার চোখ দিয়ে দেখি, তাহলে বলতে পারি, একহারা গড়নের লম্বা,
সুঠাম দেহের এই যুবক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীকে আমি যখন দেখেছি, তখন দুই বছরের
আমি আমার নানার তিন ছেলের ছোট, নাম জীবন, যিনি রাব্বী মামার ছোট ভাই টুনু মামার
বন্ধু এবং মোগলটুলি ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের ফুটবল খেলোয়ার তাঁর কাঁধে চড়ে নাতিদীর্ঘ
লালা দিঘীর পুকুরের ঠা-া জলের হাওয়া খাচ্ছি। আর মনের আনন্দে দুই বছরের ছোট্ট
দুটি পা দিয়ে জীবন মামুর সিনায় ড্রাম বাজাচ্ছি। শিশুটির চোখে আছে অদম্য কৌতুহল।
সেদিনের চোখের আয়নায় দেখতে পাচ্ছি আমার শৈশব, রোজ সকালের মতো রাব্বী
মামা পৈতৃক বাসা থেকে বের হয়েছেন। পরনে ইন করা সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট, যে
পোশাকে তাঁকে আমি বড় হয়েও সবসময় দেখেছি। কালো জুতো, চোখে কালো চশমা।
কখনো কখনো কাঁধে একটা ক্যামেরা ঝুলছে। এখন বুঝতে পারছি, প্রয়োজন হলে
পত্রিকার জন্য ছবি তুলবেন তাই সেটা নিত্য সঙ্গী। কখনো আমার মেজমামাকে তাঁর
সঙ্গে একসাথে দেখেছি। দুজনে কথা বলতে বলতে তাঁরা হাতের ডানের গলি ধরে হেঁটে
গেছেন নিজেদের গন্তব্যে। ‘সাপ্তাহিক আমোদ’ পত্রিকার নবীন সম্পাদক, রাব্বী মামা
গেছেন পুরাতন চৌধুরী পাড়ার দিকে, যেখানে তাঁর ‘আমোদ’ পত্রিকার অফিস, কার্যালয়,
বাসা, নতুন ঠিকানা। বলে রাখি, আমার আম্মা সব ভাই-বোনদের মধ্যে বড়, তাই মামা-
খালাদের মতো রাব্বী মামাও আম্মাকে ‘বুবু’ বলে ডাকতেন। যার জন্য নিকটাত্মীয়ের
মতো বাকীনের মা মিসেস ফজলে রাব্বীকেও আমি ‘মামী’বলে সম্বোধন করেছি। এই
সূত্রে ‘আমোদ’ কার্যালয়ে, বাসায় আমি যখনই গেছি, বোনপো’র মতো আপ্যায়ন, স্নেহ
পেয়েছি।
দুই.
লেখার শুরুতে ‘আমোদ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক রাব্বী মামা যে কথাটা
বলেছেন, তাতে কোন মেদ নেই। অতি বাস্তব উক্তি। যাঁদের কথা কথা-প্রসঙ্গে বলেছি,
সৎ এবং নিষ্ঠাবান জীবন যাপন বলতে যা বুঝায় তাই তাঁরা ছিলেন। ‘জনান্তিক নাট্য

সম্প্রদায়ের’ নাটক করার সময় অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য পেয়েছি রাব্বি মামার ছোট ভাই
টুনু মামার। কী অমায়িক তাঁদের আচার, আচরণ, ব্যবহার মনে পড়লে চোখ ঝাপসা হয়ে
ওঠে।
আমার সৌভাগ্য, ‘আমোদ’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর মতো
মানুষ, সম্পাদকদের দেখেই পেশাজীবনে সাংবাদিকতাকেও একটি স্বাধীন, সৎ,
পরিুছন্ন এবং আকর্ষণীয় একটি পেশা বলে জেনেছি। যদি কেউ আমাকে প্রশ্ন করে,
শিক্ষক না হলে আর কি হতাম ? তাহলে নিশ্চিত উত্তর দিতাম, সাংবাদিক। কেননা,
ছোটবেলায় রাব্বী মামার পরিশীলিত কথা-বার্তা, চাল-চলন, জীবন-যাপন আমি
নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছি। আমার প্রিয় শিক্ষক মোবাশ্বের আলী স্যারও ছিলেন রাব্বী
মামার আত্মীয়। এই মহান শিক্ষকও আমাকে সবসময় আকৃষ্ট করেছেন। নতুন চৌধুরী
পাড়াতে আমাদের বাসার উত্তরে যে তে-মাথা, স্টেশন রোড, ঠিক তার উল্টোদিকে
মোবাশ্বের আলী স্যারের বাসা। কোন কোন বিকেলে সম্ভবত লাল রঙের ছোট্ট একটি
গাড়ি নিজে চালিয়ে রাব্বী মামা ও মামী এসে স্যারের বাসার সামনে নামতেন। বালক আমি
হয়তো তখন ফুটবল খেলার মাঠের দিকে যাচ্ছি। তাঁদের দেখে দাঁড়িয়ে গেছি। সত্যি বলতে
কি, মুগ্ধ আবেশে আমি দুজনকে দেখতাম। আমাকে অবাক চোখের সামনে দিয়ে তাঁরা ধীর,
ঋজু পায়ে মোবাশ্বের আলী স্যারের বাসায় ঢুকতেন। তার মানে হলো, পুরাতন চৌধুরী
পাড়া ছেড়ে পৈত্রিক বাসা নতুন চৌধুরী পাড়াতে আমি চলে এলেও রাব্বী মামাদের সাথে
আমার ‘অদেখা’ রইল না। প্রায়ই তাঁকে আমি দেখতে পেতাম আমার পাড়ায়। আরও কী
কাকতালীয় ব্যাপার, নতুন চৌধুরী পাড়াতে এসেও আমি নিষ্ঠাবান, সাংবাদিক,
সম্পাদকের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হলাম না। পেলাম ‘রূপসী বাংলা’ পত্রিকার
সম্পাদক আবদুল ওহাব ভাইকে। পাড়ার সুবাদে ‘ভাই’ ডাকি, আমার পেশার সুবাদে ‘স্যার’
ডাকি। সে আরেক কাহিনী। আমি তখন যুবক।
তিন.
আজ যে আমি লেখালেখি করি, তার শুরুটা ছিল ‘আমোদ’ পত্রিকায় রাব্বী মামার হাত
ধরে। স্নেহে, উদারতায়, উৎসাহে। যখনই গেছি তাঁর কার্যালয়ে, ডেকে নিয়ে গেছেন
বৈঠকখানায় তাঁর সান্নিধ্যে, তখন ব্যক্তিত্বের দূরত্ব ছাড়া আর কোন দূরত্ব অনুভব
করিনি। তারও আগে, বালক বেলায় আওয়ার লেডি আব ফাতেমা কনভেন্ট স্কুল, যাকে
মিশনারি স্কুল বলে, সেখানে আমি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। মোগলটুলি ছেড়ে তখন আমরা
নতুন চৌধুরী পাড়ায় কবরস্থানের উত্তর পাশে নিজ বাড়িতে থাকি। সেখান থেকে রোজ
পায়ে হেঁটে তিন ভাই-বোন মিশনারি স্কুলে যাই। যারা জানে, তারা জানে, সেখান থেকে
মোগলটুলি লালা-দিঘির পাড় খুব দূরে নয়। আমারও নানাবাসার দূরত্ব খুব একটা বেশি
মনে হতো না। মাটির হাড়িতে নানি রান্না করতেন। অপেক্ষা করতেন নাতির জন্য। আর

আমিও নানির হাতের অনাস্বাদিত টমেটোর খাট্টা খাওয়ার লোভে টিফিনের ঘন্টাটা
পড়লেই এক দৌড়ে স্কুল থেকে মোগলটুলি নানার বাসায় হাঁফাতে হাঁফাতে পৌঁছতাম।
এই দৌড়ের পথে বাঁকে পুরাতন চৌধুরী পাড়ার তুলা তলার মোড়ে পড়তো ‘আমোদ’
প্রেস। অনিবার্য টানে আমাকে থামিয়ে দেওয়ার একটি যাদুঘর। প্রচ- টান অনুভব
করলেও সেখানে দাঁড়িয়ে কোন ধরনের কৌতুহল মিটানোর সুযোগ তখন আমার ছিল না।
কেননা, ফিরে গিয়ে সময়মতো পৌঁছতে না পারলে স্কুলে ঢুকতে পারবো না। কিন্তু পঞ্চম
শ্রেণির বালকটির দৌড়ের ভিতর ঠিকই কানে লাগতো ‘আমোদ’ প্রেসের ক্রাডেল ছাপা
মেশিনের ঘটাং ঘটাং মোহ সৃষ্টি করা সেই আওয়াজ, যা শুনলে আমার পা থেমে যেতে
চাইতো। কখনো কখনো সে অদম্য কৌতুহলে জানালা দিয়ে উঁকি মারতো। চোখ আটকে
যেতো, দেখতো, নৃত্যের ভঙ্গিতে ছাপা মেশিনের পিছনে দাঁড়ানো একটি লোকের পা উঠা-
নামা করছে আর সাথে সাথে মেশিনের পিঠের দিকে ছাপানো পত্রিকা বের হয়ে হাতার
উপর জমছে। ঐ সময়ে ঐ বয়সে বালকটির কাছে এর চেয়ে বেশি আশ্চর্যজনক ঘটনা আর
কিছু ছিলনা।
চার.
বড় হতে হতে আজ আমি যদি পিছন ফিরে দেখি, তাহলে বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের
বেড়ে ওঠার কালে এমন কিছু ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য আমরা সামনে পেয়েছি, যার ফলে
আমাদের আজকের ‘আমি’ হওয়া সহজ হয়েছে। সুন্দর হয়েছে। লেখালেখিতে যে আনন্দ,
সাংবাদিকতার মতো পরিশ্রমী পেশার মধ্যে সৃষ্টিশীলতার যে সৌরভ, তা শুধু নিজেকে
নয়, ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রকেও আলোকিত করে। রাব্বী মামার মতো সমাজসেবী অনন্য
মানুষেরা সেটা করে দেখিয়ে গেছেন। পরের প্রজন্ম হিসেবে আমরা তা অনুধাবন করি।
কোন কোন মানুষ টিকে থাকে। কোন কোন মানুষ বেঁচে থাকে। ‘আমোদ’ পত্রিকার
সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীরা তাঁদের কর্ম এবং রেখে যাওয়া কর্ম-
প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিনের স্বপ্নের মধ্যে বেঁচে থাকেন। মানবিক, সচেতন চিতের মানুষ
সেটা উপলব্ধি করে।
আমাদের চারপাশে কারো কারো চোখ অন্ধ বটে, তবে সবার চোখ নয়। দেখার চোখ
যাঁদের আছে, তাঁরা অদেখাকেও দেখে। সত্যি বলি, আমার চোখ থেকে আমার প্রিয়
মানুষেরা কখনো সরে যায় না। শুভকামনায় তাঁদেরই একজন, ‘আমোদ’ পত্রিকার প্রয়াত
সম্পাদক, মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী। আমার প্রিয় মামা। সবসময় যিনি আমোদে ছিলেন।
আমোদে আছেন।

লেখক: সাবেক বিভাগীয় প্রধান।

বাংলা বিভাগ,কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ।