আমোদ শুধু পত্রিকা নয়- আপনজন

 

।। রেজাউল করিম শামিম ।।

সংবাদপত্র সময়কে ধারণ করে,সন্দেহ নেই। সময়ের বাস্তবতায় সংশ্লিষ্ট এলাকার শিল্প,সাহিত্য,সংস্কৃতি,ক্রীড়া,জীবনাচার,লোকাচার,ঘটনা ইত্যাদির মতো সামাজিক অবস্থানের একটি পরিচ্ছন্ন প্রতিচ্ছবি। তাছাড়া সাংবাদিক-সাহিত্যিকসহ সৃজনশীল মানুষ তৈরির পরিবেশও কিন্তু সৃষ্টি করে সংবাদপত্র।
আমাদের কুমিল্লা অঞ্চলের তেমনি একটি পত্রিকা ‘আমোদ‘। আমোদ নিজেও কিন্তু এটি সমৃদ্ধ ইতিহাস। বছরের পর বছর ধরে নিজের বুকে পরিবেশ পরিস্থিতির কতকথা এঁকেবুকে জমিয়ে রেখেছে শতাব্দীর স্বাক্ষর। এটা আমাদের জন্যে অবশ্যই গর্বের,আনন্দের।
আমার মনে আছে,‘৭৫ সালে অন্যান্য জাতীয় দৈনিকের মতো দৈনিক বংলার বাণী এবং বাংলাদেশ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আর আমি ঐ দু‘টি পত্রিকাতেই কাজ করতাম। ফলে সাংবাদিকতায় নিজেকে জড়িয়ে রাখতে তখন আমোদই ছিলো আমার অবলন্বন।
আমি আমরা তখন যে ক‘জন সাংবাদিকতা করতাম আমোদ এর সাথে তাদের ছিলো পারিবারিক সম্পর্ক। মনে আছে সেবাসায় প্রথম গিয়েছিলাম তারেকের সাথে। তারেক( আজকের পরিচিত মুখ কবি সৈয়দ আহমাদ তারেক)। ছিলো আমার পাড়ার ছোটবেলার বন্ধু। সে তখনই লেখালেখি করতো। সে কারণেই আমোদ-এ যাওয়া। যাওয়া আসা করতে করতেই ঘনিষ্ঠতা। আমোদ সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী ভাই এবং ভাবী আমাদের খুবই স্নেহ করতেন। সেসুবাদে টুকটাক নিউজ বিশেষ করে পার্টির নিউজ বেশি দিতাম। তার মধ্যে আবার কালাম ভাই( প্রয়াত নেতা অধ্যক্ষ কালাম মজুমদার)এর নিউজই থাকতো বেশি। কারণ তিনি কর্মকাণ্ড যেমনি বেশি করতেন তেমনি আবার ছিলেন সাংবাদিকবান্ধব। ওনার সাথেও আমোদ-এর পারিবারিক সম্পর্ক ছিলো।
সাংবাদিকতার প্রথমদিককার অনেক কিছুই আমোদ আর রাব্বী ভাই,আফতাব ভাই, মোস্তফা ভাই,রজত নন্দির কাজ থেকে শেখা। সাংবাদিক সম্মেলন শব্দটির প্রথম পরিচিতিই রাব্বী ভাইয়ের সঙ্গে থেকে। আমার এখনো মনে আছে। ‘৭৩ সালের দিকে তখনকার বিরোধীদল জাসদের মিছিলে গুলির ঘটনায় একজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গোটা শহর তখন থমথমে অবস্থা। রেজাভাই (অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান),মাঈনুল ভাইসহ(অওয়ামী লীগ নেতা মাঈনুল হুদা) অন্যান্যরা তখন কান্দিরপাড়ের প্যানরোমা নামের আবু ভাইয়ের লাইব্রেরিতে বসতেন। আর তার উল্টো দিকে রহমান ব্রাদার্স নামের লাইব্রেরিটি ছিলো সিনিয়ার সাংবাদিক আফতাব ভাইয়ের। তখন ছাত্রলীগের সভাপতি রুস্তম আলী, সাধারণ সম্পাদক আকবর কবির ভাই,সহ সভাপতি বাহাউদ্দিন বাহার ভাই ও নাজমুর হাসান পাখি। মূলত তারাই সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিলেন।

কিন্তু সাংবাদিক হিসাবে ঠিক কি করতে হবে বুঝতে পারছিলাম না। রেজা ভাইরা তখন ঢাকা থেকে সাপ্তাহিক বাংলাদেশ( মুক্তাঞ্চলে প্রকাশিত প্রথম সাপ্তাহিক লেখা থাকতো ব্যানারে) চালাতেন। আর তার কুমিল্লা প্রতিনিধি ছিলাম আমি। তো খবর পেয়ে ফ্যনারোমায় গিয়ে হাজির। রেজা ভাইয়েরাও ছিলেন। তখন কোন প্রেস ক্লাব ছিলোনা। রেজা ভাই বল্লেন,নিউ মর্কেটের উল্টো দিকে দোতলায় যেতে। সেখানে ছাত্রলীগ অফিসের পাশে ‘টুইন ক্লাব‘ নামে একটি কক্ষ আছে,সেখানেই হবে সাংবাদিক সম্মেলন। আসলে রাব্বী ভাই,আফতাব ভাইরা সেখানে নিয়মিত বসতেন। আর সেটাকেই প্রেস ক্লাব হিসাবে বিবেচনা করা হতো। তা যাই হোক সেখানে গিয়ে,রাব্বী ভাই, আফতাব ভাই,মোস্তফা ভাই,রজতদা আর হোসেন ভাই নামে দৈনিক বাংলার একজন প্রতিনিধিকে পেয়েছিলাম।

পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে বেশ ক‘জনকে সাংবাদিক হিসাবে পাশে পিয়েছিলাম। তাদের মধ্যে বন্ধু আলী হোসেন চৌধুরী,প্রদীপ সিংহ রায় মুকুট, মাহবুবুল আলম, অহিদুর রহমান,কাজী মমতাজ উদ্দিন, তপন সেন গুপ্ত,আবুল হাসানাত বাবুল,অশোক বড়ুয়া,শান্তনু হাসান খান,শাহজাহান চৌধুরী প্রমুখ। পরে অবশ্য আরো অনেক নাম যুক্ত হয়েছে। আর সকলের সাথেই আমোদ পরিবারের সখ্যতা-ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে।

বিভিন্ন অনুষ্ঠান,ঘটনা-দুর্ঘটনায় আমরা উপস্থিত থাকতাম। রাব্বী ভাই সম্পাদক হলেও আমাদের সাথেই থাকতেন সাংবাদিক হিসাবে। আবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখতেন। শুধু তাই নয়। ক্যামেরা নিয়ে ছবিও তুলতেন। সেসময় সিসার টাইপে কম্পোজ আর ফ্ল্যাড মেশিনে নিউজপ্রিন্টে ছাপা পত্রিকায় ছবি ছাপানো ছিলো খুবই দূরহ ব্যাপার। ঢাকা থেকে ছবি ব্লক আকারে তৈরি করে এনে দু‘একটি ছবি কালেভদ্রে ছাপা হতো। তবু রাব্বী ভাই ছবি তুলতেন। পরবর্তীতে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ওনার একমাত্র ছেলে বাকীন রাব্বী। সে অবশ্য ছবিগুলো কাজে লাগিয়েছে। ছবির চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে।

সেসময় আমোদ একটা বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো। বৃহত্তর কুমিল্লার একমাত্র পত্রিকা ছিলো। ফলে জাতীয়ভাবেও এর ছিলো পরিচিতি। অনেক নামিদামি ব্যক্তিও আমোদ-এর সাথে যুক্ত ছিলেন। আমার জানামতে তাহের উদ্দিন ঠাকুর, পিআইবির প্রশিক্ষক রফিকুল ইসলাম নাসিম, সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী এমনি অনেকেই। আর জাতীয় পর্যায়ের পরিচিতির কারণে অনেক বিদেশি রাষ্ট্রীয় অতিথি বাংলাদেশ সফরে এলে ‘আমোদ“ পত্রিকা অফিস পরিদর্শনও তাদের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত থাকতো। আমার মনে আছে একবার সেনেগালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেকেতারু সফরে এলে আমোদ পরিদর্শন করেন। সেসময় রাব্বী ভাইয়ের নিমন্ত্রণে কালাম ভাইয়ের সাথে আমিও উপস্থিত ছিলাম। কালাম ভাই এমনিতেতো বেশ রসিক লোক ছিলেন। বিভিন্ন ঘটনায় তার প্রতিফলন দেখা যেতো। এক্ষেত্রে তার নমুনা দেখতে পেলাম। ওনার গায়ের রং ছিলো অপেক্ষাকৃত কালো। তো তিনি,আফ্রিকান কুচকুচে কালো সেকেতারুর সাথে নিজেকে তুলনা করে বলেন, দেখো তার পাশে আমাকে অনেক ফর্সা দেখাচ্ছেনা ?

আমোদ অফিসের অবস্থানটি ছিলো বেশ মনোরম পরিবেশে। অফিসের পেছনে বাসা। পাশেই প্রেস সেকশন। আর তার সামনে বেশকিছু জায়গা। উঠোনের মতো স্থানটি ফাঁকা। সেখানে সোফা, চেয়ার সাজিয়ে পালন করা হতো আমোদ-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। রাব্বী ভাই জীবদ্দশায় প্রায় প্রতি বছরই অনুষ্ঠানটি করতেন। অন্যান্য কিছুর সাথে সেখানে পিঠাপুলি থাকতোই। আর থাকতো বিনয়ী রাব্বী ভাইয়ের কন্ঠে স্থান সঙ্কুলানের সংকটের কারণে সকলকে নিমন্ত্রন করতে না পারার আকুতি।

আমোদ-এর সবচেয়ে বড় বিষয় যেটি মনে রাখার মতো, সেটি হলো পত্রিকার গুণগতমান,গুরুত্ব,তথ্যের ওজন ইত্যাদি বাদ দিলেও যেটি বড় হয়ে সামনে আসে। সে সময়কে ধরে রাখা। তখনকার সমৃদ্ধ মানুষজনে সংস্কৃতি অঙ্গনের সৃজনশীলতার একটা ধারণা লাভ করা যায় আমোদ-এর কারণেই। আমোদ,এ অঞ্চলে অনেক পুরনো পত্রিকা তাতে সন্দেহ নেই। ইউনেস্কোর আঞ্চলিক পত্রিকার তালিকায় নাম উঠেছে অনেক আগেই।

তবে পত্রিকারটির এমনি গৌরবের সব পালকের মধ্যে আমার কাছে এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ না করলেই নয়। তা হলো, আক্ষরিক অর্থেই পত্রিকাটি একটা সময় ছিলো সম্পূর্ণ পারিবারিক উদ্যোগ এর প্রতিফলন। রাব্বী ভাই ভাবীতো বটেই,পরিবারের সবক‘জন মেয়ে এবং একমাত্র ছেলের সন্মিলিত প্রয়াস হলো পত্রিকাটি। সংবাদ বা লেখালেখি,প্রুফ দেখা এমনকি ছাপানো-সব কিছুতেই তাদের হাতের স্পর্শ ছিলো। সকলে অভ্যস্থও ছিলো এসব কাজে।

বছরের পর বছর,আমোদ-এর সাথে বিভিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট থেকে পত্রিকা,পত্রিকার পরিবার পরম্পরায় খুবই আপনজন মনে হয় আমোদকে। সেপরিবারের গন্ধও যেনো মেখে আছে শরীরে। সহজেই অনুভব করা যায়। ফলে আমোদ-এর চলার পথ আরো দীর্ঘ,আরো মসৃণ,আরো লোকপ্রিয় হোক এটাই একমাত্র কাম্য।

লেখকঃ সাবেক সভাপতি কুমিল্লা প্রেস ক্লাব,কুমিল্লা সাংবাদিক সমিতি এবং কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগ।