আসুন রুখে দেই হেপাটাইটিস

।। অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ ইজাজুল হক ।।
২৮ জুলাই, বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। লিভার রোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রতি বৎসর এই দিবস পালন করা হয়। ভাইরাল হেপাটাইটিস সারা বিশ্বে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।হেপাটাইটিস ভাইরাস পৃথিবীর মারাত্মক ভাইরাসগুলোর মধ্যে অন্যতম, কোভিড-১৯ এর পরেই এর অবস্থান। সারা বিশ্বে ৩০ কোটির অধিক লোক দীর্ঘ মেয়াদী হেপাটাইটিস বি এবং সি তে আক্রান্ত, যারা ভবিষ্যতে লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার যঁুঁকিতে রয়েছেন। হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ১০ লাখের অধিক লোক মৃত্যুবরণ করে এবং প্রতি বছর ২০ লাখের অধিক লোক নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে।

লিভার সম্পর্কে কিছু কথা ঃ
লিভার বা যকৃত আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড় অঙ্গ। পেটের ভিতরের উপর ডান পার্শ্বে এর অবস্থান। একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের লিভারের ওজন প্রায় ১ থেকে ১.৫ কেজি যা শরীরের সম্পূর্ণ ওজনের ৫০ ভাগের এক ভাগ। তবে নব জাতক শিশুদের লিভার অপেক্ষা কৃত বড় থাকে যা কিনা শিশু জন্মের সময়ের ওজনের প্রায় ১৮ ভাগের এক ভাগ। লিভারে রক্ত চলাচল অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় বেশী, প্রতি মিনিটে প্রায় ১.৫ লিটার।
লিভার আমাদের শরীরের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে। আমাদের আহারের পরপরই খাবার ভেঙ্গে যে গ্লুকোজ তৈরি হয় তার অর্ধেক পরিমাণ লিভারে যায় এবং গ্লাইকোজেন হিসাবে জমা থাকে। পরবর্তীতে আমরা যখন অভূক্ত অবস্থায় থাকি তখন লিভার এই জমাকৃত গ্লাইকোজেন ভেঙ্গে শরীরের প্রয়োজনে করে গ্লুকোজ তৈরি করে। তেমনি ভাবে আমিষ ও চর্বি জাতীয় খাবার পরিপাকে ও লিভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া ঔষধ ও বিলিরুবিন বিপাকে লিভার মূল ভূমিকা পালন করে এবং ক্ষতিকর ঔষধ ও রাসায়নিক পদার্থকে অকার্যকর করে শরীর থেকে বের করে দেয়। কয়েকটি ভিটামিন লিভারে অনেকদিন জমা থাকে যেমন ভিটামিন এ, ডি, বি-১২।
হেপাটাইটিস বা জন্ডিস ঃ
হেপাটাইটিস বা লিভার প্রদাহ একটি মারাত্মক ব্যাধি। এর বহি: প্রকাশ হল জন্ডিস। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে যখন চোখের সাদা অংশ, চামড়া, ও প্রস্রাবের রং হলুদাভ হয় তখন এই অবস্থাকে জন্ডিস বলা হয়। আমাদের রক্তের লোহিত কনিকাগুলো একটা সময়ে স্বাভাবিক নিয়মেই ভেঙ্গে গিয়ে বিলিরুবিন তৈরি করে যা পরবর্তীতে লিভারে প্রক্রিয়াজাত হয়ে পিত্তরসের সাথে পিত্তনালীর মাধ্যমে পরিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করে। অন্ত্র থেকে বিলিরুবিন পায়খানার মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায় এবং কিছু অংশ অন্ত্র থেকে শোষিত হয়ে রক্তে যায় এবং কিডনীর মাধ্যমে প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে যায়। বিলিরুবিন এই পথ পরিক্রমায় কোন অসঙ্গতি দেখা দিলে রক্তে বিলিরুবিন বেড়ে গিয়ে জন্ডিস দেখা দেয়। রক্তে বিলিরুবিন স্বাভাবিক মাত্রা ১ মি:গ্রা:/১০০ সিসি বা তার কম। বিলিরুবিনের মাত্রা যদি ২ মি: গ্রা: এর বেশী হয় তখন রোগীর চোখ দেখে জন্ডিস বুঝা যায়। জন্ডিসের কারণ মূলতঃ ৩ টি। প্রথমত লিভারে প্রদাহ হলে দ্বিতীয়ত পিত্ত প্রবাহে বাধা এলে এবং তৃতীয়ত লোহিত রক্ত কনিকা কোন কারণে বেশী পরিমাণে ভেঙ্গে গেলে।
লিভারের প্রদাহ জন্ডিসের মূল কারণ। আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বেই জন্ডিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস ভাইরাস। হেপাটাইটিস এ, বি, সি এবং ই ভাইরাস লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করে যাকে বলা হয় ভাইরাল হেপাটাইটিস। এই ভাইরাস গুলোর মধ্যে হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস লিভারে দীর্ঘ মেয়াদী সংক্রমণ করে এবং ভবিষ্যতে লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সার তৈরী করতে পারে। হেপাটাইটিস এ এবং ই ভাইরাস পানি বাহিত ও অন্যকোন জটিলতা না থাকলে প্রায় শতভাগই সেরে যায়। কিছু কিছু ঔষধ সেবনে লিভারে প্রদাহ হয়ে জন্ডিস হতে পারে তার মধ্যে ব্যাথার ঔষধ ও টিবি রোগের ঔষধ অন্যতম। উন্নত দেশগুলোতে অতিরিক্ত মদ্যপান জন্ডিসের একটি অন্যতম কারণ।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ঃ
১৯৬৫খ্রিস্টাব্দে একজন অষ্ট্রেলিয়ান আদিবাসীর রক্তে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের অস্তিত্ব প্রথম ধরা পড়ে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ২৫ কোটি লোক হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত যাদের ৭৫% এশিয়া মহাদেশে বাস করে। আমাদের দেশে প্রায় ১ কোটি লোক এই ভাইরাসে আক্রান্ত। হেপাটাইটিস বি এইডস এর চেয়েও ১০০ গুণ বেশী সংক্রামক। বিশ্বে এইডস এর কারণে যত লোক মারা যায় হেপাটাইটিস বি এর কারণে তার চেয়েও অনেক গুণ বেশী মৃত্যু বরণ করে।
রক্ত ও রক্তরসের মাধ্যমে এই ভাইরাসটি ছড়ায়, যৌন মিলনের মাধ্যমে এবং জন্মের সময় আক্রান্ত মা থেকে এ ভাইরাস নবজাতকে সংক্রমিত হতে পারে। এ ছাড়া মানুষের লালা এবং শরীরের যেকোন ধরণের নিঃসরনের মাধ্যমে এটি সংক্রমিত হতে পারে। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত কোন ব্যক্তির রক্তমাখা সুইয়ের খোঁচায় ভাইরাস সংক্রমের আশঙ্কা প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ। হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আক্রান্ত মায়ের সন্তানের জন্মের পরপর আক্রান্ত হবার সম্ভবনা প্রায় ৯০ ভাগ। সামাজিক মেলা-মেশা যেমন হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি, রোগীর ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন- গ্লাস, চশমা, তোয়ালে, জামা-কাপড় ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় না। আক্রান্ত মায়ের দুধের মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়ায় না।
শতকরা ১০ ভাগ প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যাক্তি আর প্রায় ৯০ ভাগ শিশু যারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তাদের লিভারে স্থায়ী বা ক্রনিক ইনফেকশন দেখা দেয়। এ ধরণের রোগীদের প্রায়ই কোন লক্ষণ থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদেশে যাওয়ার সময় রক্ত পরীক্ষায় কিংবা রক্ত দিতে অথবা টিকা নিতে গিয়ে রোগীরা তাদের শরীরে বি ভাইরাসের উপস্থিতির কথা জানতে পারেন। এসব রোগীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ভবিষ্যতে লিভার সিরোসিস এবং লিভার ক্যান্সারে ভোগে যার চিকিৎসা জটিল এবং ব্যয় বহুল। হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধের একমাত্র উপায় টিকা নেয়া। এই টিকা খুবই কার্যকর । প্রাপ্ত বয়স্ক ও শিশু প্রত্যেকেই উচিত এই টিকা নিয়ে নেয়া। সাধারণত ১ মাস অন্তর অন্তর করে ০২ (দুই) টি টিকা এবং ০৬ (ছয়) মাস পর আরেকটি টিকা নিতে হয়।
হেপাটাইটিস বি সংক্রমণ আজ আর কোন দূরারোগ্য ব্যাধি নয়। লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারের মত মারাত্মক অবস্থা দেখা দেয়ার আগে এটি ধরা পড়লে নিরাময়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। বর্তমানে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কার্যকর অনেক ঔষধ রয়েছে। আমাদের দেশীয় একাদিক ঔষধ কোম্পানির অনেক গুলোই এদেশে তৈরি করছে, যা আমাদের সাধারণত মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে।
হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ঃ
১৯৮৯খ্রিস্টাব্দে এই ভাইরাস আবিস্কৃত হয়। পৃথিবী জুড়ে লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ এই সি ভাইরাস। পৃথিবীতে সি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ০৭ কোটি। বিশ্বে এইডস রোগীর চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বেশী। বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লক্ষ লোক এই ভাইরাসে আক্রান্ত। প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ৩০-৪০ লক্ষ লোক এই ভাইরাসে নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে। পাশ্চাত্যে এবং বিশেষ করে ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে হেপাটাইটিস সি এর প্রাদূর্ভাব বেশী। রক্ত সঞ্চালনের পূর্বে তা হেপাটাইটিস সি ভাইরাস মুক্ত কিনা সেটি যথাযথ পরীক্ষা করার ফলে উন্নত বিশ্বে যখন সি ভাইরাসের সংক্রমণ একদিকে কমে আসছে, তখন অন্যদিকে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। হেপাটাইটিস সি ভাইরাস মূলত ছড়ায় রক্তের মাধ্যমে, বিশেষ করে দূষিত সিরিঞ্জ ব্যবহারের মাধ্যমে। মাদক সেবীরা নিজেদের মধ্যে একই সিরিঞ্জ বার বার ব্যবহার করে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এছাড়া শেভিং রেজার, ব্লেড বা ক্ষুর ব্যবহারের মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। তবে যৌন মিলন বা আক্রান্ত মায়ের গর্ভস্থ শিশুর এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
শরীরে একবার এই ভাইরাস প্রবেশ করলে তা শতকরা ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রে লিভারে স্থায়ী সংক্রমণ তৈরী করে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যাক্তির শরীরে রোগের কোন লক্ষণ সাধারণত থাকে না। অথচ ১০-১৫ বছরের মধ্যে এদের অনেকেই লিভার সিরোসিসের মত মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হন এবং পরবর্তীতে তাদের লিভার ক্যান্সার দেখা দিতে পারে। তাই এই ভাইরাসকে অনেকে নীরব ঘাতক বলে থাকেন। এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন টিকা নেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস নিরাময়যোগ্য। এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী ঔষধ আমাদের দেশে পাওয়া যায় তবে এই চিকিৎসা অনেক ব্যয় বহুল যা সাধারণ মানুষের অনেকটাই নাগালের বাহিরে। তাই প্রত্যেকের উচিত এই ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন হওয়া। বিশেষ করে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ব্যবহার করা এবং শরীরে রক্ত নেয়ার দরকার হলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং করে নিতে হবে।
হেপাটাইটিস নির্ণয়ে দ্রুত ও কার্যকরী পরীক্ষা, স্বল্পমূল্যে কার্যকরী ঔষধ, শতকরা ৯৫ ভাগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন টিকা থাকা স্বত্ত্বেও হেপাটাইটিস নির্মূলের বাধাগুলো আমরা অতিক্রম করতে পারছিনা। বাধাগুলোর মধ্যে সচেতনতার অভাব, অপতথ্য ও কুসংস্কার অন্যতম। আসুন এসব বাধাকে ডিঙ্গিয়ে আমরা এগিয়ে যাই এবং ২০৩০খ্রিস্টব্দের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস ২০২৫ এর স্লোগান “let’s break it down- আসুন রুখে দেই” এ শামিল হই।
লেখক:সভাপতি, কুমিল্লা লিভার ক্লাব।