একান্তে বসে নির্জনে ভাবি– গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির

 

বাঙালি সমাজ জীবনে সবচে বড় সমস্যা কী? যা জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে মারাত্মক অন্তরায়। এই তল্লাটে বারবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। বিভিন্ন শাসকরা বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় এসেছেন। বাঙালি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণার চেয়ে নেতিবাচক মন্তব্য বেশি করেছেন। এ প্রসঙ্গে কিছু লিখতে চাই।

এখন প্রশ্ন হলো বাঙালির জীবনে সবচে বড় বাধা কোনটি গবেষণালব্ধ ইতিহাস এ বিষয়ে কী বলে? বাঙালি সমাজ জীবনে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির যেমন পরিচয় দিয়েছেন। তেমনি নেতিবাচক প্রভাবও কম নয়।
পরশ্রীকাতরতা, বিশ্বাসঘাতকতা, অকৃজ্ঞতা, নিজেকে না চেনা, ভোগবাদী সভ্যতায় উবে থাকা, যাকে বুকে টানবেন সেই প্রথমে আপনার বুকে খঞ্জর চালাবে, রাতারাতি দেশ এবং জাতিকে ধ্বংস করে লুটেপুটে খেয়ে আলাদিনের চেরাগ সাজে। এদেশের চোরচোট্টা কলকাতার ধর্মতলায় গিয়ে বড় আলেম সাজে। অনৈতিকতায় সারাজীবন অভ্যস্ত থেকে গেরুয়া পোশাক পরে গঙ্গার পাশে আস্তানা গড়ে তোলে। বিদ্যা শিক্ষা থেকে দূরে থেকে খাল কেটে কুমির ডেকে আনে। নিজের সর্বনাশ নিজে করে। যে জাতি আপন জাতীয় গৌরব, জাতীয় শ্র্রেষ্ঠত্ব, জাতীয় মহত্ব ও অবিচল দৃঢ়তা এবং সংবর্ধনা করতে পারে না এবং হীনতা ও স্বেচ্ছাচার অবলম্বন করে, সে জাতি কখনো অন্য জাতি হতে সম্মান কিংবা পূজা পেতে পারে না।
বিশেষ করে বিদ্যার প্রতি অনীহা মুসলিম সমাজে। যা দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। তারা যেন এক উদাসী পাখি। হাওয়ার ওপর ভর করে তাদের সমাজ জীবন চলে। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা এক প্রকার নেই বললে চলে। অপরের ওপর ভরসা করে দিন চলে। যার জন্য দিনকে দিন মুসলিম সমাজ অধঃপতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

একান্তে বসে নির্জনে ভাবি। বিবেকের কাছে অনেক প্রশ্ন করি। কোথায় আজ মানবতা? কোথায় আজ বিবেক,শাশ্বত চিন্তা-চেতনা? কোথায় হারিয়ে গেল শিক্ষা-দীক্ষা,জ্ঞানগর্ব? কোথায় এগিয়ে যাচ্ছে সমাজ-সভ্যতা। দিনকে দিন সব ভূলুন্ঠিত। নীতি-নৈতিকতা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। পেশাজীবীদের হাতে পেশা নেই। পেশাদারিত্বের কোনো পরিচয় নেই। রাজনীতিকদের হাতে রাজনীতি নেই। সাংবাদিকের হাতে সংবাদপত্র নেই। আইনজীবীর হাতে আইন পেশা নেই। প্রকৃত মেধাবানদের সমাজে কোনো জায়গা নেই। জ্ঞানী-গুণীর প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই; কদর নেই। সব এখন দলবাজীদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের দৌরাত্ম্যে সমাজ জীবন দিকভ্রান্ত।

সত্য কথা বলার কোনো অধিকার নেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার কোনো উন্মেষ নেই। জাতি যেন বোবা কান্না কাঁদছে। সব কিছু গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলছে। যারা দেশকে নিয়ে ভাবেন, জাতিকে নিয়ে গভীরে চিন্তা করেন তারা আজ নির্বাক; হতভম্ব এবং ভীতসন্ত্রস্ত। দেশে জ্ঞানী-গুণী, সৃষ্টিশীল, চিন্তাশীল মানুষ সৃষ্টিতে নিরন্তর বাধা পড়ছে। দিনকে দিন জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। দেশে সৃষ্টিশীল মানুষের কোনো ভাবনা নেই। গবেষণালব্ধ কোনো চেতনা নেই। সৎ, ন্যায়ানুগ, আদর্শিক মানব সৃষ্টির সকল কারখানা বন্ধ। এই সুযোগে তীর্থের কাক চাটুকার, মোসাহেব, তেলবাজ, ধান্ধাবাজরা বাংলার একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কোথায় সস্তায় মওকা মেলে। কাকে কখন ধান্ধায় ফেলে, অবৈধ অর্থকড়ি হাতিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘আমাদের কৃতীসন্তান!’ প্রত্যহ রুটিন অনুযায়ী লেখা-পড়া করার চেষ্টা করি। দেশ-বিদেশের নানা খবরের কাগজ দেখি। ত্রিবিধ পেশা নিয়ে কমবেশি ব্যস্ত থাকি। দেশকে নিয়ে ভাবি। মনে করি দেশপ্রেম ইবাদতের একটি অংশ। দীর্ঘদিন থেকে লক্ষ্য করে আসছি এদেশে সবাই নেতা! দলে কর্মী নেই বললেই চলে। সোশ্যাল মিডিয়া খুলবেন। দেখবেন দেশের অলি-গলিতে কৃতী সন্তানে ফাউল। সবাই এখন টাকার জোরে তথাকথিত ‘কৃতী সন্তান’ সেজেছেন! নেতা বা কৃতীসন্তানের সস্তা তকমা গায়ে লাগিয়ে চলেছেন।

বাহ…. বেশতো! কী সুন্দর সোনার বাংলায় সোনার মানুষগুলো। বঙ্গবন্ধু তো সোনার মানুষ চেয়েছিলেন। তবে এরা বঙ্গবন্ধুর সোনার মানুষ না। এরা ছদ্মবেশী লুটেরা, সমাজের দুর্জন। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেশের জনগণ।

হালে খুব সহজ পেশা সাংবাদিকতা। লেখাপড়া করা লাগে না। গবেষণালব্ধ কোনো কাজ নিয়ে সাধনা করা লাগে না। পরিচয়! ‘আমি সাংবাদিক’। ব্যাস, খেল খতম। সাংবাদিক ভাইরা ফেসবুকে ওমুক-তমুক কৃতী সন্তানদের নাম, ঠিকানা পোস্ট দিয়ে চলেছেন। তবে কিছুর বিনিময়ে (!)। অলি-গলিতে ফেসবুক সাংবাদিক কিলবিল করছে। টাকা ভাগাভাগি নিয়ে পরস্পর জটলা পাকাতে দেখা যাচ্ছে। শুনেছি কাকের রক্ত কাকে খায় না। ফেসবুক সাংবাদিক ভাইরা একে-অপরের পকেট মারার চেষ্টায় সদা ব্যস্ত। পরস্পর হন্যে হয়ে উঠতে দেখা যায়। কিছু তরুণ বয়সীদের জানতে চেয়েছিলাম উপরে উল্লেখিত বিষয়ে, তারা তাদের সুচিন্তিত মতামত দিয়েছে এভাবে – সবাই অভিন্ন সুরে বিশ্লেষণধর্মী মতামত দিয়েছেন-

অ্যাড.নাহিদ সুলতানা: কৃতীসন্তান হতে গেলে অবশ্যই সেখানে প্রীতির প্রয়োজন হয়। যারা দেশ জাতিকে নিয়ে অবিরাম ভাবছেন, দেশ জাতির স্বার্থে সার্বক্ষণিক চিন্তায় নিজে ব্যস্ত থাকেন,কষ্ট করেন আমার নিকট তিনিই কৃতীবান। যিনি নিজের ভোগবিলাসের কথা চিন্তা না করে মানুষের কথা চিন্তা করেন বা পৃথিবীর সকল মানুষের কল্যাণে অবদান রেখে গেছেন তিনিই কীর্তিমান।

মো. ইকবাল আহমেদ (শিক্ষক): বর্তমান যুগে ঘরে ঘরে, কৃতী সন্তান
ডাঃ নজরুল ইসলাম রিপন, সোনার ছেলে আর কৃতীসন্তানরা নাম কুড়ানোর জন্য কখনো ফটোসেশন করে বেড়ায় না। জাতির কাছে তারা মহীরুহ হয়ে থাকেন।

এম. জুবায়ের আহমেদ: চোর, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, ধর্ষক, মুর্খরা এখন সোনার ছেলে। আর কোনো রকমে মামুর জোরে একটা সরকারি চাকরি পেয়ে গেলে সেই হয়ে যায় রাতারাতি দেশের কৃতীসন্তান।

অলিউর রহমান: দেশে কৃতীসন্তানের সংখ্যা ৭০%। আর সব আঙুল চোষার দল!

গাজী সাবিহা সুলতানা নিপা : আগে দেশ গ্রামে দু’একটা পাওয়া গেলেও আজ ঘরে ঘরে কৃতীসন্তান এবং সোনার ছেলে পাওয়া যাচ্ছে। আসলে সামাজিক অবক্ষয়জনিত সমাজ ব্যবস্থায় ‘ছাগলে চাটে বাঘের গাল’। আমরা দিন দিন সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

এস এস ইলিয়াস: কৃতীসন্তান তারা-যারা পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষের জন্য কীর্তি রেখে যান। আমাদের দেশে কৃতী সন্তানের বর্তমান ঘাটতি নেই। অলি-গলিতে কৃতী সন্তান।

বোদ্ধামহল কালেভদ্রে প্রশ্ন করেন, এরা কী করে কৃতী সন্তান হয়? সমাজে কী কী কৃতীতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন? সাধারণ মানুষের সেবায় ক’টি দাতব্য প্রতিষ্ঠান খুলেছেন? রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে কী কী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন? জাতি গঠনে কী কী কনসেপট দিয়েছেন। দেশ-জাতির উন্নয়নে অতীতে কী কী অবদান রেখেছেন? দেশের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে কী মূর্তমান ভূমিকা পালন করেছেন? দেশ-জাতি আমৃত তাকে স্মরণে রাখবে। এসব কাজের যারা ভাগিদার আপনি তাদের বলতে পারেন ‘কৃতী সন্তান’।
এ ধরনের কোনো কাজ তিনি জীবনে করেননি বা অংশও নেয়নি। বরং রাজনীতির সাইনবোর্ডের আড়ালে অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। সস্তা রাজনীতি করে বিত্তের মালিক হওয়া অন্য জিনিস। আর আন্দোলন সংগ্রাম করে আদর্শিক নেতা হওয়া ভিন্ন জিনিস। তাই বিবেককে জিজ্ঞেস করুন এবং বলুন ‘কৃতী হতে গেলে সবাইকে আগে প্রীতি হতে হয়’। প্রীতির দিকে এগিয়ে যান। জনগণ হৃদয় থেকে বলবেন ‘আমাদের কৃতী সন্তান’।

‘সবাই কৃতী সন্তান, দুর্জন কারা’?

মোটা টাকার বিনিময়ে পদ দখল করা যায়। সরকারি পদ-পদবি পাওযা যায়। এদেশে টাকা হলে উড়ে এসে জুড়ে বসা যায়। সৃষ্টিশীল মানুষ না হলে কৃতী সন্তান হওয়া যায় না। টাকার বিনিময়ে নেতা হওয়া অন্য জিনিস। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় নেতা এবং নেতৃত্ব ভিন্ন জিনিস। নেতা হতে গেলে দেশ জাতিকে নিয়ে নিরন্তর ভাবতে হয়। দীর্ঘ মেয়াদি একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। কর্মীবান্ধব হতে হয়। কোনো একদিন জাতি তাকে নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেন। নেতা হঠাৎ কিছু অর্থ কড়ির মালিক হয়েছেন। বনের রাজা সেজেছেন। রঙিন ফানুস দেখছেন। মন্ত্রী, এম.পি হবার বাসনা করছেন। নেতার টাকা হয়েছে। তাই চামচিকারা লিখছে দুটো টাকার বিনিময়ে ‘অমুক-তমুক কৃতী সন্তান’। মাইক ফুকিয়ে গলা চেঁচিয়ে বলছে ‘আমাদের কীতি সন্তান’। অবৈধ টাকা আর বিত্তবৈভবের মালিক হলে আপনিও সমাজ সেবক। সমাজের বড় দানবীর! ওমুক কমিটি, তমুক কমিটির সভাপতি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে সমাজের বড় সুদখোর, ঘুষখোর। তিনিও সার্টিফিকেট পেয়েছেন সমাজের কৃতী সন্তান।

বাংলাদেশে চলমান যে অবস্থান রাজনীতির তকমা গায়ে লাগিয়ে অর্থ বানাতে পারলে সবাই কৃতী সন্তান বনে যায়। মোসাহেব, চামচার কোনো অভাব নেই। সস্তা কাগজের পোস্টার আর চামচাতুষ্টির জন্য কিছু ব্যবস্থা করলে আপনিও হতে পারেন কৃতী সন্তান। সমাজে এখন আর দুর্জন বলে কেউ নেই। এদের হুংকারে নিকটস্থ অভয় অরণ্যে চোর বাটপাররাও আশ্রয় নিয়েছে।

ওরাও কৃতী সন্তান !

প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী কখনো কৃতী সন্তান হতে পারে? নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে হতে পারে। চলমান সমাজ ব্যবস্থায় কোথায় পাবেন সেই আমলা, রাজনীতিকদের? যাদের স্বপ্ন ছিল মানুষকে ঘিরে। মানুষের উষ্ম ভালোবাসায় তারা সিক্ত হতেন। তাই সর্বসাধারণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে যত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন আমলা, রাজনীতিদের নামে। তারা প্রকৃত অর্থে সেবক ছিলেন। সেবক মানে চাকর। চাকরের চাকর। ঢাকা শহরে অধিকাংশ রোড আজো ব্রিটিশ রাজন্যবর্গের নামানুসারে। কার্জনের কাছে এই বাংলার মানুষ চির অমর,চির কৃতজ্ঞ। সত্যিই জনগণ ভালোবেসে তাদের আজো অমর করে রেখেছেন।

আবার একটু পেছনে ফিরে যাই। কিছু কমেন্টসকারী আরো লিখেছেন….’প্রজাতন্ত্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অধিকাংশই দেখা যায় অর্পিত দায়িত্ব পালনের বাইরে তারা কিছুই করেন না? একেতো ঔপনিবেশিক স্টাইলে জীবন যাপন। অতঃপর জনগণ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন থাকার চেষ্টা করেন’। তারা কী করে লোনা পানি,মিঠা পানির কৃতী সন্তান বলে দাবি করে এসব ভাবিতব্য বিষয়।
এবার গভীরে গিয়ে দেখেনতো রাজনীতিকদের নামে জনগণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কেন গড়ে তুলতেন? উত্তর,জাতির প্রতি অসামান্য অবদানের কারণে। আমার ভাষায় সে-ই কৃতী সন্তান যিনি জাতি রাষ্ট্রকে কিছু উপহার দিতে পারেন। দেশ-দশের যদি উপকারে কিছু না আসে সে আবার কিসের কৃতী সন্তান? হাল জমানায় মাস গেলে পকেটে সরকারি টাকা চলে এলো। আয়েশী জীবন চললো ভালো। অতঃপর নানা অনিয়মের বেড়াজালে বন্দি হয়ে কৃতী সন্তান সেজে বসলাম। খোঁজ নিলে দেখা যাবে রাতারাতি আলাদিনের চেরাগ সেজে ভদ্রলোক বনে গেছেন। এই জাতি রাষ্ট্রের কী উপকারে আসতে পারে তার কাছ থেকে? জাতিকে কী উপহার দিতে পারেন তিনি?
যাদের অসামান্য অবদানে ধন্য দেশ-বাসি। হাল জমানায় প্রজাতন্ত্রের এক কর্মচারী কৃতী সন্তান হয় কিভাবে? ফেসবুক সাংঘাতিকদের টুপাইসের বিনিময়ে এসব তত্ত্ব আবিষ্কার। অন্তত কিছুটা হলেও সমাজে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে হবে। তাহলে কাউকে খড়কুটো, তেল মালিশ করতে হবে না। জাতি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলবেন কৃতী সন্তান।

লেখক: কলামিস্ট ও সংগঠক, কুমিল্লা। মোবাইল ০১৭১৮-২২৮৪৪৬,