কুমিল্লাঃ আমায় ক্ষমা করো
।। নাসির উদ্দিন।।
ছাড়াবাড়ি। মানে পরিত্যক্ত বাড়ি। একসময় প্রত্যেক এলাকায় এমন বাড়ির অস্তিত্ব ছিল। অভিশপ্ত দেশভাগ আমাদেরকে এমন বাড়ির সাথে বেশি পরিচিত করেছিল। আর এই বাড়িগুলি ছিল পাড়াপড়শির মলমূত্র ত্যাগ, ময়লা আবর্জনা ফেলা, খড়কুটো শুকানো এমনকি মৃত জীবজন্তুর দেহাবশেষের অলিখিত ঠিকানা।
বাংলাদেশের এমন একটি ছাড়াবাড়ি হচ্ছে কুমিল্লা। পাকিস্তান আমলেও তা-ই ছিল। তথাপিও এই ছাড়াবাড়িই আমার অস্তিত্ব আমার জন্মদাতা আমার আবেগ আমার নিঃশর্ত ভালবাসা এবং আমার মাতৃকা। এই মাতাকেই আজ আমি হারাতে বসেছি। কারণ রাজ আদেশে ভালবাসার কুমিল্লাকে মেঘনায় বিসর্জন দেয়া হবে। যদিও কুমিল্লার দেহ প্রাণহীন হয়েছে আগেই। এখন দেহ বিসর্জন হলে এই নামের ছাড়াবাড়িটিও অস্তিত্ব হারাবে।
কুমিল্লা প্রথম নিষ্প্রাণ হয় শেরিল রেডক্লিফের ছুড়ির নিচে। এই ছুরি বাংলা এবং পাঞ্জাবকেও দ্বিখণ্ডিত করেছে। কিন্তু সেটি হয়েছিল ধর্মীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। এনিয়ে ইতিহাস সাহিত্য সিনেমার চর্চাও হয়েছে-হচ্ছে প্রচুর। এমনকি কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখার বিভাজন নিয়েও রাজনৈতিক দাঙ্গা এবং হৈচৈ চলছে অবিরাম। এসবই এই তিনটি অঞ্চলের মানুষের ধর্মীয় রাজনৈতিক আবেগের ফসল। পশ্চিম পাঞ্জাব ভারতে যুক্ত হতে চায়নি। পশ্চিমবঙ্গ পাকিস্তানে আসবে এমন দাবি করেনি। কাশ্মীরের রাজা এবং জনগণের চাওয়া ছিল ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু কুমিল্লার তথা ত্রিপুরার বিবেচনা আলাদা। কুমিল্লা ত্রিপুরা থেকে আলাদা হবে এমন শর্ত বা দাবি কোনটাই ছিল না। বরং ত্রিপুরার তৎকালীন ১৬ বছর বয়সী মহারাজা কিরিট বিক্রম কিশোর মানিক্যের পক্ষে শাসনকার্য পরিচালনা কারী মা কাঞ্চন প্রভা দেবী শর্ত দিয়েছিলেন ত্রিপুরা ভারতে নয় পাকিস্তানে থাকবে। তিনি রেডক্লিফের এই সীমানা রেখা পরিবর্তনের দাবি করে বলেছিলেন, ত্রিপুরা এবং কুমিল্লা অভিন্ন স্বত্ত্বা।
পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার বাসনা নিয়ে তিনি পুর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর খাজা নাজিম উদ্দিনের কাছে কয়েকদফা দূত পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য কুমিল্লার; পাকিস্তানের কৃতদাস নাজিম উদ্দিন সেদিন তাচ্ছিল্যভরে কাঞ্চন প্রভার দূতকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন এই পাহাড় পর্বতের দরকার নেই পাকিস্তানের। তারপরও দুই বছর দুই মাস অপেক্ষা করে ১৯৪৯ সনের ১৫ অক্টোবর ত্রিপুরাকে ভারতের সাথে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত দেন কাঞ্চন প্রভা। আর সেই ক্ষোভ এবং দুখে তিনি ৭০ হাজার পরিবারকে উচ্ছদ করে পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়ে দেন। যারা ইতিপূর্বে ফেনী, বৃহত্তর কুমিল্লা এবং হবিগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ত্রিপুরায় গিয়ে বসতি গড়ে তুলেছিল। নাজিম উদ্দিনের অপরিপক্ক সিদ্ধান্তের জন্য ত্রিপুরা চলে যায় ভারতে, ৭০ হাজার পরিবার রিফিউজি হয়ে সর্বহারা হয়, সর্বোপরি কুমিল্লা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু কি তাই, এই ৭০ হাজার পরিবারের জমিজমা কিংবা অর্থ ফেরত চেয়ে কুমিল্লার তৎকালীন এমপি সুলতান আহমদ পাকিস্তান ন্যাশনাল এসেম্বলিতে দাবি উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু বৈরী পাকিস্তান কুমিল্লার এই পরিবারগুলোর পক্ষে মুখ খুলেনি। আজও কুমিল্লায় এই মানুষেরকে রিফুজি নামে ডাকা হয়।
কুমিল্লার আরও দুর্ভাগা হচ্ছে তাকে ভুল ইতিহাস মেনে চলতে হচ্ছে। যে ইতিহাসের অংশ সে নয় সেই ইতিহাসকে নিজের বলে মিথ্যাচার করে পরাজিতের জীবন যাপন করতে হচ্ছে। কুমিল্লা কখনোই মুঘল সম্রাট আকবর, শাহজাহান, জাহাঙ্গীরদের কিংবা তাদের সুবাহদারদের অধীনস্থ ছিল না। এমনকি মুর্শিদ কুলি খাঁ থেকে আলীবর্দি বা সিরাজ উদ দৌলার নবাবী শাসনের অধীনেও ছিল না। এদের শাসন এলাকা ছিল মেঘনার পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত। অথচ ভিন্ন দেশের নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে আমাদের মহানায়ক বানিয়ে দেয়া হয়েছে। ত্রিপুরা এবং কুমিল্লা বরাবরই স্বাধীন ছিল। আমরা পরাধীন জাতি ছিলাম না।কুমিল্লাকে বাংলায় অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে মেঘনার পশ্চিমাঞ্চল এবং পশ্চিমবঙ্গের পরাধীনতার ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করে স্বাধীন কুমিল্লাকে পরাধীন বানিয়ে দেয়া হয়েছে। পরাধীনতার এই লজ্জা আমাদের নয়।
কুমিল্লা একসময় সমতটের রাজধানী ছিল। একসময় হরিকেল রাজ্যেরও প্রধান অঞ্চল ছিল। ত্রিপুরারও প্রধান বর্ধিষ্ণু শহর ছিল কুমিল্লা। শুধুমাত্র সামছুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এবং মুবারক শাহের সুলতানি আমলে কিছুদিন চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ শাহরাস্তির কিছু অঞ্চলের কারণে এবং নবাব সূজা উদ্দিন মুহাম্মদের আমলে ১৭৩৩ সালের পর কিছুদিন করদ রাজ্য এবং বৃটিশ শাসনামলে ত্রিপুরা ছিল অধীনতামূলক মিত্র রাজ্য।
আমি কুমিল্লাকে নিয়ে গর্বিত কারণ ভাষার দিক থেকেও কুমিল্লা ছিল স্বাধীন। কারণ ঢাকা, কলকাতা বা মুর্শিদাবাদে রাষ্ট্রীয় বা রাজ কার্য চলতো বিদেশি পার্সি এবং পরবর্তীতে ইংরেজি ভাষায়। অথচ হাজার বছর ধরে ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা বাংলা। রাজা প্রথম ধর্ম মাণিক্যের রাজত্বকালে ১৪৩১ ইংরেজি সনে বাংলা পদ্যে রাজমালা রচিত হয়েছিল। সেইযুগে ঢাকা বা পশ্চিমবঙ্গে বাংলা সাহিত্য চর্চার কোন ইতিহাসই খোঁজে পাওয়া যাবে না। কারন ঢাকার ইতিহাস চারশ বছরের এবং কলকাতা মাত্র আড়াইশ বছরের। ত্রিপুরার মহারাজ গোবিন্দ চন্দ্র মানিক্য ১৬৫৮ সালে কুমিল্লা শহরে নির্মাণ করেছিলেন দৃষ্টি নন্দন শাহ সুজা মসজিদ। অথচ তারও একশো বছর পর ১৭৫৭ সালে আলীপুর নামে কলকাতা শহরের গোড়াপত্তন করেছিলেন নবাব সিরাজ উদ দৌলা।
আমি শেষ করি ভারত উপমহাদেশের মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত নবাব ফয়জুন্নেসাকে দিয়ে। যিনি বেগম রোকেয়ার জন্মের ৭ বছর আগে কুমিল্লা শহরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গার্লস হাইস্কুল। কিন্তু সেইসময় কুমিল্লা ত্রিপুরা রাজ্যে ছিল বলে তাঁর মহিমা শুধু নিজ রাজ্যে প্রচারিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের পর কুমিল্লা পশ্চিমের পরাধীনতার ইতিহাসে বিলীন হয়ে যায়। এরপর থেকে পরাধীন দেশের ইতিহাসের ভাষায় আমাকেও বলতে হচ্ছে মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া।
আমার প্রাণের এই কুমিল্লাকে বিভাগ ঘোষণার দাবী ওঠেছিল সেই ১৯৮৫ সালে। এডভোকেট মোখলেছুর রহমানের নেতৃত্বে ও উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল গণ ফোরাম কুমিল্লা। বিভাগ প্রতিষ্ঠার দাবিতে এই সংগঠনের পক্ষ থেকে বৃহত্তর কুমিল্লায় এবং নোয়াখালীতে ব্যাপক গণসংযোগ করা হয়। কিন্তু একে একে সিলেট, বরিশাল, রংপুর এবং ময়মনসিংহ বিভাগ ঘোষিত হয়। বঞ্চিত থেকে যায় কুমিল্লা। এখন মোস্তাক জুজুতে নিকৃষ্টতরভাবে দগ্ধ হচ্ছে কুমিল্লা। আগস্ট ট্রেজেডির দহনে দগ্ধ হওয়া এই মৃতদেহের সলিল সমাধি হবে মেঘনার জলে। হায় কুমিল্লা; আমি লজ্জিত তোমার সুসন্তান হতে পারিনি বলে। তোমার রক্তক্ষরণ মুখ বুজে সহ্য করতে গিয়ে নিজেকেই নিজে থুতু ছিটাই। পারিনি তোমার অস্তিত্ব এবং সম্ভ্রমের মর্যাদা রক্ষা করে তোমায় আগলে রাখতে। আমার অসহায়ত্বকে তুমি ক্ষমা করো। আর যদি ছাই ভস্ম থেকে ফিনিক্স পাখির মতো মর্যাদাবান করে জাগিয়ে তুলতে পারো; কথা দিলাম তোমার জন্য সেদিন আমাকেই আমি শূলে চড়াবো।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক। সাবেক নিজস্ব প্রতিবেদক,প্রথম আলো।