কুমিল্লার মেয়ে আলেয়া আলো ছড়ালো বিশ্বময়– অ্যাডভোকেট গোলাম ফারুক

 

কাব্যলক্ষীর বরপুত্রী আলেয়া চৌধুরী কুমিল্লা শহরের উত্তর চর্থা এলাকার এক হত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন পঞ্চাশের দশকে। তার মায়ের নাম আম্বিয়া খাতুন ও পিতার নাম সুলতান আলম চৌধুরী। বাবার নামের সাথে চৌধুরী দেখে মনে হয় এক সময় পরিবারের আর্থিক সংগতি ছিল সাথে বুনিয়াদীপনা। পরিবারটি জীবন সংগ্রামে টিকে থাকলেও নামের সাথে চৌধুরী পদবীর সংযুক্তি ছাড়া এ পরিবারের আর কিছু নেই। দারিদ্রতার কারণে শিক্ষার পথ রুদ্ধ হয় কিন্তু তার কাব্য প্রতিভা স্বত:স্ফূর্ত ভাবেই বিকশিত হতে থাকে। তিনি এক স্বশিক্ষিত নারী। ত্রিশ বছর বয়সে মাছ ধরার নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মার্কিন মুল্লুকে যান। তিনি বিভিন্ন দেশে গেছেন কাজের সন্ধানে এবং নানা বর্ণের, ধর্মের মানুষের একান্ত সান্নিধ্যে এসেছেন; যার ফলে তার দৃষ্টি ভঙ্গি ব্যাপক ভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে।

 

ভাসমান জীবনের ঠিকানা গাড়েন নিউইর্য়কে। শিশুকালে নিজের জীবনের মর্ম বেদনাকে উপলব্ধিতে নিয়ে নিউইর্য়ক এ সমস্যাক্লিষ্ট শিশুদেরকে (Problem Children) নিয়ে গড়ে তোলেন এক সেবামূলক সংগঠন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে পেশাগত গাড়ি চালক হয়ে গেলে তাকে এ পেশা থেকে নিবৃত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চাকরির সুযোগ করে দেন বাংলাদেশ বেতারে। তবে তাঁর অস্তিত্বের সংগ্রামকে স্বীকৃতি দান করে তাকে নিয়ে আমেরিকার Summer ম্যাগাজিনে WOMAN OF THE YEAR শীর্ষক প্রচ্ছদ কাহিনি প্রকাশ করে।

ALEYA : A Bangladeshi poet in America  শীর্ষক ডক্যুমেন্টারি ফ্লিম তৈরিতে তাকে সম্মানিত করে। এই ছবিতে মজদুর শ্রেণী থেকে আগত এক নারীবাদী কবির সংগ্রামের কথা চিত্রায়িত হয়েছে। দিনা হোসেন এই ফ্লিম তৈরি করে কলকাতা থেকে ” কলাকিতি” পুরষ্কার লাভ করেন ২০১৬ সনে।

আলেয়ার পরিবারটি এতটাই দরিদ্র ক্লিষ্ট ছিল যে,তার সঠিক জন্ম তারিখটিও আজ পর্যন্ত নিরুপণ করা যায় নি। তার পরিবারটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবার তাই কন্যা সন্তানের লেখা পড়ার দিকে তেমন আগ্রহ নেই। তবে পরিবারের আর্থিক সঙ্কট ও কন্যা সন্তানের লেখাপড়ার বিষয়ে বিরাট বাধা সত্ত্বেও লেখাপড়ার প্রতি আলেয়ার দূর্বার আকর্ষণ আলেয়াকে ঘর থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসে। পরিবারের সদস্যদের না জানিয়ে ভর্তি হয়ে যান এলাকার প্রাইমারি স্কুলে। বিষয়টি লোকমুখে শুনে পরিবারের নিকট জানাজানি হয়ে গেলে আলেয়ার ভাগ্যে জুটে বেদম শারিরীক নির্যাতন। কন্যা সন্তানের প্রতি এরুপ শারিরীক নির্যাতন কিছুতেই মানবার পাত্রী নন আলেয়া। স্কুলের এক বান্ধবীর নিকট শুনতে পেয়েছিল কুমিল্লা শহরের ফরিদা বিদ্যায়তন নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় আছে যার প্রধান শিক্ষিকা ছাত্রীদের লেখাপড়ায় সাহায্য করে। কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখা করলেন ফরিদা বিদ্যায়তনের তৎকালীন প্রধান শিক্ষিকা সেলিনা বানুর সাথে। সেলিনা বানুর সম্পর্কে দুটি কথা বলা প্রয়োজন। সেলিনা বানু পাবনার মেয়ে স্বামী শাহাজাহান খন্দকার। স্বামী স্ত্রী দুজনেই সর্বহারার রাজনীতি করেন, কমিউনিষ্ট পাটির সদস্য। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করে পার্লামেন্ট মেম্বার হয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতা শিল্পপতি হালিমা টেক্সটাইল এর মালিক জনাব জহিরুল কাইয়ুম তার একমাত্র কন্যা ফরিদার স্মৃতি রক্ষার্তে ফরিদা বিদ্যায়তন বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। স্কুলটির সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য তিনি একজন মানবিক গুণ সম্পন্ন প্রধান শিক্ষকের সন্ধানে ওনার কলেজ জীবনের সহপাঠি রাজনৈতিক বন্ধু অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহাম্মদকে অনুরোধ করেন, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহাম্মদ বন্ধু শাহাজাহান খন্দকার ও ওনার স্ত্রী ৫৪ পার্লামেন্টের সদস্য সেলিনা বানুর সাথে যোগাযোগ করেন। সেলিনা বানু ফরিদা বিদ্যায়তন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে যোগদান করেন। এ ব্যাপারে বিপ্লবী অতীন রায় বাবুরও ভূমিকা ছিল। সেলিনা বানু আলেয়ার পিতা ও মাতার রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে তাকে ফরিদা বিদ্যায়তন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। আলেয়া বাসা বাড়ির কাজের কথা বলে চলে আসতো সেলিনা বানুর বাসায়। এই বাসা থেকে সেলিনা বানুর দেওয়া স্কুলের ইউনিফর্ম পরে ক্লাসে যেতেন। ক্লাস শেষ হলে স্কুলের ইউনিফর্ম সেলিনা বানুর বাসায় রেখে তার নিজ পোষাকে বাড়ি ফিরতেন। এই ভাবে চলছিল তার লেখাপড়া। সেলিনা বানু ছিলেন সর্বহারা আদর্শে দিক্ষিত কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য। তাই তার এই ছাত্রীকে স্কুলে পাঠ দানের বাইরে প্রচলিত নারী বিদ্বেষী সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শিক্ষা দেয়। যা আলেয়ার জীবন চলার পথে অমোঘ শক্তি।

পরিবারের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে লেখাপড়া চলছিল আলেয়ার। এর মধ্যে বিষয়টি পরিবারের নিকট জানাজানি হয়ে গেলে অভিভাবকরা তার উপর অকথ্য নির্যাতন করে। মাত্র ১১ বছর বয়সে তাকে জোর করে বিবাহ দিয়ে দেয়। রীতিমাফিক বিবাহের পর দিন স্বামীকে নিয়ে (আড়াইয়া) বাপের বাড়িতে আসেন। মা’কে জানায় সে কিছুতেই স্বামীর বাড়ি যাবে না। মা বুঝেছিল এই মেয়েকে জোর করে ঘরে আটকানো যাবে না। মা’কে বলে ঐ রাত্রে বাড়ি থেকে পালিয়ে ট্রেনে চড়ে ঢাকা কমলাপুর স্টেশনে পৌছায়। কিশোরী এই বালিকা সমাজের প্রতি এক বিস্ফোরণের আগুন নিয়ে অজানার পথে পা বাড়ালো। এই কমলাপুর স্টেশনে একটি টি স্টলে তার সাথে পরিচয় হলো এক কিশোরীর, তাকে আপ্যায়ন করল চা আর বন রুটি দিয়ে। এই চা দোকানেই তার চাকুরী হল কাপ প্লেইট ধোয়ার, বিনিময়ে জুটল তিন বেলা খাবার।
সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয় গাড়ি চালক আব্দুল আওয়ালের সাথে। তিনি তাকে তার বাসায় নিয়ে যান। আলেয়ার বয়সী রওশন নামে তার একটি মাতৃহারা কন্যা ছিল। সকাল বেলা কাজে যেতে তাদের দু’জনকেই সাথে করে নিয়ে যেতেন আওয়াল ড্রাইভার। এই ভাবে বাসে থাকতে থাকতে আলেয়া বাস কন্ডাক্টর হয়ে উঠেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মহিলা বাস কন্ডাক্টর হিসাবে সেই সময় আলেয়ার ছবি ছাপা হয়েছিল জাতীয় দৈনিকে। এর মধ্যে আলেয়া পত্রিকা বিক্রির কাজ নেয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের প্রবেশ পথের কোনে দাঁড়িয়ে পত্রিকা বিক্রি করে। আজ থেকে অর্ধশত বছর পূর্বে এইরুপ উঠতি বয়সের একটি মেয়ে পত্রিকা হকার ব্যাপারটি অনেকের নজরে কাড়ে। একদিন চলচিত্র নির্মাতা উদয়ন চৌধুরী আলেয়াকে নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর কাছে। বঙ্গবন্ধু তাকে জিজ্ঞাসা করেন ” তুই আমাকে পত্রিকা দিতে পারবি”? আলেয়া খুশি হয়ে সম্মতি সূচক মাথা নাড়েন। এরপর তিনি একটি কাগজে লিখে দেন বাড়ির ঠিকানা, কি-ভাবে কোন বাসে যেতে হবে তাও বলে দেন তিনি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যখন পত্রিকা দিতে যেতেন আলেয়া তখন তার পাশে বেগম সুফিয়া কামাল এর বাড়িতেও পত্রিকা দিতেন। এর মাস ছয়েক পর স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হল। ফলে পত্রিকা বিলি করার কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন আলেয়া।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে আলেয়া একবার কুমিল্লায় এসেছিল। সেই সময় তার বাড়ির এলাকার কিছু বয়োজ্যাষ্ঠ ব্যক্তি তথাকতিথ হুজুররা তাকে দেখে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। এর কারণ ছিল আলেয়ার গৃহ ত্যাগ। এমন অবস্থা হলো যে তাকে আর কিছুতেই তার বাড়িতে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। অবস্থা বেগতিক দেখে আলেয়ার মামা আব্দুল মজিদ আলেয়াকে নিয়ে চাঁদপুর গিয়ে ঢাকাগামী লঞ্চে তুলে দেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে আলেয়া সম্পর্কে আর বেশী কিছু জানা যায়নি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র ১৩ বৎসর বয়সে আলেয়া গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে ভর্তি হন একটি ড্রাইভিং স্কুলে। ড্রাইভিং শিক্ষা সমাপ্ত করে আলেয়া হয়ে যান বাংলাদেশের প্রথম মহিলা বাস ড্রাইভার। পেশাদার ড্রইভিং লাইসেন্স এর আবেদন করলে মহিলা হওয়ার কারণে আবেদন না মঞ্জুর হয়। ইতোমধ্যে আলেয়ার ড্রাইভার হওয়ার খবর পত্রিকায় ছাপা হলে সংবাদটি বঙ্গবন্ধুর নজড় কাড়ে। আলেয়াকে গণ ভবনে ডেকে আনেন বঙ্গবন্ধু। বলেন,“মেয়েদের জন্য বাস ড্রাইভার হওয়া নিরাপদ নয়” আমি তোকে একটা সেলাই মেশিন দেই। সেলাইয়ের কাজ শুরু করে দে। পুরুষ শাষিত সমাজের রক্ত চক্ষুকে অগ্রাহ্য করবেই তাই আলেয়া তখন বিনয়ের সাথে সেলাইয়ের মেশিন নিতে অস্বীকার করেন এবং তার ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন। আলেয়া বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন বাংলাদেশে এমন একটি আইন করতে, যাতে মেয়েরা গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে পারে। নির্বিঘ্ন্নে গাড়ি চালানোকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। প্রচন্ড ক্ষোভ ও অভিমানে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর বঙ্গবন্ধুর তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীকে ফোনে বলেন, আলেয়াকে খুঁজে বের করে তাকে একটি চাকুরির ব্যবস্থা করে দিতে। বঙ্গবন্ধু জননেতা বুঝতে পেরেছিলেন আলেয়ার অন্তরের মর্মজালা। তাই আলেয়ার জীবনকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বঙ্গবন্ধুর এ প্রয়াস।

যেই কথা সেই কাজ। জনাব মিজান চৌধুরী আলেয়াকে খুঁজে বের করে বাংলাদেশ বেতারে চাকরি দিয়ে দিলেন। এতদিনে হয়ত আলেয়ার বাউন্ডুলে জীবনের অবসান হল। মিজান চৌধুরীর সাথে সাক্ষাতের সময় তার সঙ্গী হয়েছিল সেলিনা হোসেন ও কবি নির্মলেন্দু গুন। স্বশিক্ষিত কবি আলেয়া চৌধুরী বাউন্ডুলে জীবনে ও কবিতা লিখেছেন নিরন্তর, ছাপা হয়েছে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে, কবি সুফিয়া কামালের সাথে আলেয়ার পরিচয় ঘটেছিল হকারী জীবনে। পরবর্তীতে পরিচয় ঘটে সেলিনা হোসেন ও কবি নির্মলেন্দু গুন এর সাথে। সুশৃংখল জীবনে চলার সুবাদে তার কাব্য প্রতিভা বিকশিত হতে থাকে। এবার তার সাথে পরিচয় ঘটে সাংবাদিক শাহারিয়ার কবির ও সোহরাব হাসানের সাথে। আরো পরিচয় ঘটে এক সময়ের বাম রাজনীতির সক্রিয় নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এর ঘনিষ্ট সহচর বীর মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও গবেষক আব্দুল মোনেম সরকারের সাথে। কবি, লেখক, গবেষক ও সাংবাদিকদের এক বিশাল বলয়ে আলেয়ার জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এরই মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বাঙালী জাতির জীবনে নেমে আসে এক অমানিসার ঘোর অন্ধকার। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর জন্য স্ব-পরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। এরই সাথে আলেয়ার জীবনে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। পাকিস্তানী ধারার রেডিও বাংলাদেশে চাকুরিতে ইস্তেফা দিয়ে নেমে গেল রাস্তায়। কিছুতেই ভুলতে পারছিল না জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য স্মৃতি কথা।
আবারো বদলে যায় আলেয়ার জীবনের দৃশ্যপট। দেশে তখন জিয়াউর রহমানের রক্তের হুলি খেলা। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেশ প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের ফাঁসি যখন নিত্য দিনের খেলাধুলা। কবি আলেয়া চৌধুরীর কলমে তখন আগুন ঝরে। তিনি লিখলেন,“ মানুষ কেন গরীব হয়”। পত্রিকায় ছাপা হলো,‘ ‘পতিতালয়’। এই কবিতায় দৃষ্টি গেল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এর। ক্ষুব্ধ জিয়াউর রহমান ডেকে নিলেন আলেয়াকে। বললেন তুমি দেশ ছাড় না হলে মোল্লা মৌলভীরা তোমাকে মেরে ফেলবে সাথে আমাকেও। সামরিক আইন বলে কথা, সকালে আলেয়ার সাথে এই কথা আর বিকালেই আলেয়াকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় বিমান বন্দরে, সেখানে পরিচয় ঘটে বঙ্গবন্ধুর খুনি বজলুল হুদার সাথে। তারই সাথে ইরানগামী একটি বিমানে তুলে দেওয়া হয় আলেয়াকে। বঙ্গবন্ধুর খুনির সাথে ইরানে বসবাস আলেয়ার জন্য মৃত্যুর সামিল। বজলুল হুদা আলেয়াকে ইরানস্থ বাংলাদেশ দূতবাসে চাকুরি দিতে সম্মত হলেও আলেয়া রাজি হয়নি। বজলুল হুদাকে অনুরোধ করে অন্যত্র একটি চাকুরি নিয়ে দেওয়ার জন্য। বজলুল হুদা আলেয়াকে ইরানস্থ জার্মান রাষ্ট্রদূতের কাছে নিয়ে যায়। জার্মান রাষ্ট্রদূত আলেয়াকে প্রশ্ন করে তুমি কি কাজ জান? আলেয়া উত্তর দেন গাড়ি চালাতে জানি। রাষ্ট্রদূত এর এ কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই তার গাড়ির চাবি আলেয়ার দিকে ছূড়ে দিয়ে বলে যাও গাড়ি স্টার্ট দাও। আলেয়া ও তড়িৎ গতিতে গাড়িতে উঠেই খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম নকেই স্টার্ট দিয়ে গাড়ি চালাতে উদ্যত হলে রাষ্ট্রদূত তাকে গাড়ি থেকে নামতে বলে। বলে যাও তোমার চাকরি হয়ে গেল। বিদেশে তুমি ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাতে পারবে না। তাই আমার অফিসে আমার Personal Attendant হিসাবে কাজ করবে। আলেয়ার চাকরি হয়ে গেল ইরানস্থ জার্মান অ্যাম্বেসিতে। অভাগিনী যে দিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়। স্বস্তির মাঝে অশনি সংকেত বেজে উঠল। এই জার্মান রাষ্ট্রদূত বদলি হলেন পাকিস্তানে। আলেয়াকে বললেন আমার সাথে চল পাকিস্তানে তোমার কোন অসুবিধা হবে না। আলেয়া বলল যে, পাকিস্তান আমার ৩০ লক্ষ বাঙালীকে হত্যা করেছে আর চার লক্ষ মা বোনের ইজ্জত হরণ করেছে সেই নর পশুর দেশে আমি কিছুতেই যেতে পারি না। অবশেষে জার্মান রাষ্ট্রদূত বলল আমি জার্মান যাব জার্মান হয়ে পাকিস্তান যাব। তুমি চাইলে আমার সাথে জার্মান যেতে পার আমি তোমাকে জার্মানিতে রেখে পাকিস্তান যাব। আমি আশা করি জার্মানিতে তোমার কোন না কোন একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যাবে। জার্মানিতে যেয়ে আলেয়া বুঝতে পারেন জার্মান ভাষা না জানলে জার্মানিতে থাকা দুস্কর। তাই মনে মনে পরিকল্পনা করেন যে করেই হোক আমেরিকার পৌঁছাতে পারলে আমার হয়ত ভাগ্য খুলবে। এখন আলেয়ার একমাত্র চিন্তা কি ভাবে আমেরিকায় পৌঁছানো যায়। আমেরিকার উদ্দেশ্যে আলেয়া জার্মানি ছাড়েন এবং জর্ডানে আসেন অভিবাসী হয়ে সেখানে থেকে যান বাহামা।

এই দেশ থেকে সমুদ্র পথে আমেরিকার যাওয়ার পথ খুঁজছেন আলেয়া, ঘটনা পরিক্রমায় আলেয়া এখন ৩০ বছর। খোঁজ মিলল চোরাই ভাবে সমুদ্র পথে আমেরিকার যাওয়ার পথ। পরিচয় হলো এক নিগ্রো মহিলার সাথে। মহিলার সাথে চুক্তি অনুযায়ী মহিলা আলেয়াকে নির্দিষ্ট দিনে আরো ১২জন পুরুষের সাথে একমাত্র মহিলাকে তুলে দিল একটি ইঞ্জিন চালিত রাবারের নৌকায়। মনে মনে আলেয়া ভাবল বাংলাদেশকে যেমন নৌকা মার্কা স্বাধীনতা এনে দিয়েছে তাকেও নৌকাই আমেরিকা পৌঁছে দেবে। নৌকাতে তুলে দিয়ে ঐ নিগ্রো মহিলা পুরুষ যাত্রীদের শপথ করা যে বলল, আমি আশা করি তোমরা ১২জন পুরুষ এই একজন মহিলাকে বিপদে রক্ষা করবে। নিগ্রো মহিলা সংগোপনে যে কাজটি করলেন তিনি আলেয়ার নিকট কিছু জন্ম নিয়ন্ত্রণ বটিকা দিয়ে দিলেন। হাজার হলেও পুরুষ মানুষের সাথে যাচ্ছ কখন কি ঘটে যায়। ঈশ^র তোমাকে রক্ষা করুক। আলেয়া ভেবে নিল স্বাধীনতা যুদ্ধে হাজার হাজার মহিলা পাক সেনার হাতে সভ্রম হারিয়েও সংবাদ পৌঁছে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। আমি তাদেরই বোন। যে কোন যুদ্ধেই আমাকে জিততে হবে এখানে নৈতিকতা পরাভূত। জীবন যুদ্ধের জয় না সতীত্বের জয়, কার জয় হয় হবে এই যুদ্ধে একথা শুধু জানেন সৃষ্টিকর্তা। সাগরের উত্তাল তরঙ্গে ভাসছে তরি, দুলছে আলেয়ার স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় পৌঁছা। উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে কোনরূপ দুঘর্টনা ছাড়াই সোনার তরি আমেরিকার মাটি স্পর্শ করল। বিপত্তি ঘটালো আমেরিকার ইমিগ্রেশন পুলিশ। গ্রেফতার করলো তাদের ১৩জন অভিবাসীকে। আলেয়া পুলিশের কাছে খুব করে কান্নাকাটি করাতে ও নারী হওয়ায় পুলিশের দয়া হলো। আলেয়াকে ছেড়ে দিল। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আলেয়া ইরানে অবস্থান কালে ভারতীয় এক নারী মঞ্জু ব্যানার্জির সাথে পরিচয় ঘটেছিল। যিনি বর্তমানে নিউইর্য়কে বসবাস করেন। ওনার সাথে আলেয়ার যোগাযোগ থাকায় মঞ্জু ব্যানার্জির ঠিকানা জানা ছিল। আলেয়া সাহায্যের আশায় মঞ্জু ব্যানার্জির বাসায় যেয়ে উঠলেন তখন রাত্রিকাল। এবার বাঁধ সাধল মঞ্জু ব্যানার্জির স্বামী। কিছুতেই তাকে যায়গা দেওয়া যাবে না। মঞ্জু ব্যানার্জি স্বামীকে বললেন মেয়ে মানুষ। রাত্রিবেলা অপরিচিত শহরে কোথায় যাবে রাত্রিটা কাটুক। রাত্রি শেষে ভোর হলে মঞ্জু ব্যানার্জি আলেয়াকে বলল তুমি খানিক সময়ের জন্য ঘুরে আস। সাহেব অফিসে গেলে তুমি আমার কাছে আস। কথানুযায়ী তাই হল। রাত্রে স্বামী বাসায় ফিরলে মঞ্জু ব্যানার্জি স্বামীকে বুঝাতে সক্ষম হল মহিলা আমাদের বাড়িতে থেকে যাক। আমাদের ছেলেকে দেখাশুনা করবে। আলেয়া মঞ্জু ব্যানার্জির দুরন্ত এই ছেলেটিকে আদরে স্নেহে মানুষ করতে পেরেছিলেন। এই জন্য মঞ্জু ব্যানার্জির পরিবার আলেয়ার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যোগাযোগ রক্ষা করেছেন।

কর্ম পাগল নারী আলেয়া ইতোমধ্যে নিজ মেধা, যোগ্যতা ও পরিশ্রম দিয়ে সমস্যাক্লিষ্ট শিশুদের জন্য নিউইর্য়কে গড়ে তুলেছেন Child Home. এই সংগঠনের সেবামূলক কাজের জন্য আলেয়া চৌধুরী লাভ করেছেন আমেরিকার রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার। যা আলেয়ার হাতে তুলে দিয়েছেন তৎকালীন ফাষ্ট লেডী হিলারী ক্লিনটন।

আমি প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছি কাব্যলক্ষীর বরপুত্রী আলেয়া চৌধুরী। এ পর্যন্ত প্রকাশিত আলেয়া চৌধুরীর কাব্য গ্রন্থের সংখ্যা মোট ১১ টি। কাব্য গ্রন্থ সমূহ হলো-

১. দু:খের সমান সরল রেখা
২. যুদ্ধহীন নিরাময় পৃথিবী চাই।
৩. হৃদয়ে বাংলাদেশ।
৪. আমি হার্সেলের নিগ্রো।
৫. দ্রোহী।
৬. তুমি।
৭. MOTHER

8. THE MAN FATHER OF BANGLADESH.

9. GOD KISSED IT.

10. Poem about Truth.

১১. যুদ্ধ

তবে আলেয়া চৌধুরীর মতে তাঁর সেরা গ্রন্থ THE MAN FATHER OF BANGLADESH. এটি একটি কাব্য গ্রন্থ। বই এর কবিতা গুলি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে উৎসর্গ করে লেখা। একটি জাতি একটি রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি তিনি। আর এই স্বাধীনতা আনতে গিয়ে মাসের পর মাস তিনি জেল খেটেছেন, পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছেন। সেই মানুষটিকে অকৃতজ্ঞ কিছু মানুষ স্ব- পরিবারে হত্যা করেছে এ কষ্ট ভুলার নয়। “যত দিন এই রাষ্ট্র থাকবে তত দিন অমর তিনি। চিরঞ্জীব তিনি জাতির চেতনায়”।

অস্তিতের লড়াইয়ে টিকে থাকতে মাত্র ১৩ বছর বয়সে পেশাগত গাড়ি চালক হওয়ার প্রচেষ্টাকে সম্মান এবং স্বীকৃতি দান করে তাকে নিয়ে আমেরিকার Summer  ম্যাগাজিন Womens of the Year শীর্ষক প্রচ্ছদ কাহিনী প্রকাশ করে। Aleya : A Bangladeshi poet in America. শীর্ষক ডকুমেন্টারি তৈরি করেছেন দিনা হোসেন। এই ছবিতে মজদুর শ্রেণী থেকে আগত এক নারী বাদী কবির সংগ্রামের কথা চিত্রায়িত হয়েছে। এই ফ্লিমের জন্য কলকাতা থেকে ‘কলাকিতি’ পুরুষ্কার অর্জন করেন দিনা হোসেন ২০১৬ সালে। নিউইর্য়ক থেকে প্রকাশিত নারী ম্যাগাজিন থেকেও সম্মাননা জানানো হয় তাকে।

২০০১ সালে আলেয়ার জীবনের ঝড় যখন থেমে গেছে, তখন প্রাকৃতিক এক ঝড়ে আলেয়ার নিউইর্য়কের বাড়ির একটি গাছ পড়ে গেলে আলেয়া নিজেই গাছ কাটতে গেলে বুকে ব্যাথা অনুভব করেন, তখনই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ধরা পড়ে আলেয়ার শরীরে মরণ ব্যাধি ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। এর সাথে যুদ্ধ করে হার না মানা এই নারী ক্যান্সার এর নিকট হেরে ২০২০ সালে ৩ আগস্ট এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

এই মহিয়াসী নারী ২০১৭ সালে শেষ বারের মত নিজ শহর কুমিল্লায় এসেছিলেন। তার নূরপুর হাউজিং এস্টেট এর বাড়িতে একটি কর্মজীবী নারীদের জন্য হোস্টেল করার লক্ষে জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করেন। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আইনগত দিক বিবেচনা করে কি ভাবে করা যায় তার জন্য আমার সাথে যোগাযোগ করতে বলে। আলেয়া চৌধুরী আমার সাথে মুঠো ফোনে যোগাযোগও করেছিলেন। কিন্তু সময় স্বল্পতায় আমার সাথে সাক্ষাত করা হয়নি। নিউইর্য়ক ফিরে গিয়ে আমার সাথে প্রয়াসই আলাপচারিতা হতো। তখন সে ক্যান্সারে পরাস্ত প্রায়। আমাকে অনুরোধ জানালো আপনি একবার নিউইর্য়ক আসেন। আপনার সাথে অনেক কথা। তার সমস্ত প্রস্তাবনা শুনে আমি তাকে একটি ফাউন্ডেশন গঠন করে তার মাধ্যমে প্রস্তাবিত কাজ সমূহ বাস্তবায়নের পরামর্শ দেই।

সেই অনুপাতে মৃত্যুর পূর্বে “কবি আলেয়া চৌধুরী ফাউন্ডেশন” এর কাগজপত্র তার নিয়োজিত এটর্নির নিকট সম্পাদন করে গেছেন। করোনা কালের জন্য এ কাজটি বাস্তবায়ন স্থগিত আছে। আশা করি করোনা কেটে গেলে ফাউন্ডেশন এর কাজ বাস্তবায়িত হবে। ওনার মৃত্যুকালে ওনার সম্পত্তি ভাই বোনদের মাঝে দান করেছেন, আর বাকী সম্পত্তি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলএর জন্য দান করেছেন। মৃত্যুকালে তিনি ৪ ভাই ৩ বোন রেখে গেছেন।

 

লেখক পরিচিতি: লেখক ও গবেষক।