গণমাধ্যমে আমার টুকরো স্মৃতি

।। মাহফুজ নান্টু।।
(১) টাউনহলে দাঁড়িয়ে চা পান করছি। কলেজ জীবনের এক বন্ধুর সাথে দেখা। স্নাতক শেষ না করেই বিদেশ পাড়ি জমায়। বেশ ভালো টাকা পয়সা কামিয়ে দেশে ফিরেছে। বিয়ে করবে। পরে আবার চলে যাবে। তার গায়ে সুগন্ধির ঘ্রাণ, দামি বিদেশি শার্ট, পায়ে কেডস। হাতে স্বর্ণের ব্রেসলাইট আর আঙুলে কয়েকটি আংটি। কথা প্রসঙ্গে ওই বন্ধুটি জানতে চাইলো আমি কি করি। সংবাদকর্মী শুনে কেমন যেন নাক ছিটকালো। অবজ্ঞার সুরে বললো এই টাকা দিয়ে সংসার চলে। তার খোঁচাটা বুঝতে পেরে হাসিমুখে বললাম- সংসার চলে। চা পান শেষ হলে বন্ধুটি বিল দিতে চাইলেও না করি। চা দোকানি আমার পরিচিত। তাই আমার বন্ধু থেকে বিলটি নেয়নি।
বন্ধু এবার বললো তুই চাইলে বিদেশে যেতে পারিস। এবার বন্ধুটিকে বললাম, এই পেশা দিয়ে আর যাই হউক অসহায় মানুষের পাশে থাকা যায়। তাদের জন্য কিছু করা যায়। রাত হওয়ায় বন্ধু বিদায় নিলো।
মাস ছয়েক পর অচেনা এক নম্বর থেকে ফোন। ওপাশ থেকে একজন লোকের অসহায় আর্তনাদ। কন্ঠস্বর শুনে বুঝলাম আমার বন্ধু ফোন দিয়েছে। তার কথার সারমর্ম এই, সে যে মেয়েকে বিয়ে করেছে ওই মেয়ে তার আয় উপার্জনের টাকা পয়সা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছে। সাথে বন্ধুর পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রয়েছে। বহু জায়গায় ধর্ণা দিয়ে টাকা পয়সা খরচ করে কোন লাভ হয় নি। সব শুনে তাকে বললাম অফিসে আয়। তারপর বিষয়টা নিয়ে আইন অনুযায়ী যা যা করার সংবাদ প্রকাশসহ সব করেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেষ্টায় তার স্ত্রীকে খোঁজে বের করা হলো। নিয়ে যাওয়া স্বর্ণ উদ্ধার হলো। টাকা পয়সা কিছু খরচ হয়ে যাওয়ায় পুরোটা ফিরে পেলো না। আনুষ্ঠানিকভাবে ওই মেয়ের সাথে আমার বন্ধুর সম্পর্ক শেষ করা হলো। ফিরে আসার সময় বন্ধু বললো আমার কত খরচ হয়েছে। হিসেব করতাম। বললাম লাগবে না। ফিরে আসার সময় খেয়াল করলাম আমার বন্ধু হা করে তাকিয়ে আছে।
(২) গেলো বছর বন্যা হলো। চারদিকে খাবারের জন্য হাহাকার। বাড়ি ঘর ভেসে গেলো। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর সমান। বুড়িচংয়ের ইন্দ্রবতী গ্রামের ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাসের ছোট মাটির ঘরটা ভেসে যায়। নদী ভাঙনের কয়েক দিন পর ওই এলাকা যাই। তিনি আমাদের দেখে কাঁদলেন। সাথে ছিলেন আজকের পত্রিকার জহিরুল হক বাবু ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির তানভীর দীপু। বন্যা হওয়ার পর সেখানে তখনো ঠিকমতো ত্রাণ পৌঁছায়নি। ঘরে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাব। তার কথা শুনছি। আমরা যখন ফিরেবো তখন সময় ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাস তার কোমরে গুঁজে রাখা একটা বিস্কুটের প্যাকেট খুললেন। কেউ একজন তাকে দিয়েছিলো। এটা তার দুপুরের খাবার। আমাদের জোর করে খেতে দিলেন। এক গ্লাস পানি জোগাড় করে দিলেন। বললেন সারাদিন রোদে ছিলে। একটু খেয়ে নাও। এই বলার যে ধরণ তাতে কোন স্বার্থ নেই। নিখাদ ভালোবাসা দেখেছি।
ফিরে আসার সময় কথা দিয়েছিলাম। উনার ঘরের ব্যবস্থা করে দিতে চেষ্টা করবো। সংবাদ করি। ফেসবুকে লিখি। কয়েকজন মানুষের চেষ্টায় ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাসসহ ওই পাড়ার আরো কয়েকজনের জন্য নতুন বাড়ি তৈরি করা হয়। বাড়ি বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে আসার সময় দেখি ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাস উপরে দু হাত তুলে বিড়বিড় করে কিছু বললেন। সেদিন ফিরে আসার সময় তার চোখে অশ্রু দেখেছি। এটাকেই সম্ভবত আনন্দ অশ্রু বলে।
(৩ ) অনেক বছর আগের কথা। বিকেলে প্রায়ই ঘুরতে বের হই। কুমিল্লা সদর উপজেলার রসুলপুর রেলওয়ে টেশন। স্টেশনের ফ্ল্যাটফর্মের এক কোনায় কাঁদামটির পাশে শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধা। মশা মাছি ভনভন করছে। স্থানীয়দের মাধ্যমে শুনলাম ওই বদ্ধার ছেলে মেয়েই তাকে ফ্ল্যাটফর্মে ফেলে যায়। সংবাদ করলাম। পরদিন পত্রিকায় খবরটি দেখে সে সময়কার জেলা প্রশাসক গাড়ি পাঠিয়ে বৃদ্ধাকে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসলেন। সেবা যতেœ বেশ সুস্থ হলেন ওই বৃদ্ধা। সে সময় জেলার সিভিল সার্জন ছিলেন ডাঃ মুজিবুর রহমান। তিনি ফোন করলেন। বললেন তোমার সংবাদের জেরে একজন অসহায় বৃদ্ধা আজ ভালো আছেন, সুস্থ আছেন। তিনি জীবনের শেষ ক’টা দিন একটু আরাম করে গেলেন। তোমার জন্য দোয়া করেছেন।
ফোনে কথা শেষ করি। অফিস থেকে বের হই। আকাশের দিকে তাকাই। দূর থেকে ভেসে আসা বাতাসে মনটা শীতল হয়ে যায়।
লেখক:জেলা প্রতিনিধি,এনটিভি।
