গাজার কণ্ঠস্বর কবি রিফাত আলআরিয়ার
।। মাসুমুর রহমান মাসুদ ।।
গাজার কণ্ঠস্বর হিসেবে খ্যাত ছিলেন রিফাত আলআরিয়ার (১৯৭৯-২০২৩)। ইসরায়েলি বিমান হামলায় উত্তর গাজায় ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি নিহত হন। ভয়েজ অব গাজা হিসেবে বিশ্বব্যাপী খ্যাত ছিলেন তিনি। ছোট গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লেখায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ২০০৭ সাল থেকে গাজা ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে বিশ্বসাহিত্য, তুলনামূলক সাহিত্য ও সৃজনশীল লেখা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৭ সালে তিনি মালয়েশিয়ার পুটরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবি জন ডান এর কবিতা নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি গল্প বলতে ভালোবাসতেন। নিজের জীবনের গল্প, চারপাশের প্রতিবেশীর গল্প। ফিলিস্তিনে মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, অমানবিক জীবনের বাস্তব গল্প বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরাই দৃঢ় সংকল্প ছিলো তার। তিনি সাহিত্যে বাস্তববাদ ও প্রকৃতিবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। যা তার ছোট গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতায় ফুটে উঠেছে।
রিফাত আলআরিয়ার এর ‘ইফ আই মাস্ট ডাই’ কবিতাটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার মৃত্যুর পর এই কবিতাটি ব্যাপক ভাবে আবৃত্তি হয়। এটি লোকমুখে এমনভাবে উচ্চারিত হয়েছে যেন এই কবিতার মধ্য দিয়ে তার অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। কবিতাটির ভাবার্থ থেকে বোঝা যায়- বোমা হামলায় নিহত ও ঝলসে যাওয়া মানুষগুলো যেন পরবর্তী প্রজন্মের মৃত্যুর জন্য স্বর্গে অপেক্ষমাণ। কখন তাদের সন্তানদের মৃত্যু হবে আর তারা বাবার কাছে চলে যাবে। তিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুর পর কাউকে যেন অন্তিম বিদায়, গোসল বা দাফন দেয়া না হয়। এভাবেই যেন তারা স্বর্গে যেতে পারে। এই নৃশংসতার মাঝেও সবাই যেন দেখে স্বর্গ থেকে একজন দেবদূত ভালোবাসা বহন করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে, যে ভালোবাসা বিশেষ করে ফিলিস্তিনের গাজা থেকে স্বর্গে চলে গিয়েছিল। তার যদি মৃত্যুও হয় তবুও কেউ যেন আশাহত না হন। প্রয়োজনে তিনি গল্প হতেও প্রস্তুত।
এমন কবিতা রচনা করে ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ একটি টুইট করেছিলেন। এর ১ মাস ৫ দিনের মাথায় গাজা নামক মৃত্যু উপত্যকায় তার মৃত্যু হয়। তিনি গল্প হয়ে কথিত হতে থাকলেন বিশ্বব্যাপী। ফিলিস্তিনের মানুষের জন্য মেডিকেল এইড নামে একটি এনজিও’র তহবিল গঠনে ২০২৪ সালে ৩ মার্চ জনপ্রিয় স্কটিশ অভিনেতা ব্রায়ান কক্স যুক্তরাজ্যের লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে কবিতাটি আবৃত্তি করেন। আবৃত্তির পূর্বে তিনি বলেন- রিফাত আলআরিয়ার একজন কথার মানুষ ছিলেন, কিন্তু তার কথা কিছু মানুষের জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। তাই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তুরস্কে বসবাসরত ফিলিস্তিনি লেখক ইউসুফ আলজামিল। তিনি অধ্যাপক রিফাত আলআরিয়ারের ছাত্র ছিলেন। মালয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার শিক্ষকের বিষয়ে স্মৃতিচারণ করে তিনি জানান, অধ্যাপক রিফাত আলআরিয়ার পাঠদানের ক্ষেত্রে খুব সহজভাবে উপস্থাপন করতেন। অনেক কঠিন বিষয়বস্তুকেও সহজবোধ্য করে তুলতেন। ছাত্র-ছাত্রীদের মনোজগতে জ্ঞানার্জনের অনেক দরজা-জানালা অবারিত করতেন। তাদেরকে বৈশ্বিক শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তুলতে ইন্টারনেট, ওয়েবসাইটের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। তারা যেন সৃজনশীল লেখক হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে সেজন্য আলআরিয়ার তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আলজামিল তার অনুপ্রেরণায় ‘ওমর এক্স’ নামে একটি ছোট গল্প লিখেছেন। যা রিফাত আলআরিয়ার সম্পাদিত ‘গাজা রাইটস ব্যাক’ (২০১৪) গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে ১৫ জন তরুণ লেখকের ২৩টি ছোট গল্প সংকলিত হয়। আলআরিয়ার অনেক তরুণ লেখককে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। সেই লেখকরা পরবর্তীতে ‘গাজা রাইটস ব্যাক’ গ্রন্থটিতে অবদান রেখেছেন। শতাধিক লেখক, আর্মি, ব্লগার ও তরুণদের এমনভাবে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন- ফলে তারা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গাজা তথা ফিলিস্তিনের পক্ষে লিখে যাচ্ছেন। এতে করে গাজার কণ্ঠস্বর বন্ধ রাখা সম্ভব হয়নি। তিনি সব সময় গল্প বলতে আগ্রহী ছিলেন এবং অন্যদেরও গল্প বলতে পরামর্শ দিয়েছেন। ফিলিস্তিনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা তিনি আলজামিলকে শুনিয়েছেন যা এখনো তার স্মরণে রয়েছে।
রিফাত আলআরিয়ার এর অনেক ছাত্র-ছাত্রী গাজা এবং ফিলিস্তিনের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। প্রতিকূল পরিবেশে আত্মীয়-স্বজনসহ অনেকেই তাকে গাজা উপত্যকা ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান নিতে পরামর্শ দিলেও তিনি জন্মস্থান ছেড়ে যেতে চাননি। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন-এ মাস্টার্স করার সুবাদে তিনি যুক্তরাজ্যেই স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন বলে অন্যরা ধারনা করলেও বাস্তবে তা হয়নি। পরিবারের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিলো। মানবিক গুণ সম্পন্ন একজন সৃজনশীল মানুষ ছিলেন তিনি। গাজাকে আলোকিত করেছেন। ‘গাজা রাইটস ব্যাক’ গ্রন্থটির মাধ্যমে নতুন অনেক লেখক তৈরী করেছেন। যাদের বেশিরভাগই তার ছাত্র-ছাত্রী।
যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থানকারী ফিলিস্তিনি ঔপন্যাসিক আহমেদ মাসুদ এক অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করে বলেন- রিফাত আলআরিয়ার ছাত্র জীবন থেকেই অত্যন্ত মেধাবী। তার লেখা অন্যদের উৎসাহ ও সাহস জুগিয়েছে। তিনি গাজার শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বই এর বাইরের জগতে নিয়ে আসেন। তাদের স্মৃতি শক্তি পুনরায় জাগিয়ে তুলেন।
ফিলিস্তিন এবং তার শহর গাজায় পরিচালিত ইসরায়েলি গণহত্যার বর্ণনা তুলে ধরে নির্যাতিতদের পক্ষে জনমত গঠন করতে আলআরিয়ারের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। বিশ্ববাসীকে প্রভাবিত করার অসামান্য প্রতিভা ছিল তার। যে কোন মিডিয়াতে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসরায়েলের নৃশংসতার কথা অনায়াসে তুলে ধরতেন বাস্তব গল্প বলার মধ্য দিয়ে। যা তাকে জনপ্রিয় করে তুলে।
২০১৪ সালের ইসরায়েলি বোমা নিক্ষেপের অমানবিক ঘটনার মর্ম তুলে ধরে তিনি দাবি করেন- সেই সময়ের ধ্বংস যজ্ঞের মাত্রা অনেক বেশি ছিল। একদিন তার শহরে ১৫টি প্রতিবেশির বাড়িতে বোমা নিক্ষিপ্ত হয়। সেই বাড়িগুলোকে ধূলিসাৎ করে দেয়া হয়। মাত্র ৪-৫ দিনে বারংবার বোমা হামলা ও শেল নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে সহ¯্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, সরকারি অফিস, বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুড়িয়ে দেয়া হয়। শহরের ১৫% মানুষ কর্মহীন হয়ে পরে। অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলো। তাদের আশা-আকাক্সক্ষা, উপার্জনের পথ সবকিছু শেষ করে দেয়া হয়। সেই বছর বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত তার পিতার চারতলা বিশিষ্ট বাড়িটিও বোমা হামলায় বিধ্বস্ত হয়। এতে তারাও আশ্রয়হীন হয়ে পরে, পরিবারের অনেকেই আক্রান্ত হয়।
ইউজফুল ইডিয়টস নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন- ২০১৪ সালে ইসরায়েল গাজায় ঘন্টার পর ঘন্টা বিরামহীনভাবে বোমা হামলা চালায়। টানা ৪-৫ দিন এভাবে গণহত্যা চালানো হয়। এতে তার জন্মস্থান সুজাইয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ, বিশুদ্ধ খাবার পানি, খাদ্য সঙ্কটসহ নানা রকম সেবা থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত করা হয়। এমনকি গাজার মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেটও বন্ধ করে দেয়া হয়। মিশর থেকে যেসব খাদ্য সামগ্রী বা নিত্য পণ্য আমদানি করা হতো এগুলোও আটকে দেয়া হয়। এরপর থেকে সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে ইসরায়েলি আগ্রাসনও বেড়েছে। সেখানে মানুষের জীবনও বিপন্ন হয়েছে। গাজায় যুগের পর যুগ ধরে বসবাসকারী যৌথ পরিবারগুলো ধ্বংস হয়েছে, যেখানে বাবা-মা, ভাই-বোন ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মানুষ বসবাস করতো।
গাজাবাসীর এসব বিচিত্র অভিজ্ঞতার বয়ান দিয়ে রিফাত আলআরিয়ার হয়ে উঠেন ভয়েস অব গাজা। তিনি গাজার মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর চিত্রও গল্পের মধ্য দিয়ে জানান দিয়েছেন। গাজার প্রতিটি ঘরে এখন ছোট-বড় জেনারেটর রয়েছে, বিশুদ্ধ খাবার পানির পাম্প রয়েছে এমন কথাও তিনি বলেছেন। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে পুনরায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় আবার তারা ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ, পানিসহ সব ধরনের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মৃত্যুর আগে জানিয়েছিলেন তিনি।
তরুণ লেখকদের ইংরেজিতে গল্প লেখায় উৎসাহ, অনুপ্রেরণা এবং প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য উই আর নট নাম্বারস নামের একটি রাইটিং প্রজেক্টের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রিফাত আলআরিয়ার। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফিলিস্তিুনের গাজায় সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের মানুষের কথা বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরার মানসে তরুণ লেখক সৃষ্টি করাই এর প্রধান কাজ। এসব তরুণ লেখকদের সরাসরি ইংরেজিতে লেখার অভ্যাস গড়ে তুলে সংস্থাটি। এছাড়া ২০১৫ সালে রিফাত আলআরিয়ার এবং ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত কুয়েতি সাংবাদিক ও লেখিকা লায়লা ইল-হাদ্দাদ এর যৌথ সম্পাদনায় ‘গাজা আনসাইল্যান্সড’ বইটি প্রকাশিত হয়। বইগুলো আন্তর্জাতিকভাবে বেশ সমাদৃত হয়েছে। গাজার লেখক, শিক্ষক, চিকিৎসকসহ গণহত্যা চালিয়েও তাদের কণ্ঠস্বর বন্ধ রাখতে পারেনি ইসরায়েল। তরুণ লেখকরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে রিফাত আলআরিয়ারের মতো তারাও গাজার পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করে যাচ্ছেন।
সূত্র: আল-জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউ আরব, ইউটিউব, গাজা রাইটস ব্যাক।
লেখক:সহকারী অধ্যাপক, গবেষক ও সাংবাদিক।