ঝালে-ঝোলে আমাদের ১২ ঘন্টা!

 

মোহাম্মদ শরীফ।।

ঠক ঠক শব্দে ঘুম ভাঙলো। কালো ফরমাল প্যান্টের সাথে গায়ে হাফ হাতা শার্ট। হাজির আমাদের মহিউদ্দিন মোল্লা ভাই। এখনো সূর্যের দেখা মেলেনি পূর্ব আকাশে। গন্তব্য ব্যরিস্টার সুমনের এলাকা চুনারুঘাট। সাপ্তাহিক আমোদ অফিসের সামনে থেকে ছাড়বে গাড়ি। রাইজিং জার্নালিস্ট ফোরামের সভাপতি অমিত মজুমদার ফোনে অর্ধাঙ্গিনীকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন। ঘরের সভাপতিকে ফেলে ট্যুরে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না বৌদি। তারপর আসলেন সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আকাশ। লালচে শার্টের সাথে ফরমাল প্যান্টের সাহেব। কানে কানে বললেন, ‘বউ ট্যুর উপলক্ষ্যে কিনে দিছে, না পরে আসলে বিপদ ভাই!’ আমাদের ফ্যাশন সচেতন মারুফ একদম পাক্কা ট্যুরিস্ট। পলো শার্টের ভাঁজে টু-কোয়ার্টার প্যান্টের চমকপ্রদ হাসির মারুফ। কবিতা আওড়াতে আওড়াতে আমোদ-এর নিউজ রুমে প্রবেশ করলেন তৈয়বুর রহমান সোহেল ভাই। সাথে নিয়ে এসেছেন মাহফুজ নান্টু ভাইকে। এর মাঝেই মাসুদ আলম ভাই ও ইলিয়াস ভাই আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। পারিবারিক সমস্যার কারণে নান্টু ভাইয়ের মন খারাপ। আমাদের মনে খানিক বিরহ জমে গেছে।

শেষমেশ নান্টু ভাই যেতে রাজি হলেন। সেই আনন্দে আমাদের মাঝে একটা ক্ষুদ্র শ্লোগান ও ঝটিকা মিছিল হয়ে গেল। তবে বলে উঠলেন, ‘আমার কাছে শুধু ৪০ টাকা আছে’। কালো হাইয়েস গাড়ি এসে গেছে, চালক ৫০ ঊর্র্ধ্ব একজন মুরব্বী। এই দুইটা বিষয় নিয়ে শেষে লিখবো। আমরা চাঁনপুর ব্রিজ হয়ে কুমিল্লা ছাড়ার যাত্রা শুরু করলাম। আকাশ ট্যুরের ফি আদায় শুরু করলেন। মাসুদ ভাই থেকে পনের’শ টাকা আদায়ের পর মনে হলো আকাশ পানি পথের তৃতীয় যুদ্ধে জয় লাভ করেছেন। মাসুদ ভাই ও নান্টু ভাইয়ের দুষ্টমির সাথে মিশে গেলাম আমরাও। তিতাস নদী পার হয়ে পেলাম ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আরেক রুপ। চলমান সংস্কার করা রাস্তার দুর্বিষহ যাত্রা। মনে হচ্ছিলো আমাদের থেঁতলে দিচ্ছে। বিশ^রোড গিয়ে আমাদের যাত্রা বিরতি হলো। রাজধানী হোটেলে আমাদের টিম। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ভাত খাবো। হোটেলের একেকটা আলুর ভর্তার গোলা মনে হচ্ছিলো আধা কেজি হবে! তবে এর স্বাদ দুর্দান্ত। ধনে পাতা, লাল মরিচ, কাঁচা মরিচ, কাঁচা পেয়াজ কম্বিনেশন দারুণ, ডাল, ডিম ভাঁজা । এর মাঝে মাসুদ আলম ভাই এক এলাহী কান্ড ঘটিয়েছেন। এক কেজি দধি একাই কিনে দিয়েছেন আমাদের সবাইকে খাওয়ানোর জন্য! ‘মাসুদ ভাইয়ের জয় হোক’ বলে আমরা শ্লোগান ধরলাম। খাবার শেষে আমাদের গন্তব্য হবিগঞ্জের পথে। মাধবপুরে প্রবেশ করেই চা বাগান লোভ সামলাতে পারলো না কেউ। গাড়ি থামিয়ে চা বাগানের ভিতরে সবার দে ছুট। ইলিয়াস ভাইয়ের ক্যামেরায় আমরা আবদ্ধ হলাম। কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে চা-এর বিষয় আলোচনায় এনেছিলেন মহিউদ্দিন মোল্লা ভাই। ভাই থেকে জানলাম, এখানে বৃষ্টিপাত বেশি হয়, কুমিল্লায় কম। কুমিল্লায় চা চাষের সম্ভাবনায় কিছুটা চিন্তা রয়েছে। আমরা কাছ থেকে চা পাতা সংগ্রহ দেখলাম। সেখান থেকে আমরা ছুটলাম ব্যরিস্টার সুমনের উপজেলা চুনারুঘাট। সবুজ প্রকৃতি, চা বাগান দেখতে দেখতে আমরা চুনারুঘাট উপজেলায়। সেখান থেকে আমরা সাতছড়ি উদ্যানের পথে। পথের মাঝে নেমে স্থানীয়দের সাথে আমরা আলাপ করি। পাহাড়ি ডাব খেয়ে তৃষ্ণা মেটাই। সাতছড়ি উদ্যানে প্রবেশের পূর্বে হোটেলে খাবার অর্ডার করি। মাহফুজ নান্টু ভাইয়ের নেতৃত্ব মেন্যু ঠিক করতে হবে। সৈনিক হিসেবে যোগ দেই আমি আর আকাশ। দেশি হাস পছন্দ করে দোকানিকে দিয়ে আমরা চলি উদ্যানের পথে। ৩৫ টাকা হারে টিকেট কেটে আমরা প্রবেশ করি সাতছড়ি উদ্যানে। কিছুটা পাহাড়ি এই উদ্যানে অসংখ্য গাছগাছালির মেলা। পাখির ডাকও কানে এসেছে বেশ। স্থানীয়রা বললেন, এখানে এমনও সাপ আছে যা কামড়ালে ১ মিনিটের মধ্যে মানুষ মারা যায়। তবে এরকম সাপে কামড়াতে তারাও কাউকে দেখেননি। তবে উদ্যানের সাপ থেকে সর্তক থাকার কথা বিলবোর্ডে সাঁটানো ছিল। কয়েকশো মিটার দূরে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে। শতফুটের টাওয়ারের উপর থেকে উদ্যান দেখতে সত্যিই নান্দনিক। চারদিকে বনের মতো গাছগাছালি । শীতল হাওয়া গায়ে ভেসে আসে। আমরা টাওয়ারের চূড়ায় বন্ধন এঁকে ইলিয়াস ভাইয়ের ক্যামেরায় ছবি তুললাম। উদ্যানটিতে স্থানীয়দের বেশ আসা যাওয়া। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের আনাগোনা চোখে পড়েছে বেশি। সেখান থেকে আমরা চললাম হোটেলে। উদ্যানের পাশেই হোটেল, সেখানে আমরা খাবার অর্ডার করে গেছি। জোহরের নামাজ পড়ে আমরা হোটেলে প্রবেশ করলাম। এসময় আমাদের সাথে যোগ দেন দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জাকারিয়া চৌধুরী ভাই ও আজকের পত্রিকার সহিবুর রহমান ভাই। সরিষার তেলে হাসের মাংসটা, আহ! মনে হচ্ছিলো যেন অমৃত! কিছুটা ঝাল করে রান্না করা হয়েছে। পাহাড়ি চালের ভাতের সাথে যেন হাঁসের মাংস ভক্ষণের এক উৎসব চলছিলো। তখন আমাদ সম্পাদক শ্রদ্ধেয় বাকীন রাব্বী ভাইয়ের কথা মনে পড়ছিলো। তিনি প্রায় সময় আমাদের ভোজনে দূর থেকেই অংশ নেন। এদিকে আমাদের বোকা বানিয়ে আমাদের অগোচরে বিল পরিশোধ করে ফেলেন জাকারিয়া ভাই। এর জন্য আকাশকে আমাদের টিমের সদস্যরা নানা কথা বলেছেন। খাওয়া শেষে আমরা জাকারিয়া ভাইয়ের নেতৃত্বে তেলিয়াপাড়ায় একটি চা বাগানে সম্মিলিত ছবি তোলার জন্য সারিবদ্ধ হই। সেখান থেকে হবিগঞ্জের একটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভে যাই। সেখানে ছবি তুলে আমরা বিদায় নেই। যাত্রা পথে গ্যাস নিতে গিয়ে আমাদের গাড়িটি বিকল হয়ে যায়। এছাড়া এসি সমস্যায় আমাদের কিছুটা ভোগান্তি হয়েছে। ঘন্টা খানেক সময় নিয়ে গাড়িটি মেরামত করা হয়। চালকের কিছু অসাবধানতা আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছিলো। ব্রাক্ষণবাড়িয়া এসে আমাদের গাড়ি গানের দলে রুপ নেয়। বাকি পথ আমরা গানে গানে শেষ করি। আমাদের সাথে গানের টানে শ্রদ্ধেয় মহিউদ্দিন মোল্লা ভাইও গেয়েছেন- এই পথ যদি না শেষ হয়…!