নেটওয়ার্কের বাইরে একদিন

 

মহিউদ্দিন আকাশ।।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সবুজ শ্যামল এই বাংলার পথে পথে যেমন সৌন্দর্যের পরিবর্তন তেমনি খানিক পথ যেতে যেতেই দেখা দেয় ভাষার পরিবর্তন।

কুমিল্লা শহর থেকে বেরিয়ে হবিগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে শহর পেরুতেই প্রকৃতির পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষের কথা বলার ধরণ বলনের পরিবর্তন সত্যিই অবাক করার মত। মহান আল্লাহ পৃথিবীজুড়ে কত রকমের ভাষা যে দান করেছেন তা হয়ত গুণে শেষ করা যাবে না।

আমাদের সিদ্ধান্ত হল সকালের নাস্তা করব বাউনবাইরা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) গিয়ে। কিন্তু কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়া পর্যন্ত মারুফ আর মাসুদ অন্তত অর্ধশতবার জিজ্ঞেস করছে নাস্তা কোথায় খাব? তাদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে চলছে গাড়ি।

বেহাল সড়কের ধুলাবালি আর ধাক্কা খেতে খেতে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে গিয়ে একটা হোটেলে ঢুকলাম। রুটি, সবজি,ডিম খাওয়ার প্ল্যান থাকলেও সেখানে গিয়ে বড় বড় আলুর ভর্তা দেখে সবাই বলল আলুর ভর্তা, ডাল,ডিম আর ভাতই হবে আজকের সকালের নাস্তা।

গ্রামে প্রচলিত আছে,হাতি মরলেও ঘোড়ার চেয়ে উঁচা (উঁচু)। তাই সকালে আলুর ভর্তা ডাল হলেও খাবার শেষে ‘এখন টিভির’ মাসুদ আলম ভাই দধির অর্ডার দিলেন। এ খাবারের সাথে দধি! এর চেয়ে বেশি আশ্চর্যের বিষয় হল দধির বিল মাসুদ আলম ভাই পরিশোধ করেছেন। এখানে অনুপস্থিত রাইজিং এর কেউ এ কথা বিশ্বাস করবে না এটা স্বাভাবিক। কিন্তু নান্টু ভাই বললেন আমাকে কেউ চিমটি দাও,আমি কি সজাগ? নাকি স্বপ্নে দেখতেছি!

নাস্তা পর্ব শেষে আমরা চলছি হবিগঞ্জের মাধবপুরের দিকে । কুমিল্লার প্রয়াত এক নেতা বলেছিলেন ফসলের মাঠই বলে দেবে কুমিল্লার কোথায় শুরু কোথায় শেষ। হবিগঞ্জে এমন নেতা থাকলে হয়ত বলতেন চা বাগানই বলে দেবে মাধবপুরের কোথায় শুরু!

হঠাৎ করে চা বাগানের দৃশ্য আর শ্রমিকদের সিরিয়াল দেখে ইলিয়াস ভাই বললেন ভাই এখানে একটু দাঁড়ান।

গাড়ি থামল! সবাই সবার মত করেই ছবি তুলতে ব্যস্ত। মাহফুজ নান্টু ভাই ব্যস্ত রিলস ভিডিও করতে। চা বাগানে প্রবেশ করে শ্রদ্বেয় মহিউদ্দিন মোল্লা ভাই বললেন, তোমরা চা বাগান নিয়ে লাইভ করতে পারো। এ ক্ষেত্রে কি কি বিষয় উল্লেখ করা যায় সে পরামর্শও দিলেন। আমাদের আনন্দ ভ্রমণগুলোর স্বার্থকতা এখানেই। আনন্দের সাথে শিক্ষারও সুযোগ থাকে।

আমাদের গন্তব্য সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। প্রকৃতির অপরুপ রুপ দেখতে দেখতে আমরা চলছি হবিগঞ্জের সেই জাতীয় উদ্যানে। মাহফুজ নান্টু ভাই রিলস ভিডিও আপলোড করতে গিয়ে বুঝতে পারলেন নেটওয়ার্ক নেই। আমরা সবার মোবাইল চেক করে দেখি কারো মোবাইল ফোনেই নেটওয়ার্ক নাই। সবার কপালে চিন্তার ভাজ! নেটওয়ার্ক ছাড়া মোবাইল ফোন অচল। তবুও কি আনন্দ থেমে থাকে?

নেটওয়ার্ক শূন্য মানেই আমরা চলে আসছি সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে। নেটওয়ার্কের কারণে যেন পশু পাখিদের কোন রকম ক্ষতি না হয় সে জন্য এ উদ্যানের আশে পাশে কোন নেটওয়ার্ক টাওয়ার নেই।

ভিতরে প্রবেশ করতে জনপ্রতি ৩৫ টাকা গুণতে হয়। আমরা ভিতরে প্রবেশ করেই অবাক! এ যেন গহীন বন। ভয় আর আগ্রহ নিয়ে আমরা ভিতরে হাঁটছি। পিছনে তাকালে আর পথ দেখা যায় না। চারদিকে গাছ-গাছালিতে ঘেরা নানান প্রাণীর অভয়ারণ্য। এই উদ্যানে কিছুটা ভয় লাগলেও প্রশান্তি রয়েছে।

তবে হ্যাঁ প্রাকৃতিক এই পরিবেশ দেখতে খুব কম মানুষ আসলেও জোড়ায় জোড়ায় গল্প আর খুনসুটি করতে দেখা গেছে অনেক তরুণ তরুণীকে।

বনের ভিতরে ৬ তলা ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে।সেখানে উঠে চারদিকে তাকালে সবুজ আর সবুজ রঙের ছোঁয়া মিলে। উদ্যানের ভিতরের কিছু জায়গায় বিভিন্ন প্রাণীর পায়ের চাপ দেখলে গাঁ শিউরে ওঠে। আর রঙ বেরঙের সাঁপ তো আছেই।

সাহসের কমতি আর পেটের ক্ষুধায় বন থেকে বেরিয়ে আসলাম হোটেলে। এখানে সাধারণত টুরিস্টরা হাঁস খেতে পছন্দ করে। নিজের পছন্দমত হাঁস কিনে তাদের দিলে তারা রান্না করে খাওয়ান।

আমরাও পছন্দ করে হাঁস কিনে রান্নার জন্য দিয়ে চলে গেলাম মসজিদে।

নামাজ শেষে আমরা বের হচ্ছি এমন সময়ে দুজন ভদ্রলোক আসলেন। জানতে চাইলেন আপনারা কি কুমিল্লার সাংবাদিক?

নেটওয়ার্কের বাহিরে থাকায় তারা ফোনে পাচ্ছিলেন না তাই নেটওয়ার্ক শূন্য যুগের মত করেই খুঁজে বের করলেন আমাদের। তারা দুজন হলেন- মহিউদ্দিন মোল্লা ভাইয়ের কলিগ বাংলাদেশ প্রতিদিনের হবিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি জাকারিয়া চৌধুরী ও আজকের পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি সহিবুর রহমান। দুজনেই খুব বিনয়ী এবং অতিথিপরায়ণ। আমরা একসাথে হস্য ভোজন করে আবারও চা বাগানের দিকে

জাকারিয়া ও সহিবুর ভাইয়ের পরামর্শে আমরা গেলাম তেলিয়াপাড়া চা বাগান ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সদর দপ্তরে। যেখান থেকে সেক্টর কমান্ডার ও বিভাগে বিভাগে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।

ইতিহাস ও প্রকৃতিতে ঘেরা তেলিয়াপাড়া থেকে বেরিয়ে কুমিল্লার উদ্দেশ্য রওয়ানা।

সুরে বেসুরে গান ধরলেন অমিত মজুমদার,মোহাম্মদ শরীফ, মারুফ সাথে ছিলাম আমি।

গানে গানে গাড়ি ভালই চলছিল।বিপত্তি ঘটে গ্যাস নিতে গিয়ে। গাড়ি মেরামত করতে গিয়ে বেশ সময় নিল। তবে সে সময়টা বিরক্তি নয় আনন্দের আড্ডায় কেটেছে।

মহিউদ্দিন মোল্লা ভাই গাড়িতে ভ্রমণে আমোদ সম্পাদক বাকীন রাব্বী ভাইয়ের গল্প করেন। সে গল্পে সবার অধীর আগ্রহ জমে ভাইয়ের সাথে একটা ভ্রমণের। সেই অপেক্ষায়…..।