নগরীতে ১০ লাখ মানুষের জন্য ৬টি গণশৌচাগার
কান্দিরপাড়ে স্থাপনের দাবি
আবদুল্লাহ আল মারুফ।।
৬ লাখ মানুষের নগরী কুমিল্লা। তবে ভাসমান ও অস্থায়ী মানুষ মিলিয়ে তা ১০ লাখের বেশি হবে। শিক্ষা সংস্কৃতি আর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের ব্যাপক নাম ডাক। তবে এসবের মাঝে গণশৌচাগার ব্যবস্থার অভাব নগরীকে ইজ্জত সংকটে ফেলছে। এত এত জনসংখ্যার মাঝে মাত্র ৬টি গণশৌচাগার দিয়েই চলছে এই নগরীর মানুষের প্রাত্যহিক জীবন। যা আছে তাও অনেকে চেনেন না। চিনলেও কোনটিতে কর্মচারী ঘুমান কোনটি দখল করে বানানো হয়েছে স্টোর রুম। জরুরি ভিত্তিতে কান্দিরপাড়ে শৌচাগার স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন নগরবাসী।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লা নগরীতে ছয়টি শৌচাগার আছে। এর মাঝে নগরীর কেন্দ্রস্থল কান্দিরপাড় বা তার আশপাশে কোন শৌচাগার নেই, টমছম ব্রিজ, রামমালা, পর্যটন এলাকা কোটবাড়ি, পদুয়ার বাজার, পুলিশ লাইনসসহ সিটি করপোরেশনের দক্ষিণ অঞ্চলে কোন গণশৌচাগার নেই।
জানা গেছে, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত ও স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসার জন্য কুমিল্লাসহ আশপাশের জেলা উপজেলার মানুষকে কুমিল্লা নগরীর কেন্দ্রস্থল কান্দিরপাড় এলাকায় আসতেই হয়। তাই এই এলাকাটিতে দিনরাত ব্যস্তই থাকে। এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নেই কোন শৌচাগার। অপরদিকে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ স্থান কুমিল্লা সার্কিট হাউজের পাশে শৌচাগারটি নিয়ে রয়েছে সমালোচনা। তাছাড়া যেসকল শৌচাগার আছে সেগুলোর অবস্থাও যায় যায় দশা। কোথাও নারীদের জন্য নেই আলাদা ব্যবস্থা। স্যানিটাইজার ও সাবানের ব্যবস্থাও দেখা যায়নি এই ছয়টির কোনটিতে। যেখানে শৌচাগার ব্যবহারে একটাকা ও দুইটাকা নেয়ার নিয়ম মেনে ইজারা দেয়া হয়েছে সেখানে নেয়া হচ্ছে পাঁচ টাকা থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত।
কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে, স্থানীয় বাসিন্দা ও নগরীর বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এই নগরীর মানুষের ভয়াবহ সমস্যার কথা।
কুমিল্লার একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার অফিস কান্দিরপাড়ের কেন্দ্রস্থলেই। এই অফিসে প্রতিদিনই বহু মানুষ শৌচাগার ব্যবহার করতে যান। এর মধ্যে একটি বড় অংশ নারী। যারা খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েই সেখানে যেতে বাধ্য হন। ওই দৈনিকের প্রধান প্রতিবেদক ও ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি তানভীর দিপু বলেন, কেন্দ্রস্থলে হওয়াতে বেশিরভাগ নারীরা বিপদে পড়ে আমাদের অফিসে আসেন। আমরা বুঝি তারা বিব্রত হয়। কিন্তু কি করার। পরে বাধ্য হয়ে স্টাফ ওয়াশরুমে যেতে দিতে হয়। এটা এমন একটি বিষয় যা নিয়ে কেউ কথাও বলতে লজ্জা পায়। কেউ বুঝারই চেষ্টা করেনা বিষয়টি স্বাভাবিক। যে কেউ এমন বিপদে পড়তে পারেন।
এসময় তিনি শৌচাগার না থাকায় মানুষ টাউনহল মাঠকে শৌচাগার বানিয়েছে উল্লেখ করে বলেন, যদি শৌচাগার থাকতো মানুষ মসজিদের সামনে, কুমিল্লা ক্লাবের সামনে, আর টাউনহলের পশ্চিম পাশে প্রশ্রাব করতো না। এখন দুর্গন্ধে টাউনহলে দাঁড়ানোর উপায় নেই।
আমরা সিটি করপোরেশনের কাছে অনুরোধ জানাই কান্দিরপাড় কেন্দ্রিক যেন একটি গণশৌচাগার ব্যবস্থা করেন। তা নাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠবে।
কথা হয় টাউনহল মাঠে চা খেতে আসা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সজিব উদ্দীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, কোনদিন সিটি করপোরেশনের গণশৌচাগারে যেতে হয়নি। দেখলেইতো যাবো। কোথায় কোথায় আছে তাও জানিনা। যেখানে থাকার দরকার সেখানে নেই। শৌচাগার কার না প্রয়োজন হয়? এগুলো নিয়ে গাফিলতি আসলে লজ্জাজনক।
টাউনহলের এক চা দোকানি বলেন, চা বিক্রি করি এটাই বেশি। শৌচাগার চেয়ে কোন বিপদে পড়ি আবার। প্রয়োজনে মসজিদের শৌচাগারে অথবা টাউনহলের ভিতের শৌচাগারে যাই। সেটা খুবই নাজুক অবস্থায় পড়ে আছে। কোনরকম সেরে আসি। মাঝে মধ্যে মানুষকে চা খাওয়াতেও খারাপ লাগে। সেখানে সাবান নেই, আবার পানিও থাকে না। টিস্যু দিয়ে সারতে হয়। এদিকে সিটি করপোরেশনের দক্ষিণ আঞ্চলিক অফিসের আশপাশে কোথাও কোন গণশৌচাগার নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, সিটি করপোরেশনের একটি বৃহৎ অংশ হয়েও শৌচাগার না থাকাতে স্থানীয় বাসিন্দারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে কেউই এটি নিয়ে প্রকাশ্যে আসতে বা দাবি জানাতে চাননা।
স্থানীয় একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক জানান, স্কুলের ওয়াশরুম ব্যবহার করতে আসেন অনেকে। কিছু করার থাকেনা। অনেক সময় বাচ্চারা ওয়াশরুমে থাকে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওয়াশরুমে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হয়।
এদিকে চকবাজারের শৌচাগার ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে নারীদের জন্য কোন ব্যবস্থা নেই। ৮ টি শৌচাগারের ৭টি ব্যবহার যোগ্য। একটিকে স্টোর রুম বানিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখা হয়েছে। শৌচাগারের সামনে বসে আছেন তৃতীয় লিঙ্গের একজন। ঢুকার আগেই জিজ্ঞেস করেন কি করবে? পরে দেখিয়ে দেন কোথায় যেতে হবে। ফিরতি পথ আটকে টাকা দিতে বাধ্য করেন। প্রশ্রাবখানা দুইটি। বিশাল এই বাজারে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। দুইটি প্রশ্রাবখানা যথেষ্ট নয় বলেও দাবি বাজারের ব্যবসায়ীদের। যা আছে তার লাইট নেই তবে তার ঝুলছে। সাবান নেই। সামনে ও ভেতরে ময়লা, দুর্গন্ধ।
এদিকে কুমিল্লা সার্কিট হাউজের পাশের গণশৌচাগারটিতে গিয়ে আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কোন ব্যবহারকারী পাওয়া যায়নি। পরে সেখানে কর্মরত মাসুদ রানা জানান, খুব কম ব্যবহারকারী আসেন। তাই খালিই পড়ে থাকে শৌচাগারটি। ভেতরে ঢুকে দেখা গেছে, কোথাও সাবান বা সেনিটাইজারের ব্যবস্থা নেই। নারীদের জন্য রাখা শৌচাগার গুলির সামনে ইটের খোয়া ও বালি রাখা হয়েছে। তাই সেখানে ঝুলছে তালা। নারী ও পুরুষরা একই শৌচাগার ব্যবহার করেন।
জাঙ্গালিয়া বাস টার্মিনালের গণশৌচাগারের অবস্থা সব চেয়ে বিবর্ণ। এই শৌচাগার ঘুরে দেখা গেছে, সামনেই দাঁড় করানো একটি মোটরসাইকেল। পাশে দুজন ব্যবহারকারী। স্বাস্থ্য সম্মত কোন ব্যবস্থা সেখানে নেই। শুধু দায়সারাভাবেই চলছে এটি। ভেতরে কাঁদা, পানি ও ময়লা মিলে মিশে একাকার। সঙ্গে ভাঙা লাইটের তার ঝুলে আছে। দুর্গন্ধে শৌচাগারটির আশপাশে যাওয়া অসম্ভব বলা চলে। অনেকে নাকে হাত ধরেই সেরে আসছেন। এক কোনে প্রশ্রাবখানা দুই ফুট বাই দেড় ফুট কক্ষের ওই স্থানে পড়ে আছে ব্যবহার করা টিস্যু ও কাগজ। পড়ে আছে ময়লা। সেখানকার তিনটি শৌচাগারের একটিতে থাকেন সেখানকার কর্মরত প্রদীপ নামের একজন।
তার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, শৌচাগারের ওই কক্ষটি ভাঙা। তাই তাকে সেখানে থাকতে বলা হয়েছে। রাতে সেখানে ঘুমান তিনি। কক্ষটি দেখতে চাইলে মুহূর্তে লাপাত্তা হয়ে যান প্রদীপ।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামগামী বাসের যাত্রী রোজিনা বেগম বলেন, শৌচাগারের এমন হাল আর দেখিনি। দরজা এত শক্ত যেন লাগানোও যায়না। পুরুষ মহিলা আলাদা নেই। বিপদে পড়ে এসেছি।
বাস চালক আবুল খায়ের বলেন, বাস থেকে নেমেতো আর শৌচাগার ব্যবহার করতে পারিনা। তাই স্টেশন এসেই যাচ্ছি। সামনে আরও দুজন আছে। না পারতে যেতে হচ্ছে৷
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ বলেন, আমাদের ছয়টি শৌচাগার আছে। এর মধ্যে সব গুলোই ইজারা দেয়া। ইজারাদাররা পরিষ্কার না রাখলে মানুষ কম আসবে এটাই স্বাভাবিক। আর যদি কোন সমস্যা থাকে সিটি করপোরেশনকে বললে তা মেরামত করে দেয়া সম্ভব।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. সফিকুল ইসলাম বলেন, এটা সঠিক যে এত মানুষের ভিড়ে আসলে ছয়টি গণশৌচাগার যথেষ্ট নয়। এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।