নগরীর ক্যালিওগ্রাফিতে মুগ্ধতা

ইলিয়াস হোসাইন।।
কুমিল্লা ধর্মসাগর নগর উদ্যান।পূর্ব দিকের শিশুপার্কের গেইটে ঢুকতে দেখা যায় নীল রঙের ক্যানভাসের উপর আরবি হরফে টানা ক্যালিওগ্রাফি। যা নজর কাড়ে সবার। সারা দেশে ছাত্ররা তাদের রঙ-তুলির আঁচড়ে রাঙিয়ে তুলছে। এ ক্যালিওগ্রাফিও তার একটি অংশ। সরেজমিনে দেখা যায়, বাঙ্গালির হাত নামক ব্যানারে এক দল তরুণ-তরুণী শিশুপার্কের গেইট,ডায়াবেটিস হসপিটাল এবং ভিক্টোরিয়া কলেজের ইন্টারমেডিয়েট শাখার পুরাতন দেয়ালে ক্যালিওগ্রাফি করেছেন। যার সৌন্দর্য্য মুগ্ধ করছে সবাইকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তা বেশ আলোচিত হচ্ছে।
এছাড়াও,কুমিল্লার বিভিন্ন সড়কের পাশের দেয়াল,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের দেয়ালগুলোকে ছাত্ররা গ্রাফিতির রঙের অলংকৃত করছেন। চিত্র এবং লেখনীর মাধ্যমে কোটা সংস্কার আন্দোলনে শহীদ হওয়া ছাত্র,নিরীহ মানুষ এবং আহত যারা আছেন তাদের স্মরণীয় করে রাখছেন। এতে অংশগ্রহণ করছেন স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ সাধারণ মানুষ।
তাবিয়া বিনতে এরশাদ বলেন,ছোট ভাই রাহাত রাফিসহ কিছু প্রতিভাবানদের নিয়ে বাঙালির হাত টিম তৈরি করি। আরবি ক্যালিওগ্রাফি আমাকে সর্বদা আকর্ষণ করে। স্বপ্ন দেখি বাংলার তরুণরা ক্যালিগ্রাফি বিশ্বে ছড়িয়ে দিবে। কিন্তু বাংলার জমিন তখনও স্বৈরাচারী শাসকের দখলে; স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আরবি কিছু করা মানেই জঙ্গি ভাবা হতো। এ ভয়ে এগুতে পারতাম না। ৫ আগস্ট দেশ থেকে যখন ছাত্ররা স্বৈরাচার সরকার মুক্ত করলো। তখন থেকে মনে হলো আমরা মুক্ত!


আমার স্বামী সাব্বির হোসাইনের নিকট তিন মাসের সন্তানকে রেখে কাজে লেগে পড়ি। আম্মু এবং আমার স্বামী বলল চিন্তা করো না আমরা বাচ্চা সামলাবো। তারপর গ্রুপে পোস্ট করি।
বাঙালির হাত থেকে মিশনের নাম দিলাম – কুমিল্লা সাজাও! আলহামদুলিল্লাহ অনেক সাড়া পাই।
কুমিল্লা নগর উদ্যান শিশু পার্কের গেইট,ভিক্টোরিয়া কলেজ ইন্টারমেডিয়েট শাখায়, বাগিচাগাঁও ডায়াবেটিস হসপিটালের মসজিদের সামনের দেয়াল কাজ করি। কুমিল্লা বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়,কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ডিগ্রি শাখায়, ক্যালিওগ্রাফি করবো। কাঠেরপুল,পুলিশলাইন,ডিসি রোডে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। আমার ছোট ভাই আহনাফ,রাহাত, ফয়সাল ভাই সেখানে কাজ শুরু করছেন। সব থেকে মজার বিষয় হচ্ছে আম জনতা খুবই খেয়াল রাখছে। যারাই কাজ করছে কেউ পানি,কেউ খাবার,কেউ নাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রদেও যে যেভাবে পারছে সবাই মিলে সাহায্য করছেন।
তিনি আরো বলেন,ক্যালিগ্রাফিও যে সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুল আলোচিত হচ্ছে। নিজের শহরকে এবং বাংলাদেশকে ভালো কিছু উপহার দেয়াই আমাদের লক্ষ্য। আমরা এভাবেই বিজয়ের স্বাদ নিতে চাই,বাধাহীন ভাবে উড়তে চাই।

শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী হোমায়রা মেহজাবীর বলেন,দেয়ালে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরছি। এ দেশ হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলের। সবাই সমান অধিকার নিয়ে এ দেশে মিলে মিশে চলবে। চিত্রের মাধ্যমে তা প্রকাশ করছি। এছাড়াও আন্দোলনের স্লোগান,কাজী নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার লাইন,বাংলাদেশের মানচিত্র এবং দেশের ইতিহাস,ঐতিহ্য তুলে ধরছি।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোমেন জানান, সিভিল সার্জনের অফিস এলাকায় ৫০ থেকে ৬০জন ছাত্র-ছাত্রী কাজ করছি। কোনো রকম বাধা পাইনি। সকলের সহযোগিতা পাচ্ছি। বিপ্লব মানেই রক্তারক্তি, হানাহানি,মারামারি নয়,শিল্পের মাধ্যমেও বিপ্লব ঘটানো যায়;আমরা তাই করছি। দেয়ালে দেয়ালে বাংলাদেশকে পুনঃসংস্কারের বিপ্লব করছি। আমাদের মত প্রকাশ করছি।
শিশুপার্কের উদ্যানের গেইটে ক্যালিওগ্রাফি করতে ব্যস্ত শিল্পী রাহাত জানান,দিন রাত এক করে কাজ করছি। দেশটাকে নিজের মতো সাজানোর স্বপ্ন দেখছি। আমরা অনেক রাত পর্যন্তও কাজ করি। রঙ-তুলির মাধ্যমে ক্যালিওগ্রাফি দিয়ে নগরীতে শোভা ছড়ানোর চেষ্টা করছি।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন অঙ্কনশালার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শাহীন বলেন,শিশু পার্কের ছাত্রদের ক্যালিওগ্রাফি দেখেছি। সত্যিই তা মুগ্ধতা ছড়ায়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনকে শুরু থেকে সমর্থন দিয়েছি। এ আন্দোলকে উৎসর্গ করে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গ্রাফিতির আয়োজন করি। পুলিশ সুপার কার্যালয়ের দেয়ালে শহীদ আবু সাইদের বুক পাতানো ছবি,মুগ্ধের পানি লাগবে পানি,নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশ শিরোনামসহ কয়েকটি ছবি দেয়ালে তুলে ধরেছি। ছাত্রদের রক্তের বিনিময়ে আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। আমার বিশ্বাস আমাদের ছাত্ররাই দেশটাকে নতুনভাবে সাজিয় নেবে। এছাড়াও তিনি দাবি তোলেন,আমাদের শিল্প সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ কুমিল্লাকে আরো সমৃদ্ধ করতে কুমিল্লা ধর্মসাগরের উত্তরপাড়ে অবস্থিত ‘কুমিল্লা আর্ট স্কুল এন্ড কলেজটি নতুনরূপে চালু রাখা এখন সময়ের দাবি। আশা করি জেলা প্রশাসন প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক উন্নয়নে নজর দেবেন।