পতনের ধ্বনি থেকে জাগরণের ডাক

inside post
।। মনোয়ার হোসেন রতন ।।
বাঙালির ইতিহাস গৌরবের, সংগ্রামের, আর দীপ্ত সংস্কৃতির ইতিহাস। সাহস, আত্মত্যাগ ও মানবিক মূল্যবোধের উপর দাঁড়িয়ে এই জাতি এক সময় বিশ্বে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিল। অথচ, দুঃখজনক ভাবে আজ সেই চরিত্রের মধ্যে পড়েছে গভীর অবক্ষয়ের ছায়া। সততা, ন্যায় পরায়ণতা আর দেশপ্রেম – যে তিনটি গুণ বাঙালির আত্মপরিচয়ের মেরুদন্ড ছিল, সে গুলোর জায়গায় দখল নিয়েছে অনিয়ম, দুর্নীতি, মিথ্যাচার এবং আত্মকেন্দ্রিকতা।
বর্তমান সমাজে সৎ, সত্যবাদী এবং ন্যায়পরায়ণ মানুষের অস্তিত্ব ক্রমেই বিরল হয়ে পড়ছে। সমাজের শীর্ষ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত স্বার্থপরতার এক রাজত্ব চলছে। বক্তৃতার মঞ্চে দেশপ্রেমের কথা উচ্চারিত হলেও, সাধারণের মধ্যে তার প্রকৃত অনুভব প্রায় অনুপস্থিত। ব্যক্তি স্বার্থের কাছে জাতীয় স্বার্থ প্রতিনিয়ত বিসর্জিত হচ্ছে। এই প্রবণতা আমাদের চরিত্রের গভীরে এক ধরনের নৈতিক দাসত্ব আর ভীরুতা জন্ম দিয়েছে – শক্তির কাছে নতজানু, দুর্বলদের উপর নির্মম অত্যাচার।
একসময় বাঙালির গর্ব ছিল তার আত্মসম্মানবোধ, আজ তা ভঙ্গুর। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত জনকল্যাণমূলক চেতনায় দুর্বলতা স্পষ্ট। যেখানে সামান্য সুবিধার বিনিময় মিথ্যাচার করা সম্ভব। সেখানে সত্য বলার নৈতিক সাহস হারিয়ে গেছে। সততা ও সত্যবাদিতা এখন দুর্বলতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। আইন মেনে চলার বা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মানার কোন ভেতরগত প্রেরণা নেই, শাস্তির ভয় না থাকলে নিয়ম মানা যেন বাহুল্য।
পরিবার, যা এক সময় বাঙালির সামাজিক শক্তির মূল ভিত্তি ছিল, আজ তা বিভক্ত সম্পত্তির লড়াই আর সন্দেহ – ঘৃণায় ক্ষত বিক্ষত। আপনজনের মাঝেও বিশ্বস্ততা প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণ জীবনাচরণে ঠকাঠকি, জালিয়াতি, দুর্নীতি এবং প্রতারণা এতই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, মানুষ আর ন্যায়বোধের অভাব নিয়ে বিস্মিত হয় না। সামাজিক পরিমন্ডলে ভদ্রতার পরিবর্তে গালিগালাজ, হিংসা, বিদ্বেষ যেন দৈনন্দিন জীবনের অংশ। মামলাবাজি, হানাহানি এখন সাধারণ ঘটনা।
সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো, কপটতা, অকৃতজ্ঞতা ও মিথ্যাচার এখন বাঙালির চরিত্রের স্থায়ী বৈশিষ্ট্যের রূপ নিয়েছে। সাধারণ মানুষ এতবার প্রতারিত হয়েছে যে, তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। ফলে সমাজে এক বিষাক্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে ভালোবাসা ও মানবিকতার চেয়ে অবিশ্বাস, ঘৃণা ও হিংসা অধিক প্রবল।
বাঙালির এই চারিত্রিক অবক্ষয়ের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল নৈতিক শিক্ষা, আত্মমর্যাদাহীন সমাজ কাঠামো এবং স্বার্থান্বেষী নেতৃত্ব। মূল্যবোধের এই পতন জাতির আত্মপরিচয়কেই বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলেছে। একদিকে বাঙালির আছে অসাধারণ বুদ্ধি, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর ভালবাসা, অন্যদিকে আছে নৈতিক অবক্ষয়, আত্মস্বার্থপরতা ও দায়িত্বহীনতা।
তবে আশার কথা হলো, জাতি হিসেবে আমরা এখনো হারিয়ে যাইনি। আত্ম সমালোচনার মাধ্যমে নিজেদের ত্রুটি চিনতে পারলে এবং নৈতিক জাগরণের উদ্যোগ নিতে পারলে, আজকের এই ধ্বংসাবশেষের মধ্য থেকেও নবজাগরণের সূচনা করা সম্ভব। সত্যবাদিতা ন্যায়পরায়ণতা এবং প্রকৃত দেশ প্রেমের চর্চা আবার যদি ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু হয়, তাহলে সমাজে পরিবর্তিত হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ইতিহাসের সব উজ্জ্বল অধ্যায় লেখা হয়েছে সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে। এখনো সময় আছে – নিজেদের ভেতরে আলো জ্বালানোর। সততা মানবিকতা ও দেশপ্রেমের ধব্জা ধরে এগিয়ে গেলে বাঙালি আবার তার হারানো মর্যাদা ফিরে পেতে পারে। আত্মশুদ্ধির এই কঠিন পথেই রয়েছে জাতির মুক্তি।
আজ পতনের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে চারদিকে। কিন্তু যদি আমরা ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠি, তবে এ ধ্বনির  মধ্য থেকেই জন্ম নিতে পারে নতুন সম্ভাবনা, নতুন বাংলাদেশ।
আরো পড়ুন