পাহাড়ে সবুজ চা ও শিক্ষার সুবাস ছড়াচ্ছেন এক দম্পতি
মহিউদ্দিন মোল্লা ।।
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার লালমাই পাহাড়। পাহাড়ের বড় ধর্মপুর একটি গহিন এলাকা। সেখানের রুক্ষ পাহাড়ে চা এবং শিক্ষার চাষাবাদ করা হচ্ছে। তারিকুল ইসলাম মজুমদার ও তার স্ত্রী নাহিদা আক্তার চা বাগান ও স্কুল নিয়ে কাজ করছেন। সেই অলাভজনক স্কুল এখন আলো ছড়াচ্ছে। পাইপের পানি দিয়ে চাষ করা করা চা বাগান হয়ে উঠেছে দর্শনীয় স্থান।
সূত্র জানায়, তারিকুল ইসলাম মজুমদার গ্রামের বাড়ি পাশের রাকাশেরপাড় গ্রামে। বাবা আবদুল হাকিম মজুমদার ব্যবসায়ী ছিলেন। ৩ভাই ৩ বোনের মধ্যে তিনি ২য়। ভাই বোনেরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। তারা প্রবাসে থাকেন। তিনি প্রবাসে স্থায়ী ভাবে থাকতে গিয়েও ফিরে আসেন। সবুজের মায়া তিনি ভুলতে পারেন না। ছেলে আনাস মজুমদার ও মেয়ে রুসমিয়া মজুমদার জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।
সূত্র আরো জানায়, ২০১৬সালে এখানের নির্জন জঙ্গলে গড়ে উঠে মজুমদার ওয়ান ড্রপ প্রাইমারি স্কুল। স্কলের পাশের পাহাড়ে ২০২১সালে গড়ে তোলা হয়েছে কুমিল্লার প্রথম চা বাগান। স্কুলের ৪০ভাগ ব্যয় বহন করেন তারিকুল ইসলাম মজুমদার ও তার স্ত্রী নাহিদা আক্তার। বাকিটা তাদের জাপানি বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক তোশিকো অনিশিসহ তার সহপাঠিরা।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, চা বাগান ও স্কুল পাশাপাশি। তিনতলা ভবন। স্কুলে প্রবেশ করতেই প্রধান ফটকে চোখে পড়বে জাপানি,ইংরেজি ও বাংলায় স্কুলের নাম লেখা। ফটকের ওপরে পতপত করে উড়ছে সবুজের ওপরে লাল বাংলাদেশি ও সাদার ওপরে লাল বৃত্তের জাপানি পতাকা। কক্ষের পাশ দিয়ে যেতে শিক্ষার্থীরা সমস্বরে সালাম ও শুভেচ্ছা জানায়। কারো চেয়ার টেবিল লাল ও সবুজ রঙের। কারো গুলো সাদা। ১ম-থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত এখানে পড়ানো হয়। শিক্ষার্থী ১০০জন। জামা,জুতা,বই-খাতা,দুপুরের খাবার স্কুল বহন করে। শিক্ষার্থীদের পরনে সবুজ প্যান্ট ও সাদা জামা। খাবার সময় হয়ে যাওয়ায় সবই লাইন ধরে হাত ধুতে যায় বেসিনে। লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিয়ে ক্লাসে বসে খায়।
এদিকে স্কুলের পাশে পাহাড়ের মাথায় জৈব সার দিয়ে বিষমুক্তভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে চা। এই বাগানের চা পাতা রপ্তানির পরিকল্পনার কথা জানালেন উদ্যোক্তা তারিকুল ইসলাম মজুমদার। রপ্তানি হতে পারে ইংল্যান্ড ও জাপান। পাশাপাশি দুইটি মাঝারি উচ্চতার পাহাড়। পাহাড়ের উপরে ও ঢালুতে চা গাছের সারি। শীতেও স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে সবুজ চা গাছ। পাহাড়ের উপরে বসানো হয়েছে পানির ট্যাংকি। সেখান থেকে পাইপ দিয়ে পানি বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। চা বাগানে শেড ট্রি হিসেবে কড়ই ও সজনে গাছ লাগানো হয়েছে। কয়েকজন নারী পুরুষ চা বাগান পরিষ্কার করছেন।
উদ্যোক্তা তারিক-উল-ইসলাম মজুমদার জানান, তার খুব ইচ্ছে ছিলো চা বাগান ক্রয় করার। সেটা আর ব্যাটে বলে হয়ে উঠেনি। তার এক বন্ধু মৌলভীবাজার কমলগঞ্জ উপজেলার খাসিয়া সম্প্রদায়ের একটি পুঞ্জীর মন্ত্রী জিডি সান। তিনি একদিন লালমাই পাহাড়ের ভূমি ঘুরে দেখেন। জিডি সান মতামত দেন এখানে চা চাষ সম্ভব। ২০২১সালের মার্চে তিন হাজার চা গাছ লাগান। এগুলোর গ্রোথ ভালো দেখে তিন মাস পর আরো ছয় হাজার চারা লাগান। ২০২২সালে চা পাতা সংগ্রহ শুরু করেন। এখন চারার সংখ্যা ৬০হাজার।
স্কুলের বিষয়ে তিনি বলেন,আমার জন্ম কুমিল্লা শহরে। দাদার বাড়ি লালমাই পাহাড়ের পাশে। এই এলাকায় পাহাড়ে অবস্থান করা শিক্ষার্থীরা স্কুলে যায় না। এক- কাছে স্কুল নেই। দুই- স্কুল থাকলেও খাবারের সংকট রয়েছে। আমার জাপানে কিছু বন্ধু রয়েছে। তারা একবার কুমিল্লায় বেড়াতে আসেন। তারা কান্দিরপাড়ে কিছু ভিক্ষুককে টাকা দিতে থাকেন। বিষয়টি আমার স্ত্রীর নজরে আসে। তিনি বলেন-এভাবে তো মানুষের উপকার হবে না। পাহাড়ের শিক্ষার আলো জ¦ালাতে কাজ করা যেতে পারে। সেনিরিখে আমরা তাদের প্রস্তাব দেই। তারা আমাদেরকে জাপানে আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে একটি অনুষ্ঠানে তারা আমাদেরেকে পরিকল্পনার কথা বলতে বলে। হতদরিদ্রদের জন্য স্কুল করার প্রস্তাব দিলে তারা গ্রহণ করেন। জাপানি বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক তোশিকো অনিশিসহ তার সহপাঠিরা এই স্কুলের ব্যয় ভার বহনে সহযোগিতা করেন। এখানে একটি ভোকেশনাল ইনস্টিউটউ করার পরিকল্পনা রয়েছে। তাদের ঘর গোছানোসহ বিভিন্ন মেরামতের কাজ শেখানো হবে। জাপানি ও ইংরেজি ভাষা শিখাবো। জাপানে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। ভালো করাদের বিনা খরচে জাপাানে কাজের জন্য পাঠাতে পারবো।
স্কুল প্রধান শিক্ষক লাভলী আক্তার বলেন,এখানের অধিকাংশ শিশুর পরিবারের কেউ স্কুলে যায়নি। কারো মা নেই পরিবারে। কারো বাবা নেই। নানা বা দাদার পরিবারে বড় হচ্ছেন। কেউ কেউ সকালের খাবার খেয়ে স্কুলে আসতে পারেন না। এখানের শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পড়া দেখিয়ে দেয়ারও কেউ নেই। বইয়ের সাথে তাদের জীবন পরিচালানা ও পরিচ্ছন্নতায় আমরা গুরুত্ব দিয়ে থাকি।
সদর দক্ষিণ উপজেলার কৃষি অফিসার জোনায়েদ কবির খান বলেন,তারিকুল ইসলাম মজুমদার একজন উদ্যোমী উদ্যোক্তা। তিনি কুমিল্লায় প্রথম চা চাষ শুরু করেন। বাগানের অবস্থা বেশ ভালো। এছাড়া তিনি কাজু বাদাম,কফি,আদা ও কলাসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করছেন। অপরদিকে পাহাড়ে শিক্ষার আলো জ্বালানোর কাজটি প্রশংসার দাবি রাখে।