মুক্তিসংগ্রামে নজরুল সঙ্গীতের অনুপ্রেরণা
।। মোতাহার হোসেন মাহবুব ।।
উনিশশ’ একাত্তর সালের বিজয়ের মাস। রণাঙ্গনে যুদ্ধের দামামা তখন চরম পর্যায়ে। চারদিক থেকে বাঙালির বিজয়ের সংবাদ আসছে। যুদ্ধের খবরাখবর জানাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করছে। এ বেতার কেন্দ্রের গানের ইতিহাস খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে অনেক গান তাৎক্ষণিকভাবে লিখিত ও সুরারোপিত হয়েছে। এ বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর কথা মনে পড়ে। বিনয় সাহিত্য সংসদ আয়োজিত আমার লেখা ‘যুদ্ধদিনের কথা’ ও মামুন সিদ্দিকী রচিত ‘কুমিল্লায় ভাষা আন্দোলন’ গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে তিনি বলেছেন, ‘সে-সময় বেতার কেন্দ্রের গানের ও অন্যান্য পারিপাশির্^কতা শিল্পী ও কলাকুশলীরাই পর্যায়ক্রমে তৈরি করেন। স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক কর্মীরা কষ্টে থেকেও যে অসাধ্য সাধন করতে পারেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তারই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত’।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পরিবেশিত কাজী নজরুলের গানগুলো মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। অনুরণিত করেছে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারি নি, দেশে থেকে শত নির্যাতনের মধ্যে সেসব গান শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থেকেছি। শাসকগোষ্ঠীর চোখ এড়িয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের গান শোনা অনেকটা কঠিন কাজ ছিল। এ কঠিন কাজটি অনেকটা সহজ হয়ে ছিল আমাদের রান্নাঘরের ভিটির নিচে গোপনভাবে স্থাপিত ট্রেঞ্চ-এ বসে। লোমহর্ষক ওইসব ঘটনা আজ না-ই বলি।
যে কথা বলছিলাম, মুক্তিযুদ্ধকালে যেসব নজরুল সঙ্গীত মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল যেসব গানের মধ্যে ছিল ‘দুর্গমগিরি, কান্তার মতে, দুস্তর…’, ‘এই শিকল ছল মোদের এই শিকল পরা ছল …’, ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল …,’ ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি …,’ ‘তোরা সব জয়ধ্বনি করা তোরা সব জয়ধ্বনি করা!!…’, ‘কারার ঐ লোহ কপট …’, দুর্গম দূর পথ বন্ধুর …’, ‘চল্ চল্ চল্ … ইত্যাদি। শেষোক্ত গানটি স্বাধীনতা-উত্তরকালে রণসঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা ও সুরে ‘আমার সোনার বাংলা ….’, যা স্বাধীনতা-উত্তরকালে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পায়। গোবিন্দ হালদারের ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠেছে …’, এ গানের সুর করেছিলেন সমর দাস। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি …’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে …’, এ দুটি গানের সুরকার আপেল মাহমুদ, শহীদুল ইসলামের ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ …’, সুরকার সুজেয় শ্যাম ‘সলিল চৌধুরীর ‘বিচারপতি তোমার বিচার ….’, ‘ও আলোর পথযাত্রী …’, সুরকার সলিল চৌধুরী, গনেশ ভৌমিকের ‘আমরা গেরিলা আমরা গেরিলা …’, ফজল-এ-খোদার ‘সালাম সালাম হাজার সালাম…’, আবুল কাশেশ সন্দীপের ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম…’, সুরকার সুজেয় শ্যাম। আবদুল লতিফের ‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে…’, আপেল মাহমুদের ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর…’, নাঈম গওহরের ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো….’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্যে পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা…’, সহ অসংখ্য দেশাত্ববোধ গান আজও হৃদয় ছোঁয়ে যায়।
দুই.
গণজাগরণের লক্ষ্যেই নজরুল গান লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। নজরুল উপলব্ধি করেছিলেন, জনগণ না জাগলে স্বাধীনতা সম্ভব নয়। গণজাগরণ স্বাধীনতার পূর্বশর্ত যা আমরা বায়ান্ন, ছেষট্টি, উনসত্তর ও একাত্তরে দেখেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, গণজাগরণের সেই ফসল আমরা ঘরে তুললেও বারবার পোকার আক্রমণে তা বিনষ্ট হয়েছে। বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত আন্দোলনের একটি ধারাবাহিকতা ছিল। স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশ গড়ার এ ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। দেশপ্রেমের নামে যে যার মতো দল করেছে। শুধু মাত্র ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মতপার্থক্যের সৃষ্টি করেছে। ফলে ধর্মনিরপেক্ষতা তথা অসাম্প্রদায়িক চেতনা, জাতীয়তাবাদ এমনকি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন- স্বপ্ন হিসেবেই রয়ে গেছে। বাস্তবে প্রতিফলিত হয় নি বরং দিনে দিনে জনভোগান্তি বেড়েছে। দেশে কেনো কোনো ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও মানবিক উন্নয়ন কিংবা বিকাশ অতটা ঘটে নি। সাধারণ জনগণ অনিয়ম নিপীড়ন থেকে পরিত্রাণের জন্য রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। একদলীয় শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একাধিকবার চেষ্টা করেছেন। নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থান এবং এ বছর জুলাই-আগস্টের ঘটনা এরই সাক্ষর। কোন নীতিতে দেশ চলবে- এ নিয়ে এ মুহূর্তে নীতি নির্ধারকগণ হিমশিম খাচ্ছেন। অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বহির্জগতের চাপ সহ্য করে দেশ পরিচালনা করা অত সোজা নয়- একথা ক্ষমতাশীনরা উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন বলে জনগণের ধারণা। কেউ কেউ এ নিয়ে বিতর্কেরও সৃষ্টি করছেন। সনাতন জনগোষ্ঠীর একাংশ তাদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে অশুভ পায়তারা শুরু করেছেন। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য দিনদিন বেড়েই চলেছে। পরাজিত শক্তি আবারো ক্ষমতা দখলের জন্য ওত পেতে আছে। সব মিলিয়ে জাতি কঠিন সময় অতিক্রান্ত করছে। সাধারণ জনগণ লুটেরা শ্রেণির কাছে জিম্মি হয়ে আছে- এমন কথা সমাজে এখনও চলমান। শুরু করেছিলাম নজরুলের গান প্রসঙ্গে- ওখানেই ফিরে যাই।
তিন.
যে কোনো বিপ্লবের ক্ষেত্রেই গণশক্তির বিকল্প নেই। গণশক্তিই নজরুল সঙ্গীতের প্রথম দিকের উৎস নির্মাণ করেছে। এরই আলোকে নজরুল উপলব্ধি করেছেন সঙ্গীতের গণমুখী অভীম্পা ব্যতিরেকে মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জোগানো কঠিন। বলার অপেক্ষা রাখে না, নজরুলের প্রথম দিকের সঙ্গীত গণজাগরণই ইঙ্গিতবহ সর্বকালে, সর্বযুগে ও সর্বদেশে। মুক্তিসংগ্রামে নজরুলের সঙ্গীতের অবদান তথা অনুপ্রেরণা বিষয়ে লিখতে এসে দেশের বর্তমান অবস্থার কথা বলে ফেলেছি। কী আর করা। আসলে লিখতে বসলে কলম তার নিজস্ব গতিতে চলে। হয়তো একেই বলে বাক-স্বাধীনতা, যা আমরা অনেকটা হারিয়েছি কখনো অশুভ রাজনৈতিক দাপটে কখনো রাষ্ট্রযন্ত্রের কূটকৌশলে। সকল অমাবস্যা কাটিয়ে জাতি দ্রুত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা। এরই আলোকে বিদ্রোহী কবিকে বিজয়ের মাসে স্মরণ, তাঁর সঙ্গীতের বাণীকে নতুন করে উপলব্ধিকরণ।
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।