প্রকৌশলী সম্পদ ঘোষের ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন

ছেলেটির বাবা ও মা দারিদ্রতার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হতে পারেননি। এমন কি তাঁর দাদাবাড়ি এবং নানাবাড়ির দিক দিয়েও কোন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন না। হয়তো তাঁর আত্মীয়স্বজনও ধরেই নিয়েছিলেন, ছেলেটি তাঁদেরই মত একজন হবেন। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার কুটি গ্রামের সেই ছেলেটি সবাইকে ভুল প্রমাণ করে সফলতার সাথে জাপানের কিউশু বিশ্ববিদ্যালয় । থেকে ডক্টরেট বা পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বও তিনি এই ডিগ্রি অর্জন করেন।

ছেলেটির ছাত্র জীবনের সূচনা হয় মকিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পর্যায়ক্রমে কুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং কুটি শিশু নিকেতন দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়। তারপর মাধ্যমিক স্তরের পড়াশুনা শুরু করেন কুটি অটল বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। কিছুদিন পড়াশুনার পর বাবা-মার ইচ্ছায় ঢাকা গমন করেন ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হবার প্রস্তুতি নিবেন বলে। কিন্তু বিধিবাম, এক বছর পরও ছেলেটির শারীরিক উচ্চতা ভর্তি হবার সর্বনিন্ম উচ্চতা অতিক্রম করতে পারেনি। অগত্যা বিফল মনরথে বাড়ি ফিরে পুনরায় কুটি অটল বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পাস করে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি হন ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল ও কলেজ, কুমিল্লা সেনানিবাস-এ। সেই কলেজ থেকে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের তখনকার সময়ের তুলনায় অল্পকিছু জিপিএ-৫ প্রাপ্তধারীর মধ্যে একজন হয়ে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। অতঃপর, তড়িৎ প্রকৌশলী হবার স্বপ্ন পূরণের আশায় ভর্তি হন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)। চুয়েটের ছাত্র অবস্থায় চার বছরের কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের ফলস্বরূপ তিনি তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বি.এস.সি. ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন। তাঁর অর্জিত জিপিএ ছিল তাঁর সময়কার পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ, যা তাঁকে এনে দিয়েছে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রদত্ত “বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক”-এর মত মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননা।

জাপানের বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে অন্যসব মেধাবী ছাত্রদের মতো আবেদন করে কঠিন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে জাপান সরকারের উচ্চশিক্ষা বৃত্তি নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন নি:সন্দেহে অনেক মর্যাদার। সেই ছেলেটি আজ তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ, চুয়েট-এর সহকারী অধ্যাপকও। ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পর অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “নিঃসন্দেহে পি.এইচ.ডি, ডিগ্রি অর্জন আমার জীবনের অন্যতম বৃহৎ মাইলফলক। আমি আগ্রহভরে আমার অর্জিত জ্ঞান অনুগামী ছাত্র-ছাত্রী তথা দেশ ও জনগণের সাথে ভাগ করতে চাই, তাঁদের জন্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভাল কিছু করতে চাই। আমি জানি এটি চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু তার জন্য চেষ্টা করা আমার দায়িত্বও।”

পেশাগত জীবনের শুরুতে ২০১০ সালে প্রকৌশলী হিসাবে যোগদান করেন দেশের সুপরিচিত মােবাইল অপারেটর রবি আজিয়াটা বিডি লি.-এ। কিন্তু মন তার পড়ে ছিল শিক্ষা এবং গবেষণায়। অতঃপর ফিরে আসেন ২০১১ সালে চুয়েটে এবং প্রভাষক পদে যোগদান করেন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে। পবর্তীতে ২০১৪ সালে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি লাভ করেন। ছাত্র-ছাত্রী ও সহকর্মীদের সঙ্গে শিক্ষা এবং গবেষণা নিয়ে কাজ করে বুঝতে পারলেন উচ্চতর জ্ঞান ও ডিগ্রি অর্জন অত্যাবশ্যক। তারপর ২০১৫ সালে তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচবছর ব্যাপী মাস্টার্স ও পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি করার জন্য মনোনীত হন। সফলতার সঙ্গে ২০১৭ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি এবং পরিশেষে ২০২০ সালে অধ্যাপক বিদ্যুৎ বরন সাহার তত্ত্বাবধানে ডক্টরেট ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তাঁর পি.এইচ.ডি.-এর বিষয় মাল্টি ডিসিপ্লিনারি কাভার করে। তিনি কাজ করেছেন প্রধানত থার্মোইলেকট্রিক ম্যাটেরিয়ালয়ের উৎকর্ষ সাধনের জন্য যাতে করে বৈশ্বিক উষ্ণতা বা অব্যবহৃত তাপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। তিনি আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা এর রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গিয়ে সুপার ক্যাপাসিটরের ইলেক্ট্রোড ম্যাটেরিয়ালস ফ্যাব্রিকেশন-এর উপরও গবেষণা করেছেন। এখন পর্যন্ত তাঁর গবেষণা থেকে সাতটি সায়েন্টিফিক আর্টিক্যাল বিভিন্ন বিশ্বখ্যাত পিয়ার রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে Energy, Materials Today Energy, Energy and Buildings, Applied Thermal Engineering, IEICE Transactions on Electronics  অন্যতম।

 

এছাড়াও তাঁর গবেষণা কর্ম বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়েছে যার মধ্যে International Conference on Polygeneration (ICP), Innovative Materials and Processes in Energy systems (IMPRES), International Exchange and Innovation Conference on Engineering & Sciences (IEICES)  উল্লেখযোগ্য। অদ্যাবধি তিনি তিনবার আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকে  Best Presentation AwardÓ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। অধিকন্তু, তিনি কিউশু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন সময় রিসার্চ প্রোপোজাল জমা দিয়ে প্রতিযোগিতার মধ্য থেকে রিসার্চ ফান্ড লাভ করেছেন। তিনি জানান যে, ‘‘ডক্টরেট ডিগ্রি করা মানে শুধুমাত্র একটি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা বা জ্ঞানের ভাণ্ডারে নতুন কিছু যোগ করাই নয়, এই ডিগ্রি আসলে শেখায় কীভাবে গবেষণা করতে হয়, কীভাবে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করতে হয় যা সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং তথা মানব কল্যাণে আসে।

 

তিনি আরোও বলেন, এখনো অনেক কিছু করা ও শেখার বাকি আছে। আশা করছি আমার অর্জিত শিক্ষা ও গবেষণার দ্বারা সমাজ ও দেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারব। বর্তমানে তিনি চুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত আছেন। এছাড়াও তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডসহ বিভিন্ন গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত আছেন। তাঁর গর্বিত বাবা জনাব শংকর লাল ঘোষ কুটি বাজারের একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী এবং মা জনাবা দিপালী রানী ঘোষ একজন আদর্শ গৃহিণী।

 

প্রকৌশলী সম্পদ ঘোষ তাঁর পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। দ্বিতীয় সন্তান সাগর ঘোষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাইকোলজিতে বি.এস.সি. এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করে বর্তমানে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন। তৃতীয় সন্তান নন্দিতা ঘােষ ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসিতে বি.এস.সি. করছেন। ব্যক্তিজীবনে প্রকৌশলী সম্পদ ঘোষ এক পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর সহধর্মিনী শুক্লা ঘোষ ইংরেজি সাহিত্যে বি.এ. এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করে কয়েক বছর সহকারী শিক্ষক পদে জগদীশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন, বর্তমানে পরিবারে সময় দেয়ার পাশাপাশি সামাজিক কাজে যুক্ত আছেন।

-প্রেস বিজ্ঞপ্তি।