প্রতিবন্ধী ক্রিমিনাল

।। নাসির উদ্দিন ।।

আজন্ম পঙ্গু সে। অন্যের কাঁধে ভর করেই চলে। না হয় জন্মস্থানেই বিলীন হয়। একসময় সে অতি রহস্যময় , ওজনদার, সম্মানিত ছিল। সেজন্য তার ভীষণ কদরও ছিল। পরিস্থিতি পাল্টেছে। এখন সে ভাবগাম্ভীর্য হারিয়েছে। ওয়েট খুইয়ে চটুল হয়েছে। তাই মর্যাদা নেই। মুহূর্তেই বহুগামী হয়। অন্তর্জালে প্রযুক্ত হয়। এজন্য আগের মতো প্রাণ নেই, অচল প্রায়।
সে আচমকা এবং গোপনে জন্মায়। ক্ষমতাও কম নয়। চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে, আশাবাদী করে, হতাশ করে, মাঝেমধ্যে উলঙ্গও করে। চাহিদাও ভালোই ছিলো।
তথাপিও সে পণ্য হতে পারেনি। কারণ এর কোনো উৎপাদক নেই, আড়তে মজুদ করার সুযোগ নেই। একদম প্রতিবন্ধী অনুসর্গ, কিন্তু পুরোদস্তুর ক্রিমিনাল। তার অপরাধ? সে জন্মকালে মানুষকে সুরসুরি দেয়, উত্তেজিত করে, লাভা উদগীরণ করে, এক্সপ্রেশন দেয়। কিন্তু দায়িত্ব নেয় না, সমাধান দেয় না। ফলে তার কদর এখন তলানিতে।

এর বিপণনকর্মীরা শুরুতে বিনে পয়সার কামলা ছিল। তারা উদগীরণের লাভা বিনে পয়সায় বিলি করে সুখ পেত। পণ্য বিনিময় যুগে একদল আড়তদার এই লাভা সংগ্রহ ও বিলি শুরু করে। শুধু লাভা বিলিয়ে ভাত জুটতো না। তাই পণ্য বিপণনকে তার সঙ্গী করে। বিজ্ঞাপন নামের এই সঙ্গী এতোদিন আড়তদার ও সেলসম্যানের দায়িত্ব নিয়ে পথ হেঁটেছে। এখন সে এই প্রতিবন্ধীকে বয়ে নিতে নারাজ। ফলে আড়তদার ও সেলসম্যানের দশা বেহাল। টেম্পোরাল প্যারাডক্স।

অথচ গুরুত্ব থাকা স্বত্বেও সে পণ্য হতে পারেনি। এই পণ্য না হতে পারার কারণ কি? এই প্রশ্নের উত্তর অজানা। রুপার্ট মার্ডককে জিজ্ঞেস করলে ভালো হতো। কারণ প্রায় শতবর্ষী এই মানুষটি ১২৭ টি প্রিণ্ট মিডিয়া এবং ফক্স নিউজ, স্কাই নিউজ, ফক্স ব্রডকাস্টিং, নিউজ কর্পোরেশন, স্কাই ইউকে, ফক্স কর্পোরেশনসহ অনেকগুলো মিডিয়ার মালিক। কিন্তু সেই সুযোগ আমার নেই। যেটুকু জানি সংবাদ সেখানেও পণ্য নয়। সেখানেও তাকে বিজ্ঞাপনের কাঁধে ভর করেই চলতে হয়। কেউ তাকে কিনে না।
আড়তদারের সমস্যা নেই, ধান পান বিষ্ঠা বা অন্য কিছুতে মন দেবে সে। সমস্যা সেলসম্যানদের। যার রসুই চলে জোড়াতালিতে। শক্তিহীন খাবারে যে তৃপ্তির ঢেকুর ভুলে গেছে। স্ত্রীর কাছে যে হয়ে ওঠেছে না-মরদ। সন্তানের চাহিদার শুকনো চাহনির সামনে যে অসহায়। অনেক আগেই মরে যাওয়া চটি’কে যে, নিরন্তর হাবিয়া দোজখ দেখায়। ছেঁড়া নেকরার মতো আন্ডার গারমেন্টের অস্বস্তি লুকানো কঠিন তন্তুর বহিরাবরণ যার জ্বলন্ত শাস্তি। পকেট মিটারের কাটা নিরন্তর যার লাল থাকে। এই বেচারার অপয়া জীবন তো উনুন-কড়াইয়ের পেন্ডুলাম। সমস্যা সে, বা তারই সমস্যা।
পকেটের এই লাল দহন নিয়েই বেচারারা বালিশ কান্ডের কথা, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের কথা, হাজার কোটি লোপাটের কথা শোনায়। সংবাদ চিন্তায় অহর্নিশ গণভবন থেকে ফুটপাত, কুড়ে ঘর থেকে মন্ত্রণালয়ে কান ফেলে রাখে। রাজধানীর বাইরে এই কর্মের স্বীকৃতি তুচ্ছাতিতুচ্ছ। শুরু অসহায় পিতার গোলায় চড়ে। ধর্ণা-ধরাধরি শেষে একটা কার্ড, বড়জোর অস্থায়ী চিঠি। এই পরিচয়ই হয় গলার কাঁটা। উঁচু তলার এদিক ওদিকে কিছু আদর কদর জুটে। উত্তেজিত হয়ে ওঠে হরমোন। দূর প্রান্তে আকাশ নেমেছে মাটিতে। তাকে ছোঁয়ার কামনা জাগে। প্রান্ত ছোঁয়ার এই নিষ্ফলা বাসনার উত্তেজনা অন্য কিছু ভাবতে দেয় না। সৃষ্টি আর উত্তরণের পথ ভুলে জীবনের স্রোত শুকিয়ে তলানি চৌচির হয়। সময়ের সাথে হিসেবি জীবন সন্ধ্যায় গড়ায়। ততদিনে চোখে কেবলই সর্ষে ফুল ফোটে। অপুষ্টির আচড়ে শরীর তখন শক্তিহীন জরাজীর্ণ অসার কঙ্কাল।
সাংবাদিকের এটুকু কদরে জোয়ারের পানি দেখে ড্রেন নালার কদর্য গেছো মাছ। সে-ও লাফিয়ে উজানে ছুটে। ভাবখানা এমন সে-ই ছোঁবে আকাশ। এজন্য যে কত কিছু জানা লাগে। শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি ইতিহাস জনমানুষের জীবনাচার ফিলসফি সাইকোলজি আরও কতো জ্ঞান লাগে। কমবেশি এসব না জানলে উচ্চ লেবেলে জিজ্ঞাসা হাস্যকর হয়। কথায় লেখায় বর্ণনায় পোশাকে মুর্খতা ফুটে ওঠে। মূল্যবোধ আড়ালে অশ্রু ঝড়িয়ে দৈন্যতা দেখায়।
এই শ্রেণীর হম্বিতম্বি বেশি। জ্ঞানের অভাবে; ভাব বাসা বাঁধে মস্তিষ্কে মননে। যেটুকু শিক্ষা থাকলে মূল্যবোধ মর্যাদাবোধ সৃষ্টি হয়, ভাষা বোধ্য হয়, বাক্যগঠন কোমল হয় সেটুকু নেই। আছে কমন সেন্স নিউজ সেন্সে ঘাটতি। এরা ঘটনার প্রত্যাশা করে। অনুষ্ঠানের অপেক্ষা করে। এরা সেখানেই ছুটোছুটি করে যেখানে নিউজ নেই। নিউজ নোজ নেই বলে ঘ্রাণ এদের নাকে ধরা দেয় না। তেমন ক্রিয়েটিভ সংবাদকর্মী এরা হয়তো হতেই চায় না।
তাই এরা শুধু ভাব নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করে। রুচির দুর্ভিক্ষ ঝুলে এদের গলায় বাইকে, কখনো বাড়ির দরজাতেও। নিজেই নামে অলঙ্কার (আসলে কলঙ্ক) আঁকে। এই শ্রেণী যা-তা করতে পারে করছেও। সাংবাদিকতা ছাড়া। এখন অবস্থা আরো জঘন্য। ঐ-যে অন্তর্জাল সংস্কৃতির বন্যতা। হ্যান্ডসেটে যখন তখন যা-তা উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। আর মুদ্রণ অজ্ঞতায় ভরা কাগজগুলোও কেবল মুর্খতা ছড়ায়। শব্দবিন্যাস বাক্যগঠন ব্যাকরণ গলাগলি করে আত্মহত্যার পথ ধরে।
এই সেলসম্যানরাই এখন সাংবাদিকতার গলার কাটা। এরা দাওয়াত খোঁজে। দলবেঁধে ভাড়া খাটে। খ্যাপ জোগাড় করা দলনেতা গোত্রপতির মতো। সিংহভাগ পকেটে পুরে উচ্ছিষ্ট অন্যদের বিলায়। আবার সমভাগেও খ্যাপ হয়। ঘটনার আঁচ পেলেই ছুরি ফেলে চামারের ভাগ জানান দেয়। না হয় কথায় কথায় বাসন্তীর কিসসা কিংবা অন্য কোনো গোয়েবলসকে পুঁজি করবে। কারণ তার ধান্দা চাই। দিনভর মধু মেওয়া’র নহর বয়ে চলা অফিসে হাজিরা দেয় সে। এই উচ্ছিষ্টের লোভেইতো সে ড্রেন নালা থেকে ওঠে এসেছে। মাত্র শ টাকার কোটায়ও সে চিৎ কাত হয়। এতোই সস্তা সে।

ঢাকায় নিউজ সিন্ডিকেট আছে। কোন এঙ্গেল থেকে কিভাবে ঘটনা দেখানো হবে সেই ফর্মুলা নিয়ে ঐকমত্য তারা। কারণ এই ফরমায়েশে ভায়াগ্রার উত্তেজনা থাকে। কখনো কখনো সর্বোচ্চ কর্তাই উত্তেজক গেলেন। সেই উত্তেজনায় রাষ্ট্রকে জ্ঞান দিতে পলিসি মেকার বনে যান। শব্দচয়ণে তাকে ভাঁড় দেখায়। তাকে টেনে নিতে হয় অধীনস্থকে। দেশে এখন ভোতা অস্ত্রের এই কাগুজে দাপট চলছে। এতেই ভাব এবং ভাত দুই-ই মিলে। সমাজপাঠে এজন্য সাংবাদিকতা এখন লজ্জা এবং ঘৃণারও। এই প্রতিবন্ধী ক্রিমিনালের…।
ভবিষ্যৎ কি? এর দায় কে নেবে? সভ্যতার সাথে অসভ্যতার এই সমান্তরাল বসবাস থামাবে কে?
লেখক: সাবেক নিজস্ব প্রতিবেদক,প্রথম আলো।