প্রবাসে তিনটি অভিজ্ঞতার গল্প
।। মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী।।
০১. ওয়াশিং মেশিন বিড়ম্বনা
ব্রাসেলস তখন আমি কিছুটা থিতু হয়েছি। যে বাসাটায় ভাড়া থাকতাম সেটার কিচেনটি ছিল মোটামুটি সাজানো। অর্থাৎ রান্নাঘরে ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, চুলা, আরো ছোট খাটো প্রয়োজনীয় উপকরণ এজেন্সি কর্তৃক আগে থেকে সেট করা ছিল। জিনিসগুলো খুব নতুন নয় বলেই মনে হলো। সম্ভবত: এর আগের ভাড়াটিয়ারাও এগুলো ব্যবহার করেছেন।
যাক্ দিন কেটে যাচ্ছিলো ভালোই। একদিন আমি অফিস ছুটির দিন ওয়াশিং মেশিনে কাপড় ও সাবান দিয়ে চালু করার সুইচ অন করলে দেখি সেটি চালু হচ্ছে না। আরো ২/১ বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। অথচ এর আগের দিনও দেখেছি এটি কাজ করেছে। একটু চিন্তিত হলাম। ফোনে আমার অফিসের একজন সহকর্মীর সাথে তার পরামর্শ জানতে চাইলাম। তিনি জানালেন মেশিনটি চালানোর আর চেষ্টা না করে আমি যাতে এজেন্সির লোকদেরকে বিষয়টা জানাই। উনার পরামর্শমতো আমি ফোন করে এজেন্সির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বিষয়টা অবহিত করলাম। অবাক ব্যাপার হলো এজেন্সির লোক আমার কথা শুনে বার বার বলতে লাগলো যে, এ বিষয়ে তাদের করণীয় কিছু নেই- আমাকেই নতুন একটা মেশিন কিনে সেটা সেট করতে হবে। আমি পড়লাম খানিকটা বিপদে। এ ধরণের একটা নতুন মেশিনের দাম প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ ইউরো। এটি আমার জন্য অনেক খরচের একটা বিষয়। আমার বেতনের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। বার বার মনে হতে লাগলো এত অল্প কদিন ব্যবহারে এ ধরণের একটা মেশিন নষ্ট হয়ে যাবে কেন। তাছাড়া এজেন্সির লোক নিজে এসে মেশিনটা একটুও পরীক্ষা করে না দেখেই তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল-এটা কেমন কথা।
বসে বসে ভাবছি কি করা যায়। পরে ঠিক করলাম অফিস খুললে আমার অফিসের বেলজিক ড্রাইভারের (বেলজিয়ামের নাগরিক) সাথে আলোচনা করে ঠিক করবো। যেই কথা সেই কাজ। অফিস খুললে ড্রাইভারকে ডেকে বিষয়টি নিয়ে তার মতামত জানতে চাইলাম। সে কিছুক্ষণ ভেবে আমাকে জানালো-আমি ৭৫ ইউরো (প্রায় ৭৫০০টাকা) খরচ করে একজন সার্টিফিকেটধারী টেকনিশিয়ানকে ডেকে ওয়াশিং মেশিনটা দেখাতে পারি। টেকনিশিয়ান মেশিনটি পরীক্ষা করে এর বন্ধ বা নষ্ট হবার কারণটা জানাবে, সেটি আমার পক্ষেও যেতে পারে আবার নাও পারে।
অনেক ভেবে আমি টেকনিশিয়ান ডাকার সিদ্ধান্ত নেই। তার সাথে একটা এপয়েন্টমেন্ট ঠিক করি। ব্যস্ত টেকনিশিয়ান সময় দিল ৫ দিন পর। আবার অপেক্ষার পালা শুরু। ৫ দিন পর এক বিকেলে একজন টেকনিশিয়ান নিজেই গাড়ি চালিয়ে আসলেন এবং হাতে একটা টুলবক্স নিয়ে মিনিট ১৫ এর মতো ওয়াশিং মেশিনে কি সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। পরে ফরাসি ভাষায় কি সব লিখে একটা ডাক্তারের প্রেসক্রিপসন ধরণের কাগজ আমাকে দিয়ে গেল। মুখে ফরাসি ভাষায় আমাকে কিছু বললো- যা আমি বুঝতে পারলাম না। তবে তার হাতের ইশারায় আন্দাজ করলাম মেশিনটি এ জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। তার মানে মেশিনটি আর কাজ করবে না। আমি তাকে ৭৫ ইউরো দিয়ে বিদায় করলাম, কিন্তু আমার টেনশন কমলো না।
পরদিন অফিসে গিয়ে বেলজিক ড্রাইভারকে ফরাসি ভাষায় লেখা সে প্রেসক্রিপসন জাতীয় কাগজটা দেখলাম। সে মনোযোগ দিয়ে পড়লো এবং আমি খেয়াল করলাম সে মিটিমিটি হাসছে। এক সময় সে বেশ কিছুটা জোরে হেসে বললো মি. রানা (আমাকে সে মি. রানা বলেই সম্মোধন করতে) তুমি জিতে গেছো। এ মেশিনটার আয়ু শেষ হয়ে যাওয়ায় এটি নিজ থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। এর জন্য তোমার কোন দায় নেই। তার কথা শুনে আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। পরবর্তীতে এজেন্সির লোক এ কাগজ নিয়ে গিয়ে ৩দিনের মধ্যেই নতুন একটি মেশিন সেট করে গেল।
যাক আমার ৭৫ ইউরো খরচের সাহসী সিদ্ধান্তের বদৌলতে ১০০০ ইউরো খরচটা বেঁচে গেল। অনেক অনেক ধন্যবাদ জানালাম সেই গাড়িচালককে।
০২. প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন কোরিয়ান অভিজ্ঞতা
আমরা যখন কোন ধরনের সেবা নিতে কোন প্রতিষ্ঠানে যাই, আমরা সব সময় আশা করি সে প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা একটা ভালো তথা গ্রহণযোগ্য সেবা পাব। অল্প কথায় বলা যায় আমরা ওই প্রতিষ্ঠান থেকেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করি। বিষয়টি খোলাসা করছি উদাহরণ দিয়ে। আমি তখন দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল বাংলাদেশ দূতাবাসে বাণিজ্যিক কাউন্সিলর হিসেবে কর্মরত। আমার বাসায় কোরিয়ান একটি নামকরা টেলিকম কোম্পানি থেকে ইন্টারনেট সেবা নিতাম। বেশ ভালো সেবা পাওয়া যেত এবং সবকিছু ভালোভাবেই চলছিল।
২০১৯ সালের একদিন সিউল শহরে আমাদের দেশের কালবৈশাখী ঝড়ের মতো দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করছিল। প্রচন্ড বাতাসের সাথে বজ্রপাত ও বৃষ্টি হাচ্ছিল। খুব শীত। হঠাৎ করে কাছাকাছি একটা বজ্রপাতের আওয়াজ শোনা গেল এবং কিছুক্ষণ বাদে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে গেল। এমন আবহাওয়ায় বিদ্যুৎ কিংবা ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে আমরা বাংলাদেশি এমন অবস্থায় সাথে খুবই পরিচিত। কিছুক্ষণের মধ্যে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান/কোম্পানি ফোনে এসএমএস টেক্সট করে জানানো হয় আমাদের বাসার কাছাকাছি এলাকায় তাদের ইন্টারনেট টাওয়ারের উপর বজ্রপাত হওয়ায় এই দুর্গতি হয়েছে। তারা দুঃখ প্রকাশ করে জানালো তাদের বিশেষ দল কাজ করছে এবং আশা করছে ৪২ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে এটি আবার সচল করা যাবে। পরবর্তীতে আমরা বেশ কিছুটা সময় ইন্টারনেট ছাড়া কাটালাম। ১৮ ঘণ্টা পর ইন্টারনেট সচল হল। কিন্তু এরই মধ্যে ওই কোম্পানি তিনবার এসএমএস করে দুঃখ প্রকাশ করলেন। ধৈর্যধারণের জন্য সেবাগ্রহীতাদের ধন্যবাদ জানালেন।
এখানেই শেষ হলো না। সে মাসের শেষে যখন ইন্টারনেট বাবদ মাসিক বিল আসলো তখন আলাদা একটা মেসেজ দিয়ে জানানো হলো, যেহেতু এই মাসে অনিবার্য কারণবশত দীর্ঘ সময় ধরে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হয়েছে তাই ক্ষতিপূরণ বাবদ ওই কোম্পানি সেবা গ্রহীতাদের সে মাসের বিল পরিশোধ করতে হবে না সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সাথে আশা করছে সেবা গ্রহীতারা তাদের সাথে থাকবেন। এটি ছিল আমার জন্য অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এই যে সেবা প্রদানকারী কোম্পানির বারবার দুঃখ প্রকাশ করা, বিল না নেওয়া এগুলোই ‘প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন’ এর উদাহরণ।
এর ফলে কি হবে? কোম্পানির এ ধরনের সেবা প্রদানের মানসিকতার জন্য সেবা গ্রহিতা এ কোম্পানি ছাড়া অন্য কোন কোম্পানির সেবা নিতে আর আগ্রহী হবে না। আমাদের দেশে এ ধরণের ভাল উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
০৩. ক্লাউন রূপী দেবদূতরা
দিন কাটে মাস যায়, বছর পূর্তি এসে যায়। এর মধ্যে ছোট মেয়ে প্রায়ই ঠান্ডা সর্দি কাশি জ্বরে ভোগে। ডাক্তার দেখাতে হাসপাতালে যাই। কিছুদিন বাদে ডাক্তার বলল বছরে ঠান্ডা কাশি জনিত কারণে বছরে তিনবারের বেশি এন্টিবায়টিক খাওয়ার প্রয়োজন হলে সে ক্ষেত্রে টনসিল অপারেশন করে নেয়া ভালো। ডাক্তারের পরামর্শ আমাদের একটু বিচলিত করে তোলে। আমরা মন থেকে সায় পাচ্ছিলাম না। এত ছোট মেয়েটার এখনই টনসিল অপারেশন করবো কি না ভাবতে লাগলাম। ব্রাসেলস বসবাসরত আমাদের পরিচিতজনদের সাথে কথা বললাম। দেখলাম সেটা শীতের দেশে অনেক স্বাভাবিক ও সাধারণ একটা অপারেশন। তারা আমাদের সাহস যোগালেন।
আরো কিছুদিন কেটে গেল। পরবর্তীতে আবার যখন ঠান্ডার সমস্যা দেখা দিল আমরা তখন অপারেশন করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। ডাক্তার সাহেব কিছু টেস্ট করে সেই রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য বললেন। যথারীতি তাই করলাম, অবশেষে অপারেশন এর একটা তারিখ পাওয়া গেল। বাচ্চার মায়ের চেয়ে আমারই বেশি টেনশন কাজ করছিল। যাক যথারীতি অপারেশনের তারিখে সকালে হাসপাতালে গেলাম। আমাদের জন্য হাসপাতালের একটা কক্ষ বরাদ্দ করা হয়েছিল। আমরা পাংশু মুখে সেখানে বসে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষণ বাদে দেখি দুজন ক্লাউন সাজের লম্বা মোটা লোক আসলেন। ক্লাউন সাজে তাদের চেহারা দেখা যাচ্ছে না। আমাদের হাসপাতাল কক্ষে বেলুন ও ছোটদের জন্য আকর্ষণীয় অন্যান্য খেলনা নিয়ে তারা হাজির হলো। আমার স্ত্রী ফরাসী ভাষায় তাদের সাথে কথা বলে বেশ খুশি মনে হলো। বলে রাখা ভালো যে, ইতোমধ্যে আমার স্ত্রী ফরাসি ভাষা কোর্স শিখতে শুরু করেছে বলে সাধারণ কথাবার্তা চালিয়ে নিতে পারত। আমিও তার কাছ থেকে ধারণা পেলাম। কিছুক্ষণ বাদে ক্লাউন সাজের দুইজন আমার মেয়ের সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলল এবং খেলার ছলে চাকা লাগানো হাসপাতালের খাটটি চালিয়ে অপারেশন থিয়েটার এর দিকে নিয়ে গেল। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছানোর পর আর আমাদের এগোতে দিল না। আমাদের মেয়ে হাসতে হাসতেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে গেল। এ দৃশ্য দেখে আমাদের মাঝেও ভয়ের বিষয়টা তেমনভাবেই ঝেকে বসতে পারেনি। অপারেশন শেষে আবারো সেই ক্লাউনরূপী দেবদূতরা আমাদের বাচ্চাটাকে হাসপাতালের সেই কক্ষে পৌঁছে দিয়ে গেল। আমার মেয়ে তখন ঘুমোচ্ছে। ঘুম ভেঙে উঠে আমার মেয়ে সেই আনন্দ জোগানো মানুষগুলোকে খুঁজতে থাকে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের শিশু রোগীদের ভয় দূর করার এই আইডিয়াটা আমার খুব ভাল লাগলো। ক্লাউন তো নয় যেন দেবদূত। আমরা কি আমাদের হাসপাতালগুলোতে এ ছোট অথচ কার্যকরী উদ্যোগ নিতে পারি না?
লেখক:বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের অতিরিক্ত সচিব।