প্রযুক্তি আর পুঁজিবাদের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া মানবিকতা

মনোয়ার হোসেন রতন।।
তখন পৃথিবীর পাঁজর ছিল কাঁদা-মাটি, কৃষকের করতলে ভোর হতো সূর্য। শিশুদের চোখে ছিল স্বপ্ন, বুড়োদের কথায় ছিল অভিজ্ঞতার আলো। কিন্তু আজ? আজ পৃথিবীর মুখে কৃত্রিম হাসি, প্রযুক্তির মুখোশে ঢাকা মানবতার ক্ষতবিক্ষত মুখ। এই যে প্রযুক্তি—স্মার্টফোন, চ্যাটবট, রোবটিক্স আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—সবই যেন এক মেকি স্বর্গের নান্দনিক প্রতারণা, যার ভিতরে লুকিয়ে আছে নিঃসঙ্গতা, যান্ত্রিকতা, আর গভীর এক মানবিক শূন্যতা।
পুঁজিবাদ আজ ঈশ্বরের আসনে বসেছে। মুনাফাই হয়ে উঠেছে ধর্ম, বাজারের চাহিদাই হয়ে উঠেছে নীতি। মানুষ আর মানুষ নেই—সে এখন ভোক্তা, সে এখন পণ্য। তার আবেগ, অনুভব, ভালোবাসা—সবই ডেটা অ্যানালাইসিসের উপাত্ত।
“মানুষ প্রথমে রুটি চায়, তারপর মুক্তি”—ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন। কিন্তু আজ এই পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যে মানুষ রুটি পায় মেশিনের মাধ্যমে, আর মুক্তি পায় অ্যাপ ডিলিট করে!
মানবিকতা?
সেটি আজ ‘লাইক’ আর ‘রিঅ্যাকশন’-এর ভিতর কাঁদে। শিশু কাঁদছে মা-বাবার সামনে, অথচ বাবা-মা তাকিয়ে আছেন টাচস্ক্রিনে। বৃদ্ধ বাবা এক কাপ চায়ের অপেক্ষায়, সন্তান ব্যস্ত কনফারেন্স কলে। যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুদের ছবি ভাইরাল হয়, কিন্তু মানবতা নিরবে কাঁদে ক্লাউড স্টোরেজে।
একটা সময় ছিল যখন গরিবের কষ্টে কাঁদতো প্রতিবেশী। আজ বড়লোকের পার্টির শব্দে ডুবে যায় পাশের ঘরের হাহাকার। একটা সময় ছিল, রিকশাওয়ালার গায়ে গরম চা গড়িয়ে গেলে যাত্রী থমকে যেত। আজ খাবার ডেলিভারির ছেলে পথেই মরে যায়, কেউ জানেই না। প্রযুক্তি দিয়েছে গতি, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে গহীনতা।
এই দুনিয়ার আয়নায় আমরা মুখ দেখি, আত্মা দেখি না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আমাদের হয়ে গল্প লেখে, প্রেমপত্র তৈরি করে, এমনকি কবিতাও বানিয়ে দেয়। অথচ হৃদয়ের ব্যথা বোঝে না। গুগল সব জানে, কিন্তু মায়ের চোখে জল পড়েছে কেন—তা জানে না।
পুঁজিবাদ নামের দৈত্য আজ বিশ্বব্যাপী এক অদৃশ্য জেলখানা বানিয়েছে। যেখানে মানবতা বন্দি, করুণা নির্বাসিত।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ফেসবুক, অ্যামাজনের অট্টালিকায় মানুষের হাহাকার ঢেকে যায় শেয়ারের চুম্বনে। অথচ এই পৃথিবী একদিন মানুষের কান্নায় ভিজেছিল, যুদ্ধবিদ্ধস্ত নারীর চিৎকারে কেঁপেছিল।
গোর্কি বলতেন, “আমি সেইসব মানুষের পক্ষে লিখি, যারা ধুলোমাটির পথ বেয়ে আসে—আলোর খোঁজে।” আমিও লিখি সেইসব মানুষের জন্য, যারা বাজারের চাপে, প্রযুক্তির জঞ্জালে, উন্নয়নের মুখোশে নিজের মানুষিত্ব হারিয়ে ফেলেছে।
আজকের এই সময়কে বুঝতে হলে চোখে মোবাইল নয়—চোখে রাখতে হবে চোখ। স্পর্শ করতে হবে হৃদয় দিয়ে, অনুভব করতে হবে যন্ত্রহীন হয়ে।
এই প্রবন্ধ কোনো প্রযুক্তিবিরোধী বিদ্রোহ নয়, এটি এক মানবিক বিপ্লবের আহ্বান। যেখানে প্রযুক্তি থাকবে, তবে মানুষের দাস হয়ে—প্রভু হয়ে নয়। যেখানে পুঁজি থাকবে, তবে হৃদয়ের পাশে—হৃদয় চেপে রেখে নয়।
আসুন, একসাথে প্রশ্ন তুলি: মানুষ কি এখনো মানুষ আছে—না কি সে এক যান্ত্রিক ছায়া মাত্র? আমরা যদি না জাগি, এই যান্ত্রিকতার স্রোতে একদিন হারিয়ে যাবে সব স্পর্শ, সব স্বপ্ন, আর সব স্নেহ।
এটাই সময়, আবার মানুষ হবার শপথ নেবার। এই পৃথিবীকে আবার হৃদয়ের ছোঁয়ায় জাগিয়ে তোলার।
