ফরিদউদ্দিন খন্দকার : একজন সফল অভিভাবক
।। মোতাহার হোসেন মাহবুব ।।
নৌ-কমান্ডো ফরিদউদ্দিন খন্দকার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। একজন সফল অভিভাবক। ১৯৪২ সনের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আমি কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় গণহত্যা বিষয়ে কাজ শুরু করি ২০১৪ সালে। সে-সময় জানতে পারি, ১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল তাতে ফরিদউদ্দিন খন্দকারের পিতা শামসুল হুদা খন্দকার শহিদ হন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী খন্দকার বাড়িতে ঢুকে এ বাড়িতে আশ্রয় নেয়া শিশু মহিলাসহ হত্যা করে ৩২ জন নিরপরাধ মানুষকে। প্রথমেই গুলি করে শামসুল হুদা খন্দকারকে। সঙ্গত কারণে ফরিদউদ্দিন খন্দকার শহিদ পরিবারেরও সন্তান। খন্দকার বাড়িতে এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি আগরতলায় ছিলেন। ‘কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় গণহত্যা’ শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর ২০১৬ সালের ১৬ এপ্রিল সকাল পৌণে ৯টায় বিটিভি-তে প্রচারিত ‘দেশটাকে ভালোবেসে’ অনুষ্ঠানে কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় গণহত্যায় নির্মম কাহিনী উপস্থাপন করা হয়। উপস্থাপক ছিলেন লে. কর্ণেল (অব:) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীর প্রতীক)। এই অনুষ্ঠানে প্রথমেই বক্তব্য রাখেন শহিদ পরিবারের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদউদ্দিন খন্দকার। এরপর শহিদ পরিবারের আরেক সন্তান মনুজা বেগম ও ‘কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় গণহত্যা’ গ্রন্থের লেখক হিসেবে আমি বক্তব্য রাখি। সেই থেকে হৃদ্যতা। এরপর যখনই তাঁর সাথে দেখা হয়েছে কূশলাদি না জেনে কিংবা না জানিয়ে কোনো ছাড় নেই। কিছুদিন আগে হঠাৎ তলব। মহাখুশি! কী ব্যাপার? বললেন, বাসায় আসেন সফলতার গল্প শোনাবো। মোগলটুলীর ফারুকী হাউসের খন্দকার ম্যানশনে গিয়ে শোনলাম তাঁর জীবনের সফলতার গল্প। তার আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌ-কমান্ডো ফরিদউদ্দিন খন্দকারের মুক্তিযুদ্ধকালীন কৃতিত্বের কথা জেনে নিই।
দুই.
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে নৃশংস অভিযান চালায়। ফরিদউদ্দিন খন্দকার নৌ-সেনা হিসেবে করাচি থেকে তিন মাসের ছুটিতে আসেন ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ভুট্টো-ইয়াহিয়ার প্রতারণামূলক ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার সপক্ষে শক্তিশালী করে তুলেছে। ২৫ মার্চের পর রেডিও পাকিস্তান থেকে ছুটিতে থাকা সামরিক সদস্যদের যার যার কর্মস্থলে যথাশিগ্গির যোগদানের জন্য প্রতিনিয়ত ঘোষণা আসতে থাকে। তিনি নৌ-বাহিনীর সদস্য। নৌ-সদর দপ্তর থেকেও সরাসরি টেলিগ্রাফের মাধ্যমে নির্দেশ আসতে থাকে। কিন্তু তাঁর কাছে বারবার বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ডাক মনে পড়ে- ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লা’।
বাবার শহিদ হওয়ার ব্যথা বুকে চেপে ফরিদউদ্দিন খন্দকার আগরতলা হয়ে পাড়ি জমান কলকাতা। ওখান থেকে যান চব্বিশ পরগনা জেলায় হাসনাবাদে। মেজর জলিলের নিয়ন্ত্রণাধীন ৯নং সেক্টর হেডকোয়ার্টারে অবস্থানকালে বাংলাদেশের ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিভিন্ন অপারেশনের ফাঁকে ফাঁকে কলকাতার ভারতীয় নৌ-বাহিনীর সদর দপ্তরে যোগাযোগ রক্ষা করেন। সে-সময়কার অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে ভারতীয় নৌ-বাহিনীর থেকে ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ দুই গানবোট দিয়ে হলদিয়া নৌ-বন্দর থেকে বাংলাদেশের উপকূলাঞ্চলে অপারেশন চালান। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচ- আক্রমণের মুখে ৬ ডিসেম্বর যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে খুলনায় এসে জড়ো হয়েছে- এমন খবর পেয়ে ভারতীয় নৌ-কমা-ার সামন্তের নেতৃত্বে পদ্মা, পলাশ এবং প্যানডেল গানবোট দিয়ে হলদিয়া পোর্ট থেকে যাত্রা করেন খুলনার উদ্দেশে। আক্রমণে পর্যুদস্ত করে পাকি সেনাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করাই ছিল তাদের লক্ষ্য।
১০ ডিসেম্বর দুপুর ১২টা। পদ্মা, পলাশ ও প্যানডেল বোট খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে পৌঁছে। হঠাৎ আকাশে শত্রুপক্ষের বিমানের উপস্থিতি। কিছু বুঝে উঠার আগে বিমান থেকে বোম্বিং পালাক্রমে গানবোটের উপর পড়ে। এতে গানবোট ‘পদ্মা’ পশুর নদীতে ডুবে যায়। পলাশের ইঞ্জিন বিকল হয়ে রূপসা ঘাটের চড়ায় উঠে আটকে যায়। শত্রুপক্ষের বোম্বিং-এ শহিদ হন বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ রুহুল আমিন, মহিবুল্লাহ, আফতাব, দৌলত, রফিক, আকতার, সিরাজসহ অনেকে। ফরিদউদ্দিন খন্দকারসহ এগারজন নৌ-সেনা পাকিসেনা আর রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিসেনাদের প্রধান দপ্তর খুলনা সার্কিট হাউসে। পথিমধ্যে নির্মম শারীরিক নির্যাতন ও অশ্লীল গালিগালাজ করা হয়। সার্কিট হাউস থেকে হাসপাতালে ও পরে খুলনা জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যান্য কয়েদিদের কাছ থেকে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের জেলখানায় এনে সন্ধ্যার পর পালাক্রমে হত্যা করা হয়। তারাও মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ঘন্টা বাজে। বেঁচে যান ১১ জন নৌ-সেনা।
তিন.
স্বাধীনতা-উত্তরকালে ১৯৭২ সালে ফরিদউদ্দিন খন্দকার কমিশন প্রাপ্ত হন। ১৯৭৫ সালে নৌ-বাহিনীর চাকরি ছেড়ে বি আই ডব্লিউতে যোগদান করেন। ১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে যুগ্ম পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা বলার পর তিনি তাঁর জীবনের সাফল্যের কথা একে একে বলতে থাকেন। অবসরগ্রহণের পরে তিনি পুরোপুরি সংসারী হয়েছেন। স্ত্রী হাসনা হেনা ফরিদ ২০১৮ সালে মারা যান। ১ ছেলে ৩ মেয়েকে নিয়ে গড়া সংসার জীবনে স্ত্রী অচিনপুরে পাড়ি দিলেও সন্তান ও নাতি-নাতিনরা আজ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদউদ্দিন খন্দকার বর্তমানে শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেও মানসিকভাবে প্রশান্তিতে বসবাস করছেন। পুত্র খন্দকার হেলাল আহমেদ সুমন কানাডা থেকে বিবিএ ও অষ্ট্রেলিয়া থেকে এমবিএ পাস করার পর এখন ইংল্যা-ে স্বপরিবারে বসবাস করছেন। এ দম্পত্তির এক ছেলে রাইহান আহমেদ ও মেয়ে সামারা আহমেদ উভয়ই মেধাবী শিক্ষার্থী।
কন্যা তাহমিনা শামীম রিনু তার স্বামী মোঃ রাসেল আহমেদ। এ দম্পত্তির পুত্র রাইয়ান আহমাদ নিহাল ৮ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। সে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশসেবা করতে চায়। আরেক কন্যা রেজোয়ানা শামীম রূপা, তার স্বামী মোঃ আমিনুল ইসলাম আমিন। এ দম্পত্তির কন্যা ইসাতির রাদিয়া নামিরা এবার এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস অর্জন করেছে। সে ঢাকা মিরপুরের মনিপুর হাই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। সে ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চায়।
প্রথম কন্যা ফারজানা শামীম শিমু স্বামী মোজাম্মেল হক সাজ্জাদ। এ দম্পত্তির দুই মেয়ে সাবিতা হক রোজা ও সোহানা হক রাহা। সাবিতা হক রোজা নারী উদ্যোক্তা হতে চায়। খন্দকার ফরিদউদ্দিন খন্দকারের তিন মেয়েই এখন ঢাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে বসবাস করছে।
ফরিদউদ্দিন খন্দকার বলেন, যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। সহযোদ্ধাদের অনেকে শহিদ হয়েছেন। তাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। নিরলস কষ্ট করে সংসার সাজিয়েছি। লোভ-লালসা পরিত্যাগ করেছি। বাড়তি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করিনি। আজ আমার পুত্র-কন্যা, নাতি-নাতনি সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করছে এতেই আমি আনন্দিত। দেশ স্বাধীন না হলে আমি বেঁচে থাকতাম না। এমন সুন্দর পরিবারও গড়ে তুলতে পারতাম না। পরিবারের সবার পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই- বাকি জীবন যাতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারি।
লেখক: সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।