বিপ্লব পরবর্তী প্রত্যাশা

হুমায়ুন কবির।।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুধুমাত্র একটি আন্দোলন নয়। আমাদের দেশের মধ্যে হয়ে আসা সকল অনিয়ম এবং সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। ‘দৈনিক প্রথম আলো’ রিপোর্ট অনুসারে-বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার মৃতের সংখ্যার ৭৫৭ জনের অধিক বলে জানা যায়। আর দিন দিন লাশের সংখ্যা বাড়ছে। “আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া,করিতে পারিনি চিৎকার। বুকের ব্যথা বুকে চাপায়ে করেছি শুধু এ চিৎকার”।, শিল্পী হায়দার হোসেনের বিখ্যাত গান মনে মনে বির বির করে উঠে প্রতিটি বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে। এখানে গুলি,সংঘাত ও সহিংসতায় নিহত মানুষের মাঝে শিক্ষার্থী,নারী,শিশু,বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা,কর্মীসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ রয়েছে। এখানে শুধুমাত্র ঢাকায় মৃতের সংখ্যা ৩৭২ জন। ঢাকার বাইরে মৃতের সংখ্যা ৩৮৫ জন। এটা এমন হলো কেন? পুলিশ এবং সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষও মারা গিয়েছে। এ ঘটনাটি ঘটে দুটি পর্যায়ে, প্রথমটি ঘটে (১৬ই জুলাই,২০২৪ থেকে ৩রা আগস্ট,২০২৪) এবং দ্বিতীয়টি ঘটে(৪ আগস্ট,২০২৪ থেকে ২৩শে আগস্ট,২০২৪)।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত বিক্ষোভ ও পরবর্তী সহিংসতায় কমপক্ষে ৬৫০ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও অস্থিরতা বিষয়ে প্রাথমিক বিশ্লেষণ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন ১৬ আগস্ট জেনেভা থেকে প্রকাশিত হয়। এই তথ্যও “দৈনিক প্রথম আলো” মাধ্যমে পাওয়া।
আয়না-ঘর,গুম,খুন,লাশকে বেওয়ারিশ করে দাফন করা। এই সংস্কৃতি রেখে দেশের উন্নয়ন করলে কি আর হবে? দেশটাকে গলিত-পচা লাশের সঙ্গে তুলনা চলে যে এমন লাশও যাকে চেনা যায় না। উপায় নাই একমাত্র ভরসা ‘ডিএনএ’ পরীক্ষা। সঙ্গে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে দাফন হওয়া মেনে নেয়া যায়? যায় না। এখন কোন দেশের ‘জাতীয় সংসদ সদস্য’ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে মৃত্যু মেনে যায় না।
পার্শ্ববর্তী দেশের কারও যে আমাদের গত ক্ষমতাসীন দলের হুমরা-চুমরার মৃত্যু অনেক ডলার সাথে নিয়ে মেনে নেয়া যায় না, যায় কি? ২৫টি লাশের কোন ময়নাতদন্ত নাই,এটা মেনে নেয়া যায় কি? গত কিছুদিন আগে আশুলিয়া সামনে এক ভিডিও বার্তায় দেখা যায় স্তুপাকারে লাশ,ভ্যানের উপরে তুলছে। তারপর সে লাশগুলোকে জ্বালিয়ে দেয়া হলো, তাও এ দেশের পুলিশ দ্বারা জ্বালিয়ে দেয়া হল। যার বেতন আর গুলি জনগণের টাঁকায় কেনা হয়। এমন ন্যাক্করজনক ঘটনা পৃথিবীর কোন জাতিও মেনে নিবে না। একটি কবিতার লাইন মনে পড়ছে-“এই জল্লাদের রঙ্গ-মঞ্চ খানা আমার দেশ না, এই মৃত্যু উপত্যাকা আমার দেশ না”।
নির্বিচারে গুলি করে ৭৫৭জন ছাত্র ও জনতা মেরে ফেলা কোন সভ্য জাতির জন্য সুখকর নয়। আধুনিক বিশ্বে এত মানুষ মারার রেকর্ড নাই। ছাত্র ও জনতা কেন জীবন দিল? এই ছাত্র জনতা কেন সুন্দর জীবন ফেলে পঙ্গুত্ববরণ করল? এখন সারা জীবন ধরে বয়ে বেড়াবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মর্মকথা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যেন ভবিষ্যৎ পরজন্মের জন্য একটা সুন্দর বাংলাদেশ। যেখানে থাকবেনা কোন বঞ্চনা আর কোন বৈষম্য।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রদের ভূমিকা। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী সরকারকে হটানোর আন্দোলন কিংবা অধুনা ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এসব আন্দোলনের মাধ্যমে যে প্রত্যাশাগুলো জন্ম নিয়েছে, তা আজকের বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কিছু প্রধান প্রত্যাশা উল্লেখ করা হলো:
ঘুষ,দুর্নীতি,টেন্ডারবাজি আর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটবাজিঃ বাংলাদেশে যে কোন অফিসে যান সব জায়গাতে ঘুষ দুর্নীতিতে আকুন্ঠ নিমজ্জিত। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকে বলছি। আমার বাবার পেনশনটা আমি তার প্রতিবন্ধী ছেলে হিসাবে পাব। প্রথমেতো কথাই বলা যায় না। সে কি তাকে দিয়ে গেছে। সেই ডকুমেন্ট তারপর বলে এইতো এখানে স্বাক্ষর অস্পষ্ট। অথচ এই ডকুমেন্ট সেই অফিসেই আছে। আফসোস একজন প্রতিবন্ধীর সাথে এই আচরণ করলে সাধারণ লোকের কি আচরণ! এবার বোঝেন। টেন্ডারবাজি জীবনভর শুনেছি। এখন আর শুনা যায় না। একটা ছোট পর্দার দাম ১২০০০ টাকা। টেন্ডারে এত বেশি পর্দার দাম। বাহ! কি মজা। আমার জীবনে আমি কোনদিন আলু ২০টাকার উপরে যাইতে দেখিনি। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটবাজরা সিন্ডিকেট করে আলু এখন ৬০-৭০ টাকা প্রতি কেজি। এবার বুঝেন। এরকম বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের কাছে এই ধরনের ঘুষ,দুর্নীতি,টেন্ডারবাজি এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটবাজি মুক্ত বাংলাদেশ চাই।
শ্লোগানমুক্ত আর কথিত উন্নয়নঃ শ্লোগানে শ্লোগানে আমরা সেই রকম লেজুড়ভিত্তিক তালকানা দলের শোডাউন আর চাই না। হেলমেট বাহিনী আর দলকানা পুলিশবাহিনী আর চাই না। ক্যাম্পাস থেকে রাজনীতি হটাও। চাই নতুন বাংলাদেশ।
দুবেলা এবং দুমুঠো ভাত চাইঃ বাজারে গিয়ে আর কাঁদতে চাই না। সব জিনিসের দাম আকাশচুম্বী হবে না। হবে সবার জন্য বণ্টনকৃত সুষম মার্কেট। যেখানে ক্রেতা এবং বিক্রেতার জন্য স্বাস্থ্যকর বাজার ব্যবস্থা।
পরিবহনে বেনামী টোলঃ এই জায়গায় আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি গতকালও দশ টাকা বেশি দিয়ে আসলাম। কুমিল্লা থেকে বুড়িচং পর্যন্ত রাস্তা এমনি বিভীষিকাময়। এই সকল পরিবহনখাতের দুর্নীতিমুক্ত রাস্তা চাই। চাই সবার জন্য উমুক্ত রাস্তা।
কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমুল্যঃ সেই রকম চাই না সিঙ্গাপুর এবং আমেরিকা দেশ হয়ে গেছে। সেই রকম উন্নয়ন চাই। যেখানে কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমুল্য পাবে। বাজার থেকে কেঁদে ফিরে আসতে হবে না আর। কিংবা বাজারে পন্য ফেলে আসতে হবে না।
খামারি গরু সস্তায় দিতে পারবেঃ আবারও বাজারে গরুর খাদ্যের মুল্য সস্তায় পাওয়া যাবে যার ফলে গরু সস্তায় বিক্রি করতে করা যাবে। খামারি খুশি হবে সস্তায় গরু বিক্রি করে। আর প্রতিটি কোরবানির জন্য কেনা গরু কিনে ক্রেতা খুশি হবে সস্তায় গরু কিনতে পেরে। এটাই নতুন বাংলাদেশের ছাত্রদের কাছে।
মুদ্রাস্ফীতি হ্রাসঃ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে হবে। যেমনঃ ১০০০ টাকা যে সালে বের হয়েছে তার থেকে আজ পর্যন্ত ১০০০ টাকা এখন ২০০ টাকার মান হয়েছে। কারণ আগে ২০০ টাকায় যে প্রোডাক্ট পাওয়া এখন ১০০০ টাকায় সে প্রোডাক্টগুলো পাওয়া যায়।
আয়নাঘর, গুম, খুন আর বেওয়ারিশ লাশ হওয়াঃ প্রতিটি নাগরিকের আয়না ঘরে হারিয়ে যাবে। গুম হয়ে তার কোন হদিস জানবে না।পরিবারের মানুষ জানবে না। খুন হয়ে যাবে। খুন হয়ে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যাবে পরিবার জানবেনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ গ্রহণ ছাত্রদের নিকট আয়না ঘর,গুম,খুন আর বেওয়ারিশ হওয়া মুক্ত বাংলাদেশ চাই তাদের নিকট।
কালো আইন মুক্ত সাংবাদিকতাঃ সাংবাদিকতা হবে কালো আইন মুক্ত বাধাহীন। প্রাঞ্জল মুক্ত স্ফটিকের মত সাংবাদিকতা। কলম চলবে নির্ভীক। নতুন ছাত্রদের কাছে নতুন সাংবাদিকতা হবে নব দিগন্তের জয়গান।
সমান শিক্ষা ও সুযোগ: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো শিক্ষা, কাজের সুযোগ এবং অন্যান্য সামাজিক সুযোগ-সুবিধায় সমতা আনা। বাংলাদেশি হিসেবে প্রত্যাশা থাকবে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির প্রক্রিয়ায়, বৃত্তি প্রদানে এবং চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি থাকবে না। আমরা ২৭ লাখ তার কিছু কম বা বেশি ভারতীয়দের এদেশে চাকরি দিবনা। এদেশ আমরা যোগ্য এবং দেশের জন্য কাজ করব।
সমাজে ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনগুলো মূলত সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে সংগঠিত হয়েছিল। তাই, এক দেশ হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা হওয়া উচিত একটি এমন সমাজ গড়ে তোলা যেখানে সবাই সমান সুযোগ এবং অধিকার পায়, জাতি, ধর্ম, ভাষা বা সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে কেউ যেন বৈষম্যের শিকার না হয়।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষা: ছাত্র আন্দোলনগুলোর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে এই আন্দোলনের উত্তরসূরি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব গণতন্ত্রের মূল্যবোধ রক্ষা করা এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা।
এই প্রত্যাশাগুলোই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তরাধিকার হিসেবে আমাদের সমাজ গঠনে সহায়ক হতে পারে।
লেখক: উদ্যোক্তা,মিথিলাপুর,বুড়িচং।

inside post
আরো পড়ুন