বেন-রাইত ও মোবাইল ফোনে ঈদের চাঁদ!

মাহফুজ নান্টু।।

 

চারদিকে ঘন কুয়াশা। ঘরের ভিতর ও বাইরে তীব্র ঠাণ্ডা। বিকেল থেকে সবার অপেক্ষা। পশ্চিম আকাশে কখন উঠবে রমজানের চাঁদ।
নব্বই দশকের প্রায় সবগুলো রমজান মাস পৌষ মাঘ মাসেই আসতো। দিনভর ধান কাটা-ধান মাড়াই করা হতো। রাতে সেই ধান সেদ্ধ করা হতো। সেদ্ধ ধানের এক মাতাল করা গন্ধ ছিলো।

সন্ধ্যার সাথে সাথে বাড়ির পশ্চিম পাশে চলে যেতো সবাই। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে চেয়ে থাকতো । তারপর হঠাৎ করে কেউ একজন বলে উঠতো ওই তো চাঁদ দেখেছি। ওই ইইই তো রোজার চাঁন। কেউ কেউ চাঁদ দেখে সালাম দিতো। আসসালামু আলাইকুম।
চাঁদ দেখার পরে সবাই বাড়ি যেতো। শুরু হতো বেনরাইতে কি দিয়ে সেহরি খাবে। বেনরাইত মানে ভোর রাত।বাড়ির মা- চাচিরা পৌষের ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে ঘুম থেকে জেগে উঠতেন। সবার গায়ে চাঁদর থাকতো। একজন উঠলেই তিনি অন্যদের জাগিয়ে দিতেন। টিউবওয়েল থেকে পানি উঠাতে হতো। উঠোনের এক কোনে শুরু করতেন রান্নাবান্নার কাজ। মসজিদের মাইকে হুজুরের কন্ঠে ভেসে আসতো আল্লাহর বান্দা নবীর উম্মত ঘুমাইয়োনা আর, রমজানে রহমতে দিদার, কে পাইবে আর।

তখন ভোর রাতে দুধকলা আর খেজুরের গুড় দিয়ে ভাত খাওয়া হত। এটা রেওয়াজ ছিলো। দুধকলা দিয়ে সাহেরি নাহলে রোজা রাখতে কষ্ট হতো। খেজুরের গুড়কে আমরা বলতাম খেজুরের মিডাই। প্রতিটি ঘরেই এই আয়োজন থাকতো। আমরা ছোটরা প্রতিযোগিতা করতাম কে কয়টা রোজা রাখতে পারি। দুপুরের পরে তেস্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম হতো, তবুও রোজা ভঙ্গ করতামনা। দুপুর হলেই সবাই একসাথে পুকুরে যেতাম। শীতকালে গোছলের আগে কিছুক্ষণ রোদ পোহাতাম। গোসল সেরেই মসজিদে গিয়ে যোহরের সালাত আদায় করে বাড়ি চলে আসতাম।

তারপর উঠোনের এক বসে কোরান তেলোয়াত করতাম। কাঠের একটি ফ্রেমের উপর পবিত্র কোরান শরীফ রাখা হতো। কাঠের সেই ফ্রেমটাকে আমরা বলতাম রেল। কোরান শরীফের ভেতর আমরা ময়ূরের পাখা রাখতাম। আমাদের বিশ্বাস ছিলো এই ময়ুরের রঙিন পাখাগুলো থেকে আরো পাখা গজায়। আদৌ রঙিন পাখা থেকে নতুন পাখা গজাতো কিনা জানিনা। তবে আমরা ময়ূরের পাখা রাখতাম। ময়ূরের পাখা রাখার একটা প্রতিযোগিতা হতো।

পুরো রমজান মাস জুড়ে প্রতিটি বাড়ির উঠোনে রোদ পোহানো আর সমুধুর কন্ঠে চলতো কোরান তেলোয়াত। কে কার আগে কতবার পুরো কোরআন শরীফ তেলোয়াত করতে পারে তার প্রতিযোগিতা হতো। একবার পুরো কোরান শরীফটা পড়ে ফেলাকে বলতাম কোরান খতম দেয়া। সবাই চেষ্টা করতো পুরো রমজান মাসে অন্তত দু’বার কোরান খতম দেয়া।

২৭ রমজানে সবার ঘরে ঘরে উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা যেতো। সেই ২৭ রমজান মানে শবে কদরের দিন। পুরো গ্রামে সবার মাটির ঘর। সকাল থেকে সবাই ঘরের দেয়ালগুলো কে মাটি পানি দিয়ে লেপে দিতেন। দুপুরে গোছল করেই বাড়ির নারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন সরা সেমাই বানাতে। আমরা বলতাম ছড়াসিন্নি। নারকেল গুড় বা চিনি দিয়ে সরাসিন্নি রান্না করা হতো। সন্ধ্যায় ধোয়া মোছা মাটির ঘরে ঘরে সবাই আগর বাতি লাগাতেন। একটা পবিত্র আবেশে মন ভরে যেতো। সেই শবে কদরের সন্ধ্যায় সরাসিন্নি দিয়ে ইফতার করা হতো প্রতিটি বাড়িতে। আহ! কি স্বাদ ছিলো সরাসিন্নির।

নামাজ আদায়, কোরান তেলোয়াতের মধ্যে দিয়ে পুরো রমজান মাস পার করতেন সবাই। ২৯ রমজান ইফতার করে সবাই আবার ছুটতেন বাড়ির পশ্চিম পাশে। যেখান থেকে চাঁদ দেখে রোজা রাখা শুরু করতেন। ছেলে বুড়ো সবাই হাজির। গভীর দৃষ্টি নিবন্ধন করতেন পশ্চিম আকাশে। কদাচিৎ নারীরাও যোগ দিতেন। দীর্ঘ সময় আকাশে তাকিয়ে থাকতেন। না আজ চাঁদ উঠেনি। সবাই মন খারাপ করে ঘরে ফিরে যেতেন। ৩০ রমজান সন্ধ্যা। আজতো চাঁদ উঠবেই। তবুও গতকালের মতো সবাই হাজির হন। পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে থাকেন। তারপর ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠে ওইতো ঈদের চাঁদ। একে একে সবাই দেখে এক ফালি বাকা চাঁদ। আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। সবার মনে আনন্দের জোয়ার উঠতো। বাংলাদেশ টেলিভিশনে দলবদ্ধ সঙ্গীত বাজতে থাকে- ও মন রমজানের ওই রোজা শেষে এলোখুশির ঈদ। এই চাঁদ দেখার পর অনেকেই সাইকেল চালিয়ে বাজারে যেতেন। তারপর সেমাই চিনি কিনে আনতেন।

সেই রমজান এখনো আসে। তবে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। এখন মোবাইল ফোনে চাঁদ দেখি, ফ্রিজ ভর্তি রান্না করা ভাত তরকারি থাকে। তাই বেন রাইতে উঠে রান্না বান্না করতে হয়না। উঠোনে পাটি বিছিয়ে কোরান তেলোয়াতের প্রতিযোগিতা হয়না।
এখন শবে কদরের দিন কেউ সরাসিন্নি রান্না করেনা। বাড়ির পশ্চিম পাশে খোলা জায়গা ঠিকই আছে। তবে ছেলে বুড়ো একসাথে হয়ে ঈদেরচাঁদ আর দেখা হয়না। মোবাইল ফোনে উঠে ঈদের চাঁদ!

 

লেখক: কুমিল্লা প্রতিনিধি, নিউজ বাংলা।