ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে নারী শিক্ষার অগ্রদূত

 

।। সমীর চক্রবর্তী।।
পাঠক, এন্ট্রান্স পাস বা ফেল নিয়ে হাজারো গল্প আপনাদের শোনা। তবে আজকের গল্প সকল গল্পকে হার মানাবে। আজ থেকে দেড় শতাধিক বছর আগে একজন দ্বারকানাথের এন্ট্রান্স ফেল গোটা ব্রিটিশ ভারতে নারী শিক্ষা ব্যবস্থায় কি বিপ্লব এনে দিয়েছিল তা আপনাদের কল্পনা শক্তিকে হার মানাবে।
একই সাথে সেসময়কার বিপ্লবী বাঙ্গালী নারীরা কিভাবে সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম স্মাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষক ও চিকিৎসক হয়ে উঠে সেই গল্প শোনাবো।
শুনে অবাক হবেন, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন এদেশের নারীরা স্মাতক পরীক্ষা দিচ্ছিলেন তখন ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের প্রবেশাধিকারই ছিলনা।
যাক, প্রথমে বলি দ্বারকানাথ বঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। এখনকার ঢাকার বিক্রমপুরে ১৮৪৪ সালে তার জন্ম। এন্ট্রান্স ফেলের গল্প যেহেতু প্রথমেই বলেছি ফলে বুঝতে পারছেন ছাত্র হিসেবে তিনি হয়তো তেমন ভালো ছিলেননা। তারউপর প্রথম থেকেই চাণক্য শ্লোক তাকে করে তুলে প্রবল নারী বিদ্বেষী। অবশ্য তখনকার সমাজ দ্বারকানাথের থেকেও বেশী নারী বিদ্বেষী ছিল।
তবে একদিনের ঘটনা তার মনকে উলট পালট করে দেয়। তার চিন্তার জগতে ঝড় তুলে। সতের বছর বয়সে তিনি খেয়াল করলেন তার গ্রামের কুলীন নারীদের বিষ খাইয়ে হত্যা করা হচ্ছে এবং সেটাকে কলেরা বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। ঘটনাগুলো তার মনকে ভাবিয়ে তুলে। পুরো বদলে যান তিনি। তার বদলে যাওয়া থেকেই বিপ্লবের শুরু।
তখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ। সাথী হিসেবে পেলেন সারদাকান্ত, বরদাকান্ত, নবকান্ত, শীলাকান্ত, নিশিকান্ত এবং অঘোরকান্তদের। তারা কুলীন বিপন্ন নারীদের উদ্ধার করে কোলকাতা পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করলেন। সেখানে কণ্যাদের সুপাত্রস্থ করতেন তাদের সমমনা আরেকটি দল। কাজটি ছিল আগুনে হাত দেয়ার মতো। নারী অপহরণ মামলায় পড়ে তাদের তখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। একবারতো তাদের কয়জন গ্রেপ্তার হয়ে আদালতে উঠলেন। তবে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারক জ্যাকসন সাহেব ও অনুকূল মুখোপাধ্যায় এই অপহরণকে সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং জনহিতকর ঘোষণা দিয়ে তাদের মুক্তি দেন।
এদিকে দ্বারকানাথ ঢাকা ছেড়ে তখন ফরিদপুরের বাসিন্দা। সেখান থেকে অবলাবান্ধব নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা বের করেন। তার লেখার আগুন বিপ্লবী করে তুলে ঢাকার তরুণদের। তার লেখনিতে তখন আগুনের ফুলকি বের হয়। সেই আগুনের তাপ গিয়ে ঠেকলো কোলকাতা পর্যন্ত। সেখানকার সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের আমন্ত্রণে তিনি কোলকাতা চলে যান । পরে সেখান থেকেই চলে তার আপোষহীন আন্দোলন।
কোলকাতার দূর্গামোহন নামে এক ভদ্রলোকের বাসায় উদ্ধার করা কুলীন নারীদের রাখা হতো সুপাত্রস্থ করার জন্য। পড়াশোনাও করানো হতো। এই দূর্গামোহনের অবলা নামে এক মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। সেমসময় অনেকের অর্থদানে গড়ে উঠে বেশ কয়েকটি নারী বিদ্যালয়ও। তবে কোনটাতেই মন ভরছিলনা দ্বারকানাথের। বালিগঞ্জে হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে কিছুকাল শিক্ষকতা করে পরে ১৮৭৬ সালে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়। দূর্গামোহন দাসের স্ত্রী স্কুলটিকে টিকিয়ে রাখতে প্রতি মাসে একশো করে টাকা দিতেন। জগদীশ চন্দ্র বসুর বোনসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রী তখন নতুনভাবে তার স্কুলে যুক্ত হোন। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সেই দলের সরলা দাস এবং কাদম্বিনী বসু এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেল। এবার সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গাতে। এন্ট্রান্স পরীক্ষা তখন হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। তখন ভারতবর্ষ তো দূরের কথা ইংল্যান্ডর বিশ্ববিদ্যালয়েও মেয়েদের পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি ছিলনা।
এদিকে দ্বারকানাথ যখন চূড়ান্ত বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন সবার অলক্ষ্যে দেরাদুনের ”ডেরা স্কুল ফর নেটিভ ক্রিশ্চান গার্লস” নামে স্কুল থেকে একাকি সেই লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন চন্দ্রমুখী বসু নামে আরেক নারী। তিনি আমাদের আজকের গল্পের অন্যতম চরিত্র।
চন্দ্রমুখী অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। তিনি পরীক্ষা দেবার জন্য আবেদন করে বসলেন। স্কুলের প্রিন্সিপাল রেভারেন্ড ডেভিড হিরন পড়েন মহা বিপদে। তিনি কৌশল করে কিছু বই উপহার দিয়ে চন্দ্রমুখীকে পরীক্ষা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করলেন। তবে চন্দ্রমুখী অনড় থাকায় বাধ্য হয়ে হিরন সাহেব কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পরীক্ষা নেয়ার আবেদন জানালেন। ১৮৭৬ সালের ২৫ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এ বিষয়ে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হয়। চন্দ্রমুখী বসুকে নানা শর্ত আরোপ করে প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবার সুযোগ দেয়া হয়। বলা হয় পাশ করলেও অফিসিয়াল পাশ লিস্টে তাঁর নাম থাকবে না। সহজ কথায় চন্দ্রমুখী এন্ট্রাপ পাশ, এটা অফিসিয়ালি কোথাও দাবি করতে পারবে না ।
চন্দ্রমুখীকে মুসৌরী শহরে পরীক্ষা দেবার অনুমতি দেয়া হয়। সকল বাঁধা কাটিয়ে তিনি পরীক্ষায় পাস করেন।

দ্বারকানাথ তার ছাত্রীদের এন্ট্রান্স পরীক্ষার বিষয়ে অগ্রসর হয়ে চন্দ্রমুখীর কথা জানতে পারেন। চন্দ্রমুখীর দেখানো পথে এগিয়ে গেলেন দ্বারকানাথ। তিনি প্রভাবশালীদের সাথে আলোচনার পাশাপাশি দেখা করেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর স্যার হবহাইজের সাথে। তার প্রচেষ্টায় সিদ্ধান্ত হলো প্রারম্ভিক পরীক্ষায় (টেস্ট পরীক্ষা) উত্তীর্ণ হলে মেয়েরাও পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। ১৮৭৭ সালে প্রারম্ভিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সরলা ও কাদম্বিনী বসু পাস করলেও মূল পরীক্ষায় অংশ নেয় শুধুমাত্র কাদম্বিনী। ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন তিনি। মাত্র ১ নম্বরের জন্য তিনি ১ম বিভাগ

(চন্দ্রমুখী)

থেকে বঞ্চিত হন। এই ঘটনা গোটা ব্রিটিশ ভারতকে হতবাক করে দেয়। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন এই ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্ত নেয় তখন ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের প্রবেশাধিকার নেই। শুনলেই বুঝা যায় কি বিশাল কা-ই না তারা ঘটিয়েছিল। চোখের সামনে এই সাহসী মেয়েদের ছবি আসলেই চোখে জল চলে আসে।
তার এন্ট্রান্স পাশ করার ফলে বেথুন স্কুলে স্কুলের পাশাপাশি কলেজ খোলার দাবি উঠে। পরে কলেজ খোলাও হয়। এই সময় দৃশ্যপটে হাজির হলেন আবার চন্দ্রমুখী বসু। তিনিও কাদম্বিনীর সাথে কলেজে পড়ার আবেদন জানালেন । কিন্তু যেহেতু তাকে সরকারিভাবে সনদ দেওয়া হয়নি সেহেতু তাঁর ভর্তি নাকচ হয়ে যায়। চন্দ্রমুখীও হারবার পাত্র নন । তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে দাবি জানালেন তাকে যেন কলেজে ভর্তি হবার সুযোগ দেয়া হয়। কারণ এন্ট্রাস পরীক্ষায় তিনিও পাশ করেছেন । সিনেটে সিদ্ধান্তে তাঁকেও কলেজে ভর্তির অনুমতি দেয়া হয়। ১৮৮৩ সালে চন্দ্রমুখী বসু এবং কাদম্বিনী বসু কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেথুন কলেজ থেকে স্মাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
তারা দু’জন শুধু ভারত বর্ষ নয় সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম স্মাতক ডিগ্রিধারী মহিলা। পরে চন্দ্রমুখী বসু ১৮৮৪ সালে এমএ পাস করেন।
পড়ালেখা শেষ করে চন্দ্রমুখী বেথুন কলেজেই লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। এ কলেজেরই প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে পেশাগত জীবন শেষ করেন। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাওয়া নারী চন্দ্রমুখী বসুই প্রথম।
অন্যদিকে,কাদম্বিনী চিকিৎসা বিদ্যায় ভর্তি হন। ১৮৮৬ সালে জিবিএমসি ( গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ) ডিগ্রি অর্জন করেন । ভারতবর্ষের প্রথম নারী চিকিৎসক হন তিনি। পরবর্তীকালে চিকিৎসাশাস্ত্রে উন্নত ডিগ্রি অর্জনের জন্য বিলেত গমন করেন তিনি। তার জন্ম বাংলাদেশের বরিশালে।
তথ্যসূত্র: ভারত বিচিত্রা মার্চ-২০২২ সংখ্যা এবং ইন্টারনেটে নানা মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য।
লেখক: নিবন্ধকার, কর্মকর্তা, সিটিজেনস ব্যাংক পিএলসি, প্রধান শাখা, মতিঝিল, ঢাকা।